মাথার চুল বেচে সন্তানদের মুখে আহার জোটালেন তিনি

তিন সন্তানের সঙ্গে প্রেমা সেলভাম। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
তিন সন্তানের সঙ্গে প্রেমা সেলভাম। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

পাঠ্যবইয়ে থাকার সুবাদে এ দেশের একটি প্রজন্মের কাছে মার্কিন লেখক ও হেনরির ‘গিফট অব দ্য ম্যাজাই’ গল্পটির পরিচিতি রয়েছে ব্যাপক। জিম ও ডেলা নামের স্বল্প আয়ে সংসার চালানো এক দম্পতির বড়দিনের উপহারকে কেন্দ্র করে নিঃস্বার্থ আবেগ-ভালোবাসা উঠে এসেছে গল্পে। ১৯০৫ সালে প্রথম প্রকাশিত গল্পটিতে দেখানো হয়েছে, লম্বা চুলের ডেলা ২০ ডলারে তাঁর চুল বিক্রি করে স্বামী জিমের ঘড়ির জন্য সোনার পকেট চেন কিনেছেন।

অন্যদিকে জিম তাঁর ঘড়ি বিক্রি করে ডেলার দিঘল চুলের জন্য কিনেছেন দামি চিরুনি সেট। বড়দিনে তাঁরা পরস্পরকে উপহার দিতে গিয়ে বিস্মিত হয়ে পড়েন, দুটি উপহারের কোনোটিই তাঁদের কোনো কাজে আসছে না। কারণ ডেলার চুল ছোট হয়ে গেছে। আর জিমের ঘড়িটি নেই। তবে এই উপহারের মাধ্যমে পরস্পরের প্রতি তাঁদের প্রচণ্ড ভালোবাসা প্রকাশ পেয়েছে।

ডেলার সঙ্গে এ সময়ের প্রেমা সেলভামের ঘটনার মিল রয়েছে। ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের রাজ্য তামিলনাড়ুর প্রেমাও ডেলার মতো প্রিয়জনের জন্য চুল বিক্রি করেছিলেন। তবে সেটা উপহার কেনার জন্য নয়, প্রিয় সন্তানদের মুখে খাবার তুলে দিতে। স্বামীর মৃত্যুর পর চরম কষ্টের একদিনে ছোট ছোট তিন সন্তানের জন্য খাবার কিনতে ১৫০ রুপিতে নিজের মাথার চুল বিক্রি করেছিলেন প্রেমা সেলভাম। এখানেও সেই নিঃস্বার্থ ভালোবাসারই জয়। এটি সন্তানের প্রতি মায়ের চিরন্তন ভালোবাসা।

প্রেমার স্বামীর মৃত্যুও স্বাভাবিক ছিল না। ঋণের চাপে জর্জরিত স্বামী নিজের স্বপ্ন পূরণের ব্যর্থতা থেকে হতাশায় আত্মহত্যা করেন। হাতাশায় ডুবে স্বামী জীবনকে বিদায় জানালেও সন্তানদের জন্য এখনো আশা নিয়ে বাঁচেন প্রেমা।

চুল বিক্রি করে দেওয়ার পর বিক্রি করার জন্য আর কিছু রইল না প্রেমার হাতে। পাওনাদারদের অর্থ পরিশোধের পথ নেই। সন্তানদের মুখে খাবার দেওয়ার অর্থও নেই। তবে এরপর যা ঘটল তা সারা ভারতের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক।

স্বামীর মৃত্যুর আগে তাঁরা দুজনেই তামিলনাড়ুর একটি ইটভাটায় কাজ করতেন। ওই আয়ে দুজনের নতুন সংসার চলে যাচ্ছিল। তবে তাঁরা আরও ভালো কিছুর স্বপ্ন দেখেছিলেন। প্রেমার স্বামী নিজের একটি ইটভাটা করার জন্য বড় অঙ্কের ঋণ নেন। তবে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হন। সেই হতাশা থেকে একদিন স্বামী আত্মহত্যা করেন। আর প্রচণ্ড চাপে পড়েন প্রেমা। তাঁকে শুধু তিন সন্তানসহ নিজের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হচ্ছে না, সেই সঙ্গে পাওনাদারদের অর্থ পরিশোধের চাপেও পড়তে হয়েছে। একপর্যায়ে দুই শিশু সন্তানকেও নিজের সঙ্গে কাজে ঢুকিয়ে দেন তিনি।

বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রেমা বলেন, ‘কাজে গেলে আমি দিনে ২০০ রুপি করে পাই, তা দিয়ে সংসার চলে যেত।’ কিন্তু তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় এই পরিমাণ আয়ও করতে পারছিলেন না। তিনি বলেন, ‘আমি ইটের ভার বহন করতে পারতাম না। জ্বরে আক্রান্ত হয়ে বাড়িতেই থাকতে হতো বেশির ভাগ সময়।’

একবার তিনি তিন মাস অসুস্থ ছিলেন। দেনা জমে যাচ্ছিল, একই সঙ্গে খাবারের পাত্র শূন্য থাকত। তেমনই একদিনের কথা বলতে গিয়ে প্রেমা বলেন, ‘আমার সাত বছরের ছেলে কালিয়াপ্পান স্কুল থেকে ফিরে খাবার চাইল। খাবার না পেয়ে সে ক্ষুধায় কান্না শুরু করল।’

প্রেমার কোনো সম্পদ, গয়না বা মূল্যবান কোনো তৈজস ছিল না, যার বিনিময়ে অর্থ পেতে পারেন। প্রেমা বলেন, ‘আমার কাছে ১০ রুপি ছিল না। শুধু কিছু প্লাস্টিকের ঝুড়ি ছিল।’ হঠাৎ তিনি উপলব্ধি করলেন, তাঁর কাছে একটি জিনিস আছে, যা তিনি বিক্রি করতে পারেন।

প্রেমা বলেন, ‘একটি দোকানের কথা মনে আসে, যারা চুল কিনত। আমি সেখানে যাই এবং মাথার পুরো চুল ১৫০ রুপিতে বিক্রি করে দিই।’

শুনতে এটা সামান্য অর্থ হলেও ওই সময় এটা অনেক বড় কিছু হয়ে দাঁড়িয়েছিল প্রেমার জন্য। বড় শহরে ওই অর্থে একবেলা দুপুরের খাবার রেস্টুরেন্ট থেকে কেনা যায়। তবে প্রেমার গ্রামে তার চেয়েও বেশি কিছু কিনতে পেরেছিলেন তিনি। বললেন, ‘আমি তিন প্যাকেট ভাত কিনেছিলাম ২০ রুপি দিয়ে আমার তিন সন্তানের জন্য। কিন্তু ওটা তো এক দিনের ব্যবস্থা হলো। এরপর?’
প্রেমা জানতেন, তাঁর হাতে এখন আর কোনো উপায় নেই। এই ভাবনা তাঁকে বিপর্যস্ত করে তুলল। তিনি আর থাকতে পারলেন না। নিজের জীবন শেষ করার জন্য একটি দোকানে কিছু কিনতে গেলেন। কিন্তু তাঁর বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে দোকানদার হয়তো বুঝতে পারলেন, তিনি তাঁর কাছে কিছু বিক্রি করলেন না। প্রেমা বাড়ি ফিরে এসে অন্য কোনো উপায়ে প্রাণনাশের সিদ্ধান্ত নিলেন। সেদিন তাঁর বোন এসে তাঁকে রক্ষা করেন।

এর কয়দিন পর যে সাহায্য তাঁর দরকার ছিল, তা অপ্রত্যাশিতভাবে তাঁর কাছে এসে হাজির হলো।

প্রেমা সেলভাম ও তাঁর সন্তানদের সাহায্য এগিয়ে আসেন বালা মুরুগান। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে
প্রেমা সেলভাম ও তাঁর সন্তানদের সাহায্য এগিয়ে আসেন বালা মুরুগান। ছবি: বিবিসির সৌজন্যে

