করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন মিলবে?
নতুন করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বব্যাপী। চীনের বাইরে বিভিন্ন দেশে এই ভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। নতুন করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরির জন্য এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে কর্মযজ্ঞ। কিন্তু আদৌ কি এর কার্যকর ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে? কবে মিলবে এই ভ্যাকসিন?
পৃথিবীতে যেকোনো রোগের ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়ে থাকে। অতীতে এমনটাই দেখা গেছে। কিছু ক্ষেত্রে লেগে গেছে দশকের পর দশক। ঠিক এই কারণেই নতুন করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরি প্রসঙ্গে ওপরের দুটি প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে ইবোলা ভ্যাকসিনের কথা একটু মনে করিয়ে দিই। ১৯৭৬ সাল থেকে এই রোগের বিষয়ে স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন সংস্থা ও বিজ্ঞানীরা ওয়াকিবহাল। ২০১৪ সালে এই রোগ পশ্চিম আফ্রিকায় মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে এবং অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয়। মহামারি চলার সময় থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন বায়োটেক প্রতিষ্ঠান ইবোলার ভ্যাকসিন তৈরির জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। দীর্ঘদিনের চেষ্টার পর অবশেষে ২০১৯ সালের নভেম্বরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) ইবোলার একটি পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিনকে ব্যবহারের উপযোগী বলে স্বীকৃতি দিয়েছে।
ইবোলার অভিজ্ঞতা মাথায় নিয়ে বলতে হয়, নতুন করোনাভাইরাসের কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরি করাও হবে সময়সাপেক্ষ। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অন্যবারের তুলনায় এবার সংশ্লিষ্ট সব দেশ ও সংস্থা খুব ত্বরিত পদক্ষেপ নিয়েছে। চীনের হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহানে গত ডিসেম্বরে প্রথম এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এরপর তা ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য দেশে। এরই মধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত মানুষের সংখ্যা ৭০০ ছাড়িয়েছে। এ হিসাবে নতুন করোনাভাইরাস গত এক দশক আগে চীন ও হংকংয়ে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়া সার্স ভাইরাসে মৃত মানুষের সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে গেল। অবশ্য এবার আর আগের মতো সবকিছু লুকানোর চেষ্টা করেনি চীন। বরং নতুন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার দিন দশেকের মধ্যেই করোনাভাইরাসটির জিনেটিক সিকোয়েন্স পুরো বিশ্বের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছে দেশটি। গত জানুয়ারি মাসের শেষভাগেই ওই জিনেটিক সিকোয়েন্স নিয়ে বিভিন্ন সংস্থা ও দেশ কাজ শুরু করে দিয়েছে। তবে এত কর্মতৎপরতার পরও, কমপক্ষে এক বছরের আগে নতুন করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরির আশা দেখছেন না সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
মূলত ভ্যাকসিন তৈরির পুরো প্রক্রিয়াটিই অত্যন্ত জটিল ও সময়সাপেক্ষ। নানান ধাপ পেরিয়ে ধীরে ধীরে একটি ভ্যাকসিন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। এসব ধাপের মধ্যে রয়েছে ভ্যাকসিন আবিষ্কার থেকে শুরু করে প্রাণীর দেহে তার সফল পরীক্ষা পর্যন্ত একটি বিশাল চক্র। ধাপে ধাপে আছে অনুমোদন পাওয়ার মতো কঠোর নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা। সব পার হওয়ার পর থাকছে তৈরি করা ভ্যাকসিন বাজারজাত করা ও তৃণমূল পর্যায়ে সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছে দেওয়ার বিষয়টিও। এসব প্রক্রিয়া পার হতেই লেগে যেতে পারে বছরের পর বছর। ইউনিভার্সিটি অব লিডসের অধ্যাপক নিকোলা স্টোনহাউস বলছেন, চিরাচরিতভাবে একটি রোগের ভ্যাকসিন তৈরি এবং তা বাজারজাত করতে ১০ বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কয়েক দশকও প্রয়োজন হতে পারে।
