দূরত্ব রেখে চলা আর কত দিন?

নিউইয়র্কে করোনাভাইরাস সতর্কতায় মাস্ক পরে ঘুরছে লোকজন। ছবি: এএফপি
নিউইয়র্কে করোনাভাইরাস সতর্কতায় মাস্ক পরে ঘুরছে লোকজন। ছবি: এএফপি

আর কত দিন এ অবস্থা চলবে কে জানে! স্কুল বন্ধ, অফিসের কাজ বাসায়, ছয় ফুট পর্যন্ত দূরত্ব রেখে চলা এবং জোমবি-অ্যাপোক্যালিপসের জনমানবহীন রাস্তা? এই প্রশ্ন এখন পুরো আমেরিকা জুড়ে। করোনাভাইরাস মহামারির এই দিনগুলোয় লাখ লাখ মানুষের নিঃশব্দ আর্তনাদ শূন্যে ঘুরপাক খাচ্ছে । কিন্তু বিজ্ঞানের জন্য বিশেষ করে এ প্রশ্নের জবাব দেওয়া বিশেষভাবে কঠিন।

এপিডেমিওলোজিস্ট ও ভাইরোলিজস্টদের কাছে এ প্রশ্নের সবচেয়ে ভালো ও সৎ উত্তর হলো, সহজ কথায় বলতে গেলে: ‘এটা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করছে।’ খুব দ্রুত এ সমস্যা থেকে মুক্তি নেই - কয়েক সপ্তাহ তো নয়ই, হয়তো কয়েক মাস লেগে যেতে পারে। কত মাস লাগবে তা নির্ভর করছে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর ওপর:

যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্ত যখন সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাবে:
গেল কয়েক দিনে যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্তের সংখ্যা যে গতিতে বাড়ছে, তার সঙ্গে মিল রয়েছে ইতালির পরিস্থিতির। ইতালিতেও জ্যামিতিক হারে বাড়ছিল আক্রান্তের সংখ্যা।
‘এটি নির্ভর করছে, ধরুন এখন থেকে এক সপ্তাহ পর, আমাদের অবস্থা হয়তো ইতালি অথবা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো হবে,’ জনস হপকিন্স সেন্টার ফর হেলথ সিকিউরিটির এপিডেমিওলোজিস্ট কইটলিন রিভার্স বলছিলেন চীনে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর ছড়িয়ে পড়তে সময় লেগেছিল প্রায় দুই মাস। পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝতে আরও এক মাসের মতো। ওই সময়ে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা সর্বোচ্চ পৌঁছায়। দক্ষিণ কোরিয়ায় লেগেছিল আধা মাস।

কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্তের সংখ্যা শীর্ষে গিয়ে ঠেকবে কখন সে সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা প্রায় অসম্ভব। এর প্রধান কারণ আমরা এখনো জানি না ঠিক কতজন আক্রান্ত হয়েছে। পরীক্ষা করা হয়েছে খুবই সীমিত পরিসরে।

একজন এপিডেমিওলোজিস্ট যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, ধরুন আপনি ইঁদুর খুব ভয় পান। আপনার ভবনের ভূ-গর্ভস্থ অংশে প্রচুর ইঁদুর। আপনি ইঁদুর মারার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করলেন ইঁদুর থেকে রক্ষা পেতে আর কত দিন লাগতে পারে। কারণ আপনি ভয়ে ঘরে ঢুকতে পারছেন না। বিপদ বুঝতে আপনাকে প্রথমে আলো জ্বালতে হবে এবং পরীক্ষা করে দেখতে হবে ইঁদুরের বিষ্ঠা কত জায়গায় রয়েছে। পরিস্থিতি জেনে সাড়া দেওয়ায় মার্কিনিদের গতি অন্যান্য দেশের মানুষের তুলনায় অনেক ধীর।

