ভারতের সাংবাদিকেরা যেভাবে করোনার কবলে
সপ্তাহ দুয়েক আগে ভারতের মুম্বাইয়ের একটি টেলিভিশন চ্যানেলের আলোকচিত্রীসহ বেশ কয়েকজনকে কোভিড–১৯ এ আক্রান্ত কি না. তা পরীক্ষা করা হয়। পরদিনই ফলাফল আসে, জানা যায় ওই আলোকচিত্রী করোনায় সংক্রমিত। তবে করোনার কোনো লক্ষণ তাঁর মধ্যে ছিল না।
জয় মহারাষ্ট্র নামের ওই চ্যানেলের সম্পাদক প্রসাদ ক্যাথে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন,ঘটনাটি মনে ধাক্কার দেওয়ার মতো।কারণ, ওই ব্যক্তি কাজের জন্য বাইরেও যাননি।
এরপর ওই মারাঠি সংবাদ সংস্থার আরও ১৫ জন কোভিড–১৯ রোগে আক্রান্ত হন। এঁদের বেশির ভাগই প্রতিবেদক ও আলোকচিত্রী। অথচ তিন সপ্তাহ আগে চ্যানেলটি সাংবাদিকদের বাইরের অ্যাসাইনমেন্টে পাঠানো বন্ধ করে দেয়। এমনকি এই ১৫ জনের বেশির ভাগই বাসায় কোয়ারেন্টিনে ছিলেন। এর পর কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে আন্ধেরি এলাকার ৮ তলার ওপর ১২ হাজার বর্গফুট জায়গাজুড়ে চলা ওই নিউজ চ্যানেলটির কার্যক্রম।
একজন প্রোডাকশন কন্ট্রোল রুমের টেকনিশিয়ান ও একজন ইলেক্ট্রিশিয়ান—মাত্র দুজন কাজ করছেন সেখানে। সাংবাদিক ও টেকনিশিয়ান থেকে শুরু করে কোম্পানির গাড়ির চালক পর্যন্ত ১২০ জন কর্মীর বেশির ভাগকে পরীক্ষা করা হয়েছে। ল্যাবগুলো থেকে ধীরে ধীরে ফলাফলও আসছে। যা থেকে বোঝা যাচ্ছে সংক্রমণ বাড়ছে।
ক্যাথে বলেন, 'ভাইরাসের সংক্রমণে জর্জরিত সরাসরি সম্প্রচার করা একটি নিউজ চ্যানেল চালানো চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। তাই এটি চালিয়ে যেতে আমাদের কর্মকাঠামো নতুন করে সাজাতে হয়েছে।'
করোনার প্রাদুর্ভাব বাড়তে থাকায় তিন সপ্তাহ আগেই বাসা থেকে নেটওয়ার্ক সংযোগের মাধ্যমে খবর প্রচার হচ্ছিল।সাধারনত ২৮ মিনিটের ১৮টি বুলেটিন প্রচার করা হয়।করোনার সময় তা কমিয়ে ৬টি করা হয়। বাকি সময় চলতি ঘটনা ও বিভিন্ন খবরের পুনর্প্রচার চলে। এখানে করোনায় সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা খুব কম ছিল। এরপরও সংক্রমণ ঘটেছে।
ভারতে এর মধ্যে ১০০ জন সাংবাদিক করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছেন। সরকারি তথ্যমতে, দেশটিতে করোনায় সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা ৩৫ হাজার।
ওই চ্যানেলটির খবর পাঠকেরা এখন বাড়িতে বসেই সংবাদ পাঠ করছেন।ফোর জি মোবাইলের নেটওয়ার্কের সঙ্গে প্রযুক্তি মিলিয়ে চলছে সম্প্রচার। তবে এতে অনেক বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে। ক্যাথে বলেন, 'বুলেটিনের মাঝখানে আচমকা অ্যাঙ্করের বাড়িতে বিদ্যুৎ চলে যায়। কখনোবা ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এটি সহজ নয়, তবে আমরা মোকাবিলা করছি এবং একটি বুলেটিনও মিস করিনি।'
করোনাভাইরাসের কারণে ভারতজুড়ে লকডাউন থাকলেও সংবাদকর্মীদের সংবাদ সংগ্রহের জন্য বাইরে বের হতে হচ্ছে।এতে তাঁদের সংক্রমিত হওয়ার সংখ্যাও বাড়ছে। চেন্নাইয়ে ৩৫ জন সাংবাদিক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। কলকাতায় এক ক্রীড়া সাংবাদিক করোনার সব লক্ষণ নিয়ে মারা গেছেন। পাঞ্জাব কেসারি মিডিয়া গ্রুপের ১৯ জন কর্মী করোনায় সংক্রমিত।
