'সেঞ্চুরি' কার - চীনের নাকি এশিয়ার?
গত শতাব্দীকে বলা হয়ে থাকে ‘আমেরিকান সেঞ্চুরি’। দুই বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা, অর্থনৈতিক উন্নতি, স্নায়ুযুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং সর্বোপরি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বব্যাপী মোড়লগিরি—সব মিলিয়ে গত শতককে যুক্তরাষ্ট্রের বললে অত্যুক্তি হবে না। বিশেষজ্ঞদের মত, একইভাবে একবিংশ শতক হতে পারে ‘এশিয়ান সেঞ্চুরি’। কিন্তু সত্যিই কি তাই হবে? নাকি চীন এসে বাগড়া দেবে?
বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব-প্রতিপত্তি বেশ কয়েক বছর ধরেই অনুজ্জ্বল। এর মূল কারণ হিসেবে কেউ কেউ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর নীতিকে দায়ী করে থাকেন। এই যুক্তি অবশ্য ফেলে দেওয়ার মতো নয়। নতুন করোনাভাইরাস মহামারি এসে যুক্তরাষ্ট্রের আরও লেজেগোবরে অবস্থা তৈরি হয়েছে। দেশটির বিভিন্ন ক্ষেত্রে থাকা আর্থসামাজিক বৈষম্যগুলো প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে যেখানে দেশের হাল আরও শক্ত হাতে ট্রাম্পের ধরার কথা ছিল, সেখানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট অভিযুক্ত হচ্ছেন লাগামহীন ‘উল্টোপাল্টা’ কথা বলা ও কর্মকাণ্ডের জন্য। দেখা যাচ্ছে, তিনি আজ যে কথা বলছেন, কালই তা বাতিল করে দিচ্ছেন। আর এসব কারণেই বলা হচ্ছে, বৈশ্বিক নেতৃত্ব আর যুক্তরাষ্ট্রের হাতে থাকছে না।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সঙ্গে যুক্তরাজ্যসহ কিছু পশ্চিমা শক্তির অবস্থাও সুবিধার নয়। এর উল্টো দিকেই মহামারির বিরুদ্ধে বিভিন্ন এশীয় দেশের সফলতার গল্প জানা যাচ্ছে। লন্ডন রিভিউ অব বুকসে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর ও ভিয়েতনামের মতো এশিয়ার দেশগুলো যেভাবে মহামারি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখেছে, যুক্তরাষ্ট্র বা যুক্তরাজ্যের মতো দেশ তা পারছে না। এমনকি মহামারি শুরুর পর্যায়ে চীনের শাসনপ্রক্রিয়া ও সরকারের আচরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও এটি স্বীকার করতেই হবে যে ভাইরাসের সংক্রমণ ব্যাপকভাবে ছড়ানো রোধ করতে পেরেছিল সি চিন পিংয়ের দেশ। অথচ এখনো যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা ও ক্যালিফোর্নিয়ার মতো অঞ্চলে করোনাভাইরাসে সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। অথচ মহামারির বিরুদ্ধে যুদ্ধে মার্কিন মুলুকেরই নেতার আসনে থাকার কথা ছিল।
কিন্তু কেন যুক্তরাষ্ট্র পিছিয়ে পড়ছে? ফিন্যান্সিয়াল টাইমসে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলো নিজেদের ‘শ্রেষ্ঠ’ ভাবতেই ভালোবাসত। নিজেদের সম্পর্কে এই অহেতুক উচ্চ ধারণার কারণেই এখন পিছিয়ে পড়ছে দেশগুলো। এসব দেশের নেতারা ধারণা করতেন, বাকি বিশ্বের কাছ থেকে আর কিছু শেখার নেই তাদের। কিন্তু সেই ধারণা যে ভুল, তা এখন প্রমাণিত হয়েছে। আর এ কারণেই দেশগুলো এশিয়ার চেয়ে পিছিয়ে পড়ছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এশিয়ার যেসব দেশের সরকারব্যবস্থা অত্যন্ত শক্তিশালী, সেসব দেশই করোনাভাইরাস মহামারি পরিস্থিতি সবচেয়ে দক্ষতার সঙ্গে সামলাতে পেরেছে। সেই সঙ্গে এসব দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো ভালো এবং রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল।