ভ্যাকসিন যেভাবে মেলে
নতুন করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে কোয়ালিশন ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশন (সিইপিআই)। ইবোলা মহামারির কারণে ২০১৭ সালে এই গোষ্ঠীটি গঠন করা হয়। এর কাজ হলো, ভবিষ্যতের বিভিন্ন রোগের কথা চিন্তা করে প্রস্তুতি নেওয়া এবং এ ধরনের রোগের মহামারি ঠেকানো। এটি এমন এক ধরনের সর্বজনীন ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যা বেশ কিছুসংখ্যক প্যাথোজেনের (ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়ার মতো মাইক্রোঅরগানিজম, যেগুলো রোগের কারণ) বিরুদ্ধে কর্মক্ষম থাকবে। এই প্রক্রিয়াতেই নতুন করোনাভাইরাসের জিনেটিক সিকোয়েন্স নিয়ে গবেষণা করে একটি কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরির চেষ্টা করছে সিইপিআই। তবে সফলতা পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা দিচ্ছে না তারা।
একটি ভয়ংকর ভাইরাস নিয়ে কাজ করা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। এ জন্য বিশেষ সংরক্ষণমূলক ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়। জিন সিকোয়েন্স ভ্যাকসিন তৈরির ধাপগুলোকে সহজ করে দেয়। তখন আসল ভাইরাসের সিনথেটিক মডেল তৈরি করে নিরাপদে গবেষণা চালাতে পারেন গবেষকেরা। এর আগে বিশ্বে দেখা দেওয়া সার্স-মার্সও এক ধরনের করোনাভাইরাস। চলতি মাসে উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজির এক গবেষণায় দেখা গেছে, সার্সের সঙ্গে নতুন করোনাভাইরাসের মিল প্রায় ৮০ শতাংশ। নতুন ভাইরাসের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিন তৈরিতে যে পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে, সেই পদ্ধতিতেই সার্স ও মার্সের ক্ষেত্রে সফলতা পাওয়া গিয়েছিল।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, যখন ল্যাবরেটরিতে একটি ভ্যাকসিন প্রাথমিকভাবে তৈরি করা হয়, তখন তা ওষুধের কারখানায় পাঠানো হয়। সেখানে আরেক ধাপে পরীক্ষা করে দেখা হয়, ওই ভ্যাকসিন দূষণমুক্ত ও প্রাণিদেহে প্রয়োগের উপযুক্ত কি না। এর জন্য কয়েক মাস সময় লেগে যেতে পারে।
এরপর প্রয়োজনীয় অনুমোদন পেলে ওই উপযুক্ত ভ্যাকসিন প্রাণিদেহে পরীক্ষামূলকভাবে প্রয়োগ করা হয়। সাধারণত এ ক্ষেত্রে তিন মাসের মতো সময় প্রয়োজন হয়।
ধরা যাক, ভ্যাকসিনটি তৈরি হয়ে গেল এবং প্রয়োজনীয় সব অনুমোদনও পেল। কিন্তু এরপর সেই ভ্যাকসিনটির ব্যাপক উৎপাদন ও মহামারি ঠেকাতে তার ব্যবহার অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের। প্রচুর পরিমাণে ভ্যাকসিন তৈরির জন্য বিশাল কারখানার প্রয়োজন হয়। অন্যদিকে ব্যাপক হারে ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিনের দামও নাগালের মধ্যে রাখার বাধ্যবাধকতা থাকে। যদিও এ ধরনের ভ্যাকসিনের উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারলে, তা যেকোনো ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য সুনাম বয়ে আনে। কিন্তু এ ধরনের ভ্যাকসিন উৎপাদনে লাভের অঙ্ক খুব কম থাকে। আবার প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন এবং তা আক্রান্ত সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছে দেওয়া এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। অনেক ক্ষেত্রে এতে রাজনীতিও ঢুকে পড়ে এবং বিভিন্ন দেশের সরকার তাতে নাক গলানোর চেষ্টা করে থাকে। ফলে রোগ ঠেকানো ও মানুষের জীবন বাঁচানো কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়ে।