ভারতে করোনার সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ হয়েছে মুম্বাইয়ে। এখানে প্রায় ৭ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ২৯০ জন।মুম্বাইয়ের ১৬৭ জন সাংবাদিকের করোনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬৭ জনেরই ফল পজিটিভ। ৬ জন সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে গেছেন। অন্যরা হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। লক্ষণ রয়েছে বলে আরও ১৭০ জন সাংবাদিকের করোনা পরীক্ষা করা হবে।
ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব মিডিয়া রিসার্চের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবেদক ও আলোকচিত্রী যাঁরা করোনায় আক্রান্ত, তাদের বেশির ভাগেরই লক্ষণ তেমন প্রকাশ পায়নি। আসলে ভারতে আক্রান্ত বেশির ভাগের মধ্যেই হালকা লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এত সাংবাদিক এই ভাইরাসে সংক্রমিত হচ্ছেন?
মুম্বাইয়ের টিভি জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ভিনোদ জাগদালে বলেন, 'এর অনেক কারণ আছে। প্রাথমিকভাবে অনেক টিভি চ্যানেলের সাংবাদিককে লকডাউনের পরিস্থিতি সরেজমিনে তুলে ধরার ওপর সম্পাদকের চাপ ছিল। তার ওপর এমন কিছু অতি উৎসাহী সাংবাদিক আছেন, যাঁরা সম্ভবত যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করেননি। তাঁর করোনা কবলিত এলাকায় অবলীলায় গেছেন, ছবি তুলেছেন, রোগীদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন।'
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, এই সাংবাদিকেরা অফিসে ফিরেছেন কোম্পানির গাড়িতে, এসে সহকর্মীদের সঙ্গে বিষয়টি শেয়ার করেছেন। সংক্রমিত মিডিয়া কর্মীর মধ্যে অন্তত তিনজন গাড়ির চালক আছেন। পরিস্থিতি এখন এত খারাপ হয়েছে যে টিভি চ্যানেলগুলো এখন বেশির ভাগ কর্মীকে বাড়ি থেকে কাজ করতে পাঠিয়েছেন।
জাগদালে বলেন, সাংবাদিকদের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি হয়েছে। তাদের বেশির ভাগই বাইরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। তাঁদের কর্তারাও এখন বাইরে বেরিয়ে এসে কাজ করার জন্য চাপ দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও সতর্ক হয়েছেন।
কলকাতার ক্রীড়া সাংবাদিক রনি রায় গত মার্চে গুজরাটে একটি ক্রিকেট ম্যাচ কাভার করতে যান।সেটিই তার শেষ অ্যাসাইনমেন্ট।তিনি জীবাণুরোধী মাস্ক ব্যবহার করতেন এবং বার বার হাত ধুয়ে ফেলতেন। এরপরও বাসায় ফেরার এক সপ্তাহের মধ্যে তাঁর জ্বরসহ করোনার অন্য উপসর্গ দেখা দেয়। গত সপ্তাহে এক রকম বিনা চিকিৎসায় মারা যান তিনি।
বারখা দত্ত নামের এক সাংবাদিক বলেন, 'কোভিড -১৯-এর সময়ে সাংবাদিকদের রিপোর্ট করার জন্য খুব ভাল নির্দেশিকা রয়েছে। তা অনুসরণ করা গুরুত্বপূর্ণ।'
তবে যতই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হোক না কেন, এই মহামারির সময় সাংবাদিকতা খুব কঠিন একটি কাজ।