ঠিক ওপরের এসব কারণেই এশিয়ার এসব দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ছে। এশিয়ার দেশগুলো হয়ে উঠছে বৈশ্বিক বাণিজ্যের কেন্দ্র। ব্যাংকক পোস্টের এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, ২১ শতকে আসিয়ান জোটভুক্ত দেশগুলো সবচেয়ে সম্ভাবনাময় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এ অঞ্চলের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৬৩৫ মিলিয়ন। এ অঞ্চলে ক্রমেই বাড়ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের সংখ্যা এবং সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও স্থিতিশীল। সব মিলিয়ে এশিয়া হয়ে উঠেছে পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম বাজার।
প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান গুগল ও টেমাসেক-এর দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রি ২০২৫ সালের মধ্যে ৮৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হবে। ২০১৮ সালের হিসাব অনুযায়ী, এ অঞ্চলের তরুণ জনগোষ্ঠীর (যাদের বয়স ১৫ থেকে ৩৪ বছর) সংখ্যা প্রায় ২১৩ মিলিয়ন। ২০৩৮ সাল নাগাদ এটি সর্বোচ্চ ২২০ মিলিয়নে পৌঁছাবে। অর্থাৎ একটি বিশাল কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী থাকবে, যা সস্তা শ্রম সরবরাহে কাজে দেবে।
তবে এশিয়ার এই উত্থানে বাগড়া দিতে পারে সি চিন পিংয়ের দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ চলার কারণে এখন আঞ্চলিক রাজনীতিতে মনোযোগী হয়েছে চীন। বাণিজ্যের দিক থেকে দেশটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রে পরিণত হচ্ছে। শুধু ২০১৯ সালে চীনের মোট বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৪ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ন ডলার। এর বাইরে দক্ষিণ চীন সাগরে ক্রমাগত প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়ানোর চেষ্টা করছে দেশটি। এর পেছনে ভূরাজনৈতিক কারণও আছে। গালফ নিউজে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ চীন সাগর চীনের বাড়ির সামনের উঠানের মতো। সুতরাং এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা মানেই চীনের নিরাপদ থাকা। এ ছাড়া দক্ষিণ চীন সাগরে আছে প্রায় ১৯০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাস ও ১১ বিলিয়ন ব্যারেল তেল। এটুকু শুধু পরিমাপ করা গেছে। দক্ষিণ চীন সাগরের আরও অনেক অঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ এখনো পরিমাপ করা হয়নি। তা ছাড়া নৌপথে বৈশ্বিক বাণিজ্যের এক-তৃতীয়াংশ সম্পন্ন হতে দক্ষিণ চীন সাগর পথ ব্যবহার করে।
চীনের এমনতর আগ্রাসী আচরণের কারণে অনেক বিশ্লেষক আশঙ্কা করছেন যে একবিংশ শতক এশিয়ার হওয়ার বদলে চীনের হয়ে যেতে পারে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, গত শতাব্দীর একটি সময়কালে চীন এশিয়ার জাগরণে বিশ্বাসী ছিল। কিন্তু এখন দেশটি আর এশিয়ার অন্যান্য দেশকে নিয়ে সামগ্রিকভাবে এগিয়ে যাওয়ার পথে নেই। কারণ এখন দেশটি নিজেই একটি পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের পরিচালক সি রাজা মোহন মনে করেন, একবিংশ শতককে নিজেদের করায়ত্ত করতে চাইছে চীন। দেশটি এখন জাতীয়তাবাদের ধুয়া তুলছে, এশিয়ায় ঐক্য প্রতিষ্ঠা এখন আর চীনের অগ্রাধিকারের তালিকায় নেই। চীনের প্রতিবেশীরাও আগ্রাসী নীতির কারণে এখন অস্বস্তিতে আছে। এভাবে এশিয়ার সামগ্রিক উন্নতি বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
চীন এরই মধ্যে এশিয়াজুড়ে নিজেদের অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির মহড়া দেখাতে শুরু করেছে। শতাব্দীর সেরা হয়ে সেই মহড়া শেষ হয় কি না, তা–ই এখন দেখার।