চীনে আলোড়ন তোলা নিখোঁজ ৩ জনকে নিয়ে প্রশ্ন
করোনাভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীনকে নিয়ে কয়েক মাস ধরেই গুঞ্জনের শেষ নেই। সমালোচনা রয়েছে এই ভাইরাস নিয়ে চীনের ভূমিকা ও কর্মকাণ্ড নিয়ে। চীনা নাগরিক কেউ এ ব্যাপারে মুখ খুললেই তাঁকে পড়তে হচ্ছে আইনের গ্যাঁড়াকলে। কেউ কেউ হয়ে যাচ্ছেন নিখোঁজ। এমন তিনজন চীনা নাগরিকের কথা তুলে ধরা হয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে, যাঁরা হুইসেলব্লোয়ার বলে পরিচিতি পেয়েছেন। প্রশ্ন উঠেছে, কোথায় তাঁরা? কী ঘটেছে তাঁদের ভাগ্যে?
চীন শুরু থেকে এ পর্যন্ত যেভাবে করোনাভাইরাসের মোকাবিলা করেছে, তা নিয়ে দেশ–বিদেশে প্রশ্নের শেষ নেই। চীনের ভূমিকা নিয়ে শুরুতেই প্রশ্ন তুলেছিলেন উহান সেন্ট্রাল হাসপাতালের চিকিৎসক লি ওয়েনলিয়াং। ডিসেম্বরের শুরুতেই ৩৪ বছরের ওই রোগতত্ত্ববিদ চীনে সার্সের মতো নতুন ভাইরাস মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার পূর্বাভাস দেন। ৩০ ডিসেম্বর সহকর্মীদের সঙ্গে গ্রুপ চ্যাটেও রোগীদের ভাইরাসের উপসর্গ সম্পর্কে তিনি তথ্য জানান।
এভাবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে চীন আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেওয়ার আগেই এ সম্পর্কে লোকজনকে জানিয়েছিলেন লি ওয়েনলিয়াং। এর কয়েক দিন পর লিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। ‘মিথ্যা গুজব ছড়ানো’, ‘গুরুতর সামাজিক শৃঙ্খলা নষ্ট’ আর ‘আইন ভঙ্গ করা’—এসব অভিযোগ এনে তাঁর কাছ থেকে মুচলেকা আদায় করে পুলিশ। পরে তাঁকে মুক্তিও দেওয়া হয়। মার্চে এক সরকারি তদন্তে সব ধরনের অভিযোগ থেকে লিকে রেহাই দেওয়া হয়। তত দিনে অবশ্য করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে হেরে না–ফেরার দেশে পাড়ি জমান লি ওয়েনলিয়াং। ফেব্রুয়ারির শুরুতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণে লি মারা যান।
এতে করোনাভাইরাস নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী বা হুইসেলব্লোয়ারদের ভূমিকা অনেকের মনে প্রশ্ন তুলেছে। এমন তিন হুইসেলব্লোয়ারের নিখোঁজ হওয়ার কথা জানিয়েছেন তাঁদের পরিবারের সদস্যরা।
এবার হুইসেলব্লোয়ার চীনের দুই অনলাইন নাগরিক অধিকার কর্মী (অ্যাকটিভিস্ট) এ মাসের মাঝামাঝি থেকে লাপাত্তা বলে খবর প্রকাশিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান গিটহাবের হয়ে করোনাভাইরাস নিয়ে নিষিদ্ধ সব প্রতিবেদনের ডিজিটাল আর্কাইভিংয়ে কাজ করছিলেন ছেন মেই।
‘লোকজনের সঙ্গে ঝগড়া–ফ্যাসাদ ও উসকানিতে’ জড়ানোর অভিযোগ এনে ১৯ এপ্রিল ছেন ও তাঁর বান্ধবী তাংকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। চাইয়ের ভাই ছেন কুন এমনটাই অভিযোগ করেছেন। একই দিন চাই ওয়েই নামের গিটহাবের আরেক কর্মীকেও পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। চীনে রাজনৈতিক উল্লিখিত অভিযোগে সাধারণত ভিন্নমতাবলম্বী ব্যক্তিদের ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। পুলিশ অবশ্য ২৪ এপ্রিল ছেন মেইয়ের পরিবারের সদস্যদের জানিয়েছে, একটি নির্ধারিত জায়গায় তাঁদের নজরবন্দী রাখা হয়েছে।