বর্তমান পরিস্থিতি কী?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে বিশ্ব খুব দ্রুত সাড়া দিয়েছে। চীন প্রায় ৫ কোটি মানুষকে কোয়ারেন্টাইন করে রোগের বিস্তার রোধ করার চেষ্টা করছে। তার পরও প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এতে আক্রান্ত হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, আক্রান্ত মানুষের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক যে হিসাব পাওয়া যাচ্ছে, তা পুরো চিত্র নয়। বিভিন্ন গাণিতিক হিসাবে আক্রান্তের সংখ্যা আনুষ্ঠানিক সংখ্যার ১০ গুণ বলে অনুমান করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, প্রতি ৫ থেকে ৭ দিনে এই সংখ্যা দ্বিগুণ হচ্ছে।
তবে হ্যাঁ, নতুন করোনাভাইরাসে মৃতের হার এখনো পর্যন্ত শতাংশের হিসাবে কিছুটা কম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, আক্রান্ত মানুষের মধ্যে ৩ শতাংশের অবস্থা সংকটাপন্ন। প্রায় ৮২ শতাংশ মানুষই নতুন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছে স্বল্প মাত্রায়।
বর্তমানে বেশ কটি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান নতুন করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরিতে শ্রম দিচ্ছে। যেমন: জনসন অ্যান্ড জনসন বলছে, ৮ থেকে ১২ মাসের মধ্যে এমন ভ্যাকসিন তারা তৈরি করতে পারে। চীনভিত্তিক ক্লোভার বায়োফার্মাসিউটিকালস বলছে, অচিরেই তারা একটি ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক ব্যবহার শুরু করতে চায়। অন্যদিকে নোভাভ্যাক্স ও ইনোভিও ফার্মাসিউটিক্যালস নিশ্চিত করেছে যে, নতুন করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন তৈরিতে তারা কাজ শুরু করেছে। তবে কবে নাগাদ সেই ভ্যাকসিন বাজারে আসবে, সেই সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। আবার চীনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজ শুরু করা ‘গিলিয়াড’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, ইবোলা ঠেকাতে তৈরি করা তাদের একটি ওষুধ নতুন করোনাভাইরাস ঠেকাতে কার্যকর হতে পারে বলে প্রমাণ মিলেছে। এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে আগ্রহী গিলিয়াড।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন ভ্যাকসিন তৈরি হয়ে গেলেও, তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিরূপণের জন্য আলাদাভাবে গবেষণার প্রয়োজন হবে। কারণ নতুন এসব ভ্যাকসিন পরীক্ষাগারে কার্যকর প্রমাণিত হলেও মানবদেহে তা কেমন প্রভাব রাখবে, তা আগে থেকে আঁচ করা সম্ভব নয়। তাই মানবদেহে প্রয়োগের জন্য একটি ভ্যাকসিনকে নিরাপদ ঘোষণার জন্য ঢের সময়ের প্রয়োজন।
তাহলে কী হবে?
বাস্তবতা হলো, নতুন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে এবং এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। কিন্তু রাতারাতি ভ্যাকসিন বানিয়ে এই সংকট সামাল দেওয়া যাবে না। এর বদলে পূর্বসতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া এবং আক্রান্ত মানুষের দেহ থেকে ভাইরাস অন্যদের দেহে ছড়ানো প্রতিরোধের ওপরই জোর দিচ্ছেন গবেষকেরা। তাঁরা বলছেন, ভ্যাকসিন বানানোর যে কর্মপ্রক্রিয়া পুরো দমে শুরু হয়েছে, তাতে তাৎক্ষণিক সুফল পাওয়া যাবে না। তবে এর ফলাফল দীর্ঘ মেয়াদে মানুষের উপকারে আসবে। এর ফলে ভবিষ্যতে নতুন নতুন রোগ ঠেকানো সহজ হবে। কারণ তাড়াহুড়ো করে তৈরি কোনো অনিরাপদ ভ্যাকসিন মানুষের আস্থার জায়গাটি নষ্ট করে দিতে পারে, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় প্রাণহানিও বাড়তে পারে। তাই এ ক্ষেত্রে ধীরে চলাই উত্তম।
তথ্যসূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট, ওয়্যারড, আল-জাজিরা, বিবিসি, এএফপি ও রয়টার্স