হারজিত চিরদিন থাকবে। তবে করোনা-উত্তর পৃথিবীর হিসাবটা হবে আলাদা। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে ইতালির মানুষ। তারা আমাদের ভাবতে শিখিয়েছে, ‘সবকিছু একদিন ঠিক হয়ে যাবে’। কিন্তু সত্যিই কি পরে সবকিছু ঠিকঠাক হবে? ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর বর্ণনায়, ‘অদৃশ্য এক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের’ মধ্যে আছে পুরো বিশ্ব। দূরবর্তী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিণতি বিবেচনা করলে এখনই এ প্রশ্নের উত্তর অপরিণত বলেই মনে হবে। ব্রিটিশ গণমাধ্যম গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে।
গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণধর্মী এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বনেতা, কূটনীতিক এবং ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা জানেন যে তাঁরা নবযুগ সৃষ্টিকারী একটি সময়ে জীবন যাপন করছেন। প্রতিদিনের লড়াইয়ের দিকে তাঁদের এক চোখ রাখতে হচ্ছে আর আরেক চোখ রাখতে হচ্ছে বিশ্ব সংকট মোকাবিলায় দায়িত্বের দিকে। কিন্তু বিশ্বজনমতের আদালতে প্রতিদ্বন্দ্বী মতাদর্শ, শক্তিশালী জোট, নেতা এবং সামাজিক সংহতির ব্যবস্থাকে চাপের পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। ইতিমধ্যে বৈশ্বিক এ গ্রামের প্রত্যেকে নিজস্ব পাঠ নিতে শুরু করেছে। ফ্রান্সে মাখোঁ যেমন পূর্বাভাস দিয়েছেন, ‘এ সময়টা আমাদের অনেক কিছু শেখাবে। অনেক দৃঢ় বিশ্বাসে চিড় ধরবে এবং প্রত্যয় নড়বড়ে হয়ে যাবে। অসম্ভব বলে মনে করা অনেক জিনিস ঘটবে। পরদিন আমরা যখন জিতব, আগের দিনটি আর ফিরে আসবে না, আমরা নৈতিকভাবে আরও শক্তিশালী হব। আমরা পরিণতিগুলো ঠিকঠাক ধরতে পারব।’ তিনি স্বাস্থ্য খাতে বড় বিনিয়োগ দিয়ে শুরু করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।
জার্মানিতে সাবেক সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির সিগমার গ্যাব্রিয়েলের কণ্ঠে আশঙ্কার বার্তা। তিনি অনুমান করেছেন, পরবর্তী প্রজন্ম বিশ্বায়নের বিষয়ে সোজাসাপটা হবে। ইতালিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাত্তেও রেঞ্জি ভবিষ্যতের জন্য কমিশন গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন। হংকংয়ে এক গ্রাফিতিতে লেখা হয়েছে, ‘স্বাভাবিক অবস্থায় আর ফিরে আসতে পারে না, কারণ প্রথমে স্বাভাবিকে সমস্যা ছিল।’ মার্কিন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব হেনরি কিসিঞ্জার বলেছেন, করোনাভাইরাস–পরবর্তী ব্যবস্থার উপযোগী করে তুলতে শাসকদের এখনই প্রস্তুত হতে হবে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ‘সবচেয়ে বড় শক্তিগুলোর মধ্যে সম্পর্ক কখনোই ততটা অকার্যকর হয়নি। কোভিড-১৯ নাটকীয়ভাবে দেখিয়ে দিচ্ছে, হয় আমরা একত্র হব অথবা আমরা হেরে যাব।’
তবে যতই পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থার কথা বলা হোক না কেন, বৈশ্বিক চিন্তাবিদদের আলোচনার সূত্রপাত সহযোগিতা নিয়ে নয়, বরং চীন বা আমেরিকা করোনা–উত্তর বিশ্বে কে নেতা হিসেবে আবির্ভূত হবে, তা নিয়ে। অবশ্য যুক্তরাজ্যে বিতর্কটি তুলনামূলকভাবে কম। যুক্তরাজ্যে নতুন রাজনীতি নিয়ে এখন আপাতত কোনো আলোচনা নেই। কিন্তু ব্রেক্সিট নিয়ে ক্লান্ত যুক্তরাজ্য আর বেশি উত্থান-পতন মোকাবিলা করতে পারবে না বলে মনে হয়।
ক্ষমতাধর হয়ে উঠবে কে, তা নিয়ে যুক্তরাজ্যের তুলনায় ইউরোপের অন্য দেশ, আমেরিকা ও এশিয়াতে আলোচনা বেশি। দেখা যাচ্ছে, জনজীবন স্থবির হয়ে থাকলেও বিতর্ক দ্রুত ছড়াচ্ছে। অর্থনীতি, জনস্বাস্থ্য, বাণিজ্য বন্ধ, কেন্দ্রীয় বা আঞ্চলিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আপেক্ষিক গুণাবলি, বিশ্বায়নের ভঙ্গুরতা, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভবিষ্যৎ, কর্তৃত্ববাদের অন্তর্নিহিত সুবিধা প্রভৃতি বিষয়ে বিতর্কের কমতি নেই।