এই সংকট আরও কত খারাপ হবে কিংবা আরও কত দিন স্থায়ী হবে তা বুঝতে সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন রোববারের বার্তাটা দেখলেই বোঝা যায়। রোববার তারা আগামী আট সপ্তাহের জন্য ৫০ জনের বেশি সমাগম নিষিদ্ধ করেছে। সোমবার কর্মকর্তারা বলেছেন, বিভিন্ন রাজ্যের কর্মকর্তারা বলেন এই পুরো শিক্ষাবর্ষেই হয়তো লাখ লাখ শিক্ষার্থীকে স্কুলের বাইরে থাকতে হবে। সোমবারের এক সংবাদ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সমাজে করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় স্কুল, বার, রেস্তোরাঁ, ব্যায়ামাগার এবং সমাগম হয় এমন সব জায়গায় না যাওয়ার পরামর্শ করেছেন। জুলাই বা আগস্ট পর্যন্ত এ পরিস্থিতি বজায় থাকতে পারে।

আক্রান্তের সংখ্যা সর্বোচ্চে পৌঁছানোর পরও ভাইরাসকে দূরে রাখতে আমাদের কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ভাইরাসের উৎপত্তির আড়াই মাসের মাথায় চীন বিভিন্ন জায়গায় জারি থাকা নিষ্ঠুর লক ডাউন তুলে নিয়েছে। স্কুলগুলো খুলতে শুরু করেছে, বন্ধ হচ্ছে সংকট মুহূর্তে উহানে খোলা অস্থায়ী হাসপাতালগুলো।

করোনাভাইরাস নিয়ে নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে আসছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প
করোনাভাইরাস নিয়ে নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে আসছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প

কিন্তু নতুন করে আক্রান্তের খবর আসছে। সরকার তাপমাত্রা মাপার জন্য যে চেকপয়েন্টগুলো স্থাপন করেছিল, সেগুলো চলছে। প্রযুক্তির মাধ্যমে নজরদারি অব্যাহত থাকছে। যার মাধ্যমে জনগণের যাতায়াত অনুসরণ করা যাচ্ছে - এমনকি বড় শহরের রাস্তাঘাটগুলোয় এখনো ভিড় নেই।

নতুন করে প্রাদুর্ভাবের ঝুঁকি রয়েই গেছে। সে কারণেই চীনা কর্তৃপক্ষ সে দেশে ভ্রমণে আসা মানুষের জন্য নতুন করে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে - ঠিক যেমন অন্যান্য দেশ একসময় চীনাদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করেছিল। এসবই করা হচ্ছে যেন ভাইরাসটি চীনে আর না প্রবেশ করতে পারে এবং আবারও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে না পড়ে।

‘আমরা এখনো জানি না চীনে ব্যবস্থাগুলো কতটা কার্যকর হলো,’ বলেন রিভার্স।

প্রথমে যে দেশগুলো আক্রান্ত হয়েছিল সেগুলোয় দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফা সংক্রমণের ধাক্কা লেগেছে, আমরা দেখেছি। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বলেন বিশ্বের ৪০ থেকে ৭০ ভাগ মানুষ এই ভাইরাসে সংক্রমিত হবে।

তাই হয়তো যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্তের সংখ্যা সর্বোচ্চে পৌঁছানোর পর মার্কিনদের বেশ কিছু নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে - যেমন সংক্রমিত ব্যক্তিকে আলাদা রাখা, বারবার হাত ধোয়া, একটা পর্যায় পর্যন্ত সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। অন্তত যত দিন কোনো ভ্যাকসিন না আবিষ্কার হচ্ছে এ নিয়মকানুনগুলো অনুসরণ করা ছাড়া উপায় নেই। ভ্যাকসিন আসতে হয়তো ১২ থেকে ১৮ মাস পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে।

ভাইরাসের চরিত্র এখনো অজানা

অনেকে আশা করছেন, করোনাভাইরাস (কোভিড ১৯) অন্য ফ্লু-র মতো মৌসুম বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে স্বভাবও বদলাবে। যেমন বসন্ত ও গ্রীষ্মে তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফ্লু-র প্রকোপ কমে যায়। যদি তা-ই হয়, মার্কিনরা এই কঠোর ব্যবস্থা থেকে মুক্তি পেতে পারে। কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পর্কে ভাবার সুযোগ পাবে। দেখা গেল, শরৎ এবং শীতে দুই দফা সংক্রমণের ধাক্কাতেই এ ব্যবস্থা কাবু হয়ে পড়েছে।