ছেন মেই গিটহাবের যে প্রকল্পটিতে কাজ করছিলেন, তার নাম টারমিনাস২০৪৯। চীনের কর্তৃপক্ষ গণমাধ্যমের যেসব খবরাখবর নিষিদ্ধ করেছে বা সরিয়ে দিয়েছে, সেগুলো সংগ্রহে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে ওই প্রকল্পে যুক্ত ছিলেন। বলা হচ্ছে, টারমিনাস২০৪৯ এ সেন্সরশিপের কাঁচিতে পড়া সংবাদ, ভিডিওর পাশাপাশি উইচ্যাটের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লোকজনের ব্যক্তিগত লেখাগুলোও রাখা হচ্ছিল জানুয়ারির শুরু থেকেই। কোনো ওয়েবপেজ সরকার ব্লক করে দিলেই লোকজন যাতে প্রতিরোধে উৎসাহিত হতে পারেন, সেই ভাবনা থেকেই প্রকল্পটি চালু হয়।
মাক্রোসফটের মালিকানাধীন গিটহাবের অনলাইন প্রকল্পটিতে উহানের লোকজনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার পাশাপাশি উহান সেন্ট্রাল হাসপাতালের চিকিৎসক আই ফানের সাক্ষাৎকারটিও রয়েছে। তাঁর বিরুদ্ধেও কর্তৃপক্ষ করোনা নিয়ে গুজব ছড়ানোর অভিযোগ আনা হয়। মজার বিষয় হচ্ছে, মার্চে পিপল ম্যাগাজিনে হুইসেলব্লোয়ার আই ফানের সাক্ষাৎকার প্রকাশের কয়েক ঘণ্টা পরেই চীন সরকার তা ইন্টারনেট থেকে সরিয়ে দেয়।
সঙ্গে সঙ্গে চীন তো বটেই, বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে চীনের নেটিজেনেরা কোড ল্যাঙ্গুয়েজ, ইমোজিসহ নানা সৃজনশীল উপায়ে তা নিজেদের মধ্যে বিনিময় অব্যাহত রাখেন। টারমিনাস২০৪৯ এ চীন সরকারের কট্টর সমালোচক অধ্যাপক শু ঝ্যাংগ্রুনের আলোচিত একটি লেখাও রয়েছে। চীনের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ও সেন্সরশিপের অভিযোগ আনায় অধ্যাপক ঝ্যাংগ্রুনকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে। বন্ধ রাখা হয়েছে তাঁর উইচ্যাট অ্যাকাউন্ট।
মহামারির শুরুর দিনগুলোতে যে বিতিকিচ্ছি অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল, চীন তা বাজেভাবে সামাল দিয়েছে এমন অভিযোগ রয়েছে। প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকা চীনের নাগরিকদের একটি অংশটি ইন্টারনেট সেন্সরশিপ ও সরকারের বিরুদ্ধে শেষ অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে গিটহাবকে। চীনে এ মুহূর্তে গিটহাবের মূল সাইটটিতে প্রবেশের সুযোগ থাকলেও টারমিনাস২০৪৯ পেজটি ব্লক করা।
টারমিনাস২০৪৯ এর তিন কর্মীকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ার পর দেশে শোরগোল শুরু হয়েছে। সিংহুয়া ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক গুয়ো ইয়ুহুয়া বলেন, ‘লোকজনের সঙ্গে কী ধরনের ঝগড়া–ফ্যাসাদ এবং উসকানিতে এঁরা যুক্ত ছিলেন, বলতে পারেন? এ ধরনের পদবাচ্যগুলো খুবই অস্পষ্ট। সরকার হরহামেশাই রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী আর নাগরিক অধিকার কর্মীদের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ আনে। এ ধরনের অভিযোগে একজনকে অন্তত পাঁচ বছর পর্যন্ত জেলে রেখে দেওয়া যায়।’