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসজনিত মহামারিটি বিশ্ব নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় রূপান্তরিত হয়ে উঠেছে। যে দেশগুলো এ সংকটকে সবচেয়ে কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে পেরেছে, তারা কিছুটা এগিয়ে থাকবে। কূটনীতিক, দূতাবাসগুলো সরকারকে সংকট মোকাবিলা করার দক্ষতা প্রচার ও সমালোচনাকে অপরাধ হিসেবে প্রমাণে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
বেলজিয়ামের ব্রাসেলসভিত্তিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ কীভাবে ভাইরাস স্থায়ীভাবে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পরিবর্তন ঘটবে, তা মূল্যায়ন করেছে। ওই সংস্থার মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে দুটি শিক্ষা গ্রহণ করার মতো। একটি হচ্ছে, কোভিড-১৯-কে আরও ভালোভাবে পরাস্ত করার জন্য একত্রে কাজ করা। আরেকটি হচ্ছে নিজেদের সুরক্ষার জন্য আরও কঠোরভাবে পৃথক হওয়া। বর্তমান এ পরিস্থিতি তাই শুধু জাতিসংঘ বা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিচালন সক্ষমতার পরীক্ষা নেবে না, বরং মূল্যবোধ ও রাজনৈতিক দর-কষাকষির সাধারণ বিষয়গুলোরও মূল্যায়ন হবে।
ইতিমধ্যে অনেকে দাবি করছেন যে প্রতিযোগিতামূলক বিবরণের এই যুদ্ধে পশ্চিমাদের তুলনায় ‘পূর্ব’ এগিয়ে রয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার দার্শনিক বাইয়ুং-চুল হান যুক্তি দিয়েছেন, জাপান, কোরিয়া, চীন, হংকং, তাইওয়ান বা সিঙ্গাপুরের মতো এশীয় অঞ্চলকে জয়ী বলা যেতে পারে। কারণ, এদের মধ্যে কর্তৃত্ববাদী মানসিকতা রয়েছে, যা আদপে এসেছে তাদের কনফুসিয়াসের সংস্কৃতি থেকে। ইউরোপের তুলনায় লোকেরা কম বিদ্রোহী এবং বেশি বাধ্য। তারা রাষ্ট্রকে বেশি বিশ্বাস করে। প্রাত্যহিক জীবন অনেক বেশি সংগঠিত। সর্বোপরি ভাইরাসের মোকাবিলায় এশিয়ানরা ডিজিটাল নজরদারি করদে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এশিয়ার মহামারি লড়াইয়ে কেবল ভাইরোলজিস্ট এবং মহামারি বিশেষজ্ঞরা নয়, কম্পিউটার বিজ্ঞানী ও বিগডেটা বিশেষজ্ঞরাও লড়াই করেছেন।
কোরীয় দার্শনিকে পূর্বাভাস অনুযায়ী, চীন এখন মহামারির বিরুদ্ধে সাফল্যের মডেল হিসেবে তার ‘ডিজিটাল পুলিশ’ মডেল ধারণা বিক্রি করতে সক্ষম হবে। চীন তার ব্যবস্থার শ্রেষ্ঠত্ব আরও গর্বের সঙ্গে তুলে ধরবে। এ কারণে হয়তো পশ্চিমা ভোটাররা তাদের অনেক কিছুই বিসর্জন দেবে।
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ভাইরাস বিস্তারে অপরাধী না হয়ে বিশ্বের ত্রাণকর্তা হিসেবে নিজেকে অধিষ্ঠিত করেছে চীন, যা বিজয়ীর দৌড়ে তাদের কিছুটা এগিয়ে রেখেছে। নতুন প্রজন্মের তরুণ চীনা কূটনীতিকেরা তাদের দেশের শ্রেষ্ঠত্বের দাবিতে সোশ্যাল মিডিয়ায় নেমে পড়েছেন। কিন্তু তাঁদের এ আত্মপ্রচারকে ‘নির্লজ্জ’ বলে সমালোচনা করা হচ্ছে। ইনস্টিটিউট মন্টাইগনে সাবেক ফরাসি রাষ্ট্রদূত মিশেল ডুকলস চীনকে ভাইরাসের বিরুদ্ধে জয়ের পক্ষে নির্লজ্জভাবে রাজনৈতিক প্রচারের চেষ্টা করার অভিযোগ করেছেন।
হার্ভার্ড ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনসের বিশেষজ্ঞ স্টিফেন ওয়াল্ট মনে করছেন, চীন বিজয়ী হতে পারে। ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনে তিনি বলেছেন, ‘করোনাভাইরাস পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে শক্তি এবং প্রভাবের পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করবে। দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুর সেরা প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে এবং চীন তার প্রাথমিক ভুলগুলো শুধরে ভালো ব্যবস্থাপনা দেখিয়েছে। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে সরকারের প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত সংশয়যুক্ত এবং সম্ভবত তা পশ্চিমা ব্র্যান্ডের শক্তি দুর্বল করে তুলেছে।’