আরও যে বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে তা হলো, বিজ্ঞানীরা জানেন না কোভিড-১৯ সংক্রমণে টিকে গেলেও এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার ওপর কতটা কি প্রভাব ফেলবে। সম্ভাব্য কিছু সংক্রমণের খবর আসছে, কিন্তু অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন হয়তো পরীক্ষার ভুল অথবা রোগীর শরীরে আবারও ভাইরাসের আক্রমণ - হয়তো ওই রোগী পুরোপুরি সংক্রমণ থেকে সেরে ওঠেননি।

যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ কতটা করতে ইচ্ছুক, কত দিন

জনগণ অন্যের জীবন রক্ষায় কত দিন তাঁদের ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে থাকতে পারবেন তার ওপর নির্ভর করছে সংক্রমণের ঝুঁকি যুক্তরাষ্ট্র কতটা কমাতে পারল। যুক্তরাজ্যের কথা উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়। গত সপ্তাহে দেশটির নেতারা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, বড় সমাগমে নিষেধাজ্ঞা এবং স্কুল বন্ধের মতো সিদ্ধান্তগুলো থেকে পিছিয়ে আসে। তাঁদের আশঙ্কা দ্রুতই দেশটির নাগরিকেরা এতে বিরক্ত হয়ে উঠবে।
‘আপনি যদি খুব দ্রুত এই ব্যবস্থায় যান, মানুষ ক্লান্ত হয়ে যাবে,’ যুক্তরাজ্যের চিকিৎসা কর্মকর্তা ক্রিস হুইটি বৃহস্পতিবার বলেন। এই সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেছেন করেছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। দু শর মতো বিজ্ঞানী ও চিকিৎসা কর্মকর্তা এই পরিকল্পনার সমালোচনা করে খোলা চিঠি লিখেছেন। এপিডেমিওলোজিকাল গবেষণা বলছে, যত দ্রুত এ ধরনের ব্যবস্থায় যাওয়া যাবে, তত দ্রুত এর ফল পাওয়া যাবে।

প্রতীকী ছবি (রয়টার্স)
প্রতীকী ছবি (রয়টার্স)

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখন ব্যবস্থা নেওয়ার পর, বিশেষজ্ঞরা বলছেন হাসপাতালের বিছানা ও ভেন্টিলেটর সংকট দেখা দিয়েছে। তাঁরা এখন চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন বেছে বেছে। বিবেচনা করা হচ্ছে, কোন রোগীদের বাঁচানোর চেষ্টা করা হবে আর কাদেরকে মরতে দেওয়া হবে।
‘আমি জানি না, মানুষের প্রস্তুতি কতটা। কত দিন তাদের এই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। কিন্তু তারা তো দেখছে হাসপাতালের পরিস্থিতি কেবল খারাপই হচ্ছে, আমার মনে হয় দৃষ্টিভঙ্গির বদল হবে,’ ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডার বায়োস্ট্যাটিস্টিশিয়ান নাটালি ডিন বলেন। তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে করোনা ভাইরাস ভ্যাকসিনের মূল্যায়ন ও এ সম্পর্কিত অন্যান্য প্রকল্পের সঙ্গে কাজ করছেন।

রোববার রাতে ডিন যখন একজন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন তাঁর সঙ্গে তাঁর দুই সন্তান। বড়টি চিৎকার করে মায়ের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছিল।
‘এটা খুবই ক্লান্তিকর। অনেক পরিবারের জন্যই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নেওয়াটা কঠিন। আর কত দিন এটা বলার সময় এখনো আসেনি। পরিস্থিতিটা এমন, আপনার বাড়ি আগুনে পুড়ে যাচ্ছে, কিন্তু আপনি ফায়ার সার্ভিসের লোকজনকে জিজ্ঞাসা করছেন কখন আপনি বাসায় ফিরতে পারবেন।’