বালা মুরুগান নামের এক ব্যক্তি স্থানীয় এক ইটভাটার মালিকবন্ধুর কাছে প্রেমার অবস্থা সম্পর্কে জানতে পেরেছিলেন। সব শুনে তিনি প্রচণ্ড ধাক্কা খান। তাঁর পরিবারের কঠিন সময়ের কথা মনে পড়ে যায়। বালা জানেন কীভাবে দারিদ্র্য মানুষকে বেপরোয়া করে তোলে। তাঁর বয়স যখন ১০ বছর, তখন তাঁর পরিবারে কোনো খাবার ছিল না। তাঁর মা পুরোনো বই আর সংবাদপত্রের বিনিময়ে চাল কিনেছিলেন। এমনই এক হতাশার দিনে বালার মা নিজেকে ও সন্তানদের হত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। শেষ সময়ে তিনি তাঁর তাঁর সিদ্ধান্ত পাল্টান। তাঁকে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নেওয়া হলে প্রাণে বেঁচে যান। যে পরিস্থিতির মধ্যে বালা বড় হয়েছিলেন, তা থেকে এখন তাঁর বাস অন্য জগতে। বছরের পর বছর লড়াইয়ের পর তিনি দারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন। এখন তিনি একটি কম্পিউটার গ্রাফিকস সেন্টারের মালিক।

এখন তিনি অন্যদেরও ভাগ্য পরিবর্তনে এগিয়ে আসেন। বালা প্রেমার সঙ্গে দেখা করে নিজের কাহিনি শুনিয়ে আশা জাগালেন। বন্ধু প্রভুকে সঙ্গে নিয়ে প্রেমার জন্য কিছু খাবার কিনে দিলেন। এরপর বালা প্রেমার কথা লিখলেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এবং ব্যাপক সাড়া পেলেন।

বালা বলেন, ‘একদিনে আমি ১ লাখ ২০ হাজার রুপি সাহায্য পেয়েছি। আমি যখন প্রেমাকে তা জানালাম, তিনি এত খুশি হলেন। বললেন, এই অর্থে তাঁর বেশির ভাগ ঋণ পরিশোধ হয়ে যাবে।’ এরপর প্রেমার অনুরোধেই তিনি তহবিল তোলা বন্ধ করেন। বালা বলেন, প্রেমা বললেন, ‘তিনি কাজে ফিরে যেতে পারবেন এবং বাকি ঋণ পরিশোধ করতে পারবেন।’

প্রেমা এখন পাওনাদারদের মাসে ৭০০ রুপি করে শোধ দিতে পারেন। এর মধ্যে জেলা কর্তৃপক্ষ প্রেমাকে দুধের ডিলারশিপের ব্যবস্থা করে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে। প্রেমা ধীরে ধীরে নিজ পায়ে উঠে দাঁড়াচ্ছেন। তবে দুঃখজনক যে, ভারতে প্রেমার ঘটনা একক কোনো ঘটনা নয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও প্রেমার মতো লাখ লাখ দরিদ্র ভারতীয়কে খাবার জোগাড়ে লড়াই করতে হয়। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে, চরম দারিদ্র্যে বসবাসকারী লোকজনের ক্ষেত্রে বিশ্বে ভারতের অবস্থান দ্বিতীয়। দিনে ১.৯০ ডলার আয় করা মানুষকে এই শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে।

প্রেমার সংগ্রামের পথে আরও একটি বড় বাধা হচ্ছে, তিনি লিখতে-পড়তে পারেন না। ফলে তাঁর মতো দরিদ্রদের জন্য সরকারি স্কিমের বিষয়টি সম্পর্কেও সচেতন ছিলেন না। দেশটির প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংকিং পদ্ধতি এমন সব নিয়ম বানিয়ে রেখেছে, যার ফলে দরিদ্র মানুষের পক্ষে কম সুদে ঋণ পাওয়া কঠিন। এ কারণে প্রেমা ও তাঁর স্বামী প্রতিবেশী এবং স্থানীয় ঋণদাতাদের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়েছিলেন, যা তাঁদের আরও বেশি ঋণের চক্রে ফেলে।

তবে ঋণের সেই ফাঁদ থেকে বের হতে সাহায্য করায় প্রেমা বালা মুরুগানের মতো মানুষদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। বালা আশ্বাস দিয়েছেন, প্রেমার পরিবারের প্রতি তাঁর সাহায্য অব্যাহত থাকবে।
নতুন জীবনে উজ্জীবিত প্রেমা বলেন, ‘এখন আমি উপলব্ধি করি যে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত ছিল ভুল। এখন আমি বাকি ঋণ পরিশোধে আত্মবিশ্বাসী।’