স্লোভেনীয় দার্শনিক স্লাভোজ অবশ্য একটি কর্তৃত্ববাদী সংক্রমণের ভয় করছেন। তিনি পূর্বাভাস দিচ্ছেন, পশ্চিমে মানবতার মুখোশের আড়ালে বর্বরতা এবং এমনকি সহানুভূতির সঙ্গে নির্মম বেঁচে থাকার মতো ব্যবস্থা দেখা যেতে পারে। এর বিপরীতে ভারতের অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং অধ্যাপক শিবশঙ্কর মেনন বলছেন, ‘এখন পর্যন্ত অভিজ্ঞতা দেখায় যে কর্তৃত্ববাদী বা তুষ্টিবাদী কেউ মহামারি ঠেকানোর পক্ষে ভালো নয়। বরং যে দেশ প্রাথমিক অবস্থায় সফল ব্যবস্থা নিয়েছে, যেমন কোরিয়া ও তাইওয়ান এবং যেখানে গণতন্ত্র রয়েছে, তারা ভালো করেছে।’
বিশেষজ্ঞ ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা জার্মানি ও দক্ষিণ কোরিয়ার প্রশংসা করে বলেন, ‘কার্যকর সংকট প্রতিক্রিয়ার প্রধান বিভাজক রেখা হিসেবে একনায়কতন্ত্র এবং অন্যদিকে গণতন্ত্রকে রাখা যাবে না। দেশ শাসনের ধরনের চেয়ে দক্ষতা নির্ণায়ক হতে পারে রাষ্ট্রের সক্ষমতা ও সর্বোপরি সরকারের ওপর বিশ্বাস।’
চীনের তুলনায় নিজেদের গণতান্ত্রিক শক্তি হিসেবে প্রচার করে দক্ষিণ কোরিয়া। দেশটির জাতীয় গণমাধ্যমে তাদের মডেল কীভাবে জার্মানিতে অনুসরণ করা হচ্ছে, সেই প্রচারের বন্যায় ভেসে যাচ্ছে। অধ্যাপক জোসেফ স্টিগলিজ বলেন, ‘দক্ষিণ কোরিয়া রপ্তানিমুখী দেশ হয়েও দীর্ঘদিন ধরে সমস্যায় রয়েছে।’ তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন, এই মহামারি চিকিৎসা সরঞ্জাম উৎপাদনের ত্রুটিগুলো সামনে এনেছে। দক্ষিণ কোরিয়া কিছু ক্ষেত্রে প্রশংসা পেতে পারে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বাজার হারাচ্ছে।’
অন্যদিকে, হেরে যাওয়ার তালিকায় নাম থাকবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ)। দেনা–পাওনা নিয়ে উত্তর ও দক্ষিণ ইউরোপের মধ্যে কুৎসিত লড়াই আরও বিস্তৃত হয়েছে। ইতালির প্রধানমন্ত্রী গুইসেপ কন্তে বলেছেন, ইইউ যদি ব্যর্থ হয় তবে এটি ভেঙে পড়তে পারে। জ্যাক ডিলার্স ইনস্টিটিউটের থিঙ্কট্যাঙ্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট নিকোল গেনস্টো বলেছেন, ‘ইইউর প্রস্তুতির অভাব, তার শক্তিহীনতা এবং এর ভীতি বিস্ময়কর। প্রয়োজনীয় সময়ে প্রত্যেকে নিজের চিন্তা করেছিল।’ ইউরোপ ঘিরে নেতাদের মধ্যে শুরু হয়েছে পরস্পরকে দোষারোপের পালা। পর্তুগিজ, স্পেনের পক্ষ থেকে নেদারল্যান্ডসের সমালোচনা করা হচ্ছে। স্পেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যারাঞ্জা গঞ্জালেস সোজাসাপটা কথা, ‘পুরো জাহাজ যখন ডুবছে, তখন ফার্স্ট ক্লাস কেবিন তোমাকে সুরক্ষা দেবে না।’ অর্থাৎ নেদারল্যান্ডস বা জার্মানি করোনা মোকাবিলায় যতই ভালো করুন না কেন, ইউরোপের মধ্যে থেকে সেও বাঁচতে পাবরে না।
ইউরোপে মৃত মানুষের সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি আফ্রিকাতেও সংকট প্রবেশ করতে শুরু করেছে। ইইউর অর্থনৈতিক উদ্ধার তহবিল কীভাবে করা হবে, সে বিষয়টি এখন পর্যন্ত অনির্ধারিত ও অত্যন্ত কারিগরি বিষয়ে আধিপত্য পেয়ে আসছে। ইউরোপের প্রধান সান্ত্বনা হতে পারে আটলান্টিকের ওপারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সন্ধ্যাকালীন সংবাদ সম্মেলনে প্রতিদিনের বিশৃঙ্খলা দেখা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেলের উপদেষ্টা নাথালি টোকি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, ‘১৯৫৬ সালে যুক্তরাজ্যের বৈশ্বিক ক্ষমতা যেমন সুয়েজ সমস্যার কারণে কমে গিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য করোনাভাইরাস সেই “সুয়েজ মুহূর্ত” ফিরিয়ে আনতে পারে।’