বিশ্লেষণ: কাসেম সোলাইমানির বিকল্প পাওয়া ইরানের জন্য কঠিন হবে

মেজর জেনারেল কাসেম সোলাইমানি। ছবি: এএফপি
মেজর জেনারেল কাসেম সোলাইমানি। ছবি: এএফপি


তেলের দাম বাড়তে শুরু করেছে
ইরান তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এক সন্তানকে হারাল। নিঃসন্দেহে এটা এক বড় যুদ্ধের শুরু মাত্র। ইরানের কাছে সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লা আলী খামেনির কাছেও জেনারেল কাসেম সোলাইমানি তেমনি প্রিয়তমদের একজন। আর শুক্রবার সকালকে এই হত্যার জন্য বেছে নেওয়াটাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

ট্রাম্পের জন্য নির্বাচনে জিততে এ রকম বড় কোনো পদক্ষেপ প্রয়োজন ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক টিভি চ্যানেলেই প্রাথমিকভাবে এই ঘটনাকে ইতিবাচক এক অভিযান হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনে এ ধরনের আক্রমণকে ‘সন্ত্রাস’ হিসেবে চিহ্নিত হলেও টুইটার-প্রেমী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজে এই ঘটনা শেষে মার্কিন পতাকার ছবি দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘পোস্ট’ দিয়ে দেশের ভেতর জাতীয়তাবাদী শ্লাঘা জাগিয়ে তুলতে দেরি করেননি।

শেষ বিচারে এতে বিশেষভাবে উল্লসিত হবে ইসরায়েল, আইএস ও সৌদি আরব। এই তিন শক্তির কাছে জেনারেল সোলাইমানি ছিলেন সরাসরি প্রধান প্রতিপক্ষ। তবে নিশ্চিতভাবে মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় সব দেশ এই ঘটনায় আক্রান্ত হবে। পুরো অঞ্চলে ছদ্মযুদ্ধের একটা অধ্যায় শেষ হয়ে নতুন পর্যায় শুরু হলো। সবাই আপাতত তাকিয়ে থাকবে ইরানের পরবর্তী পদক্ষেপের দিকে এবং দেখতে চাইবে ইরান এখন কী করে!

জ্বালানি তেলের দাম ইতিমধ্যে বাড়তে শুরু করে দিয়েছে। বিশ্ব তেলের বাজারের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ এলাকা হাজি কাসেমের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যুদ্ধ পরিস্থিতির ভেতরে পড়ে গেল।

ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড। ছবি: এএফপি
ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড। ছবি: এএফপি


ইরান-যুক্তরাষ্ট্র আলাপ-আলোচনার আর সুযোগ থাকছে না
ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডের ‘কুদস ফোর্স’ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ‘সন্ত্রাসী সংগঠন’ হলেও এর প্রধান জেনারেল সোলাইমানি ইরানিদের অত্যন্ত প্রিয় এক মানুষ, যাঁকে তারা ‘হাজি কাসেম’ বলতে অভ্যস্ত। মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়ায় ইরানের প্রভাব বৃদ্ধিতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরানের জন্য তিনি ছিলেন বর্শার সূচ্যগ্রের মতো। ইরানের ইতিহাসে সবচেয়ে মেধাবী এক সমরবিদ হিসেবে গণ্য করা হয় তাঁকে। আন্তর্জাতিক কোনো সন্ত্রাসী হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মারা গেলে ওয়াশিংটনে যে অনুভূতি হতো, ইরানের কাছে সোলাইমানির মৃত্যুও সে রকম কিছু।

স্বভাবত এই খুনের প্রথম ফল হবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের বহুদিনের জন্য আর আলাপ-আলোচনার আর কোনো সুযোগ থাকল না। পাশাপাশি ইরানের সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্কেরও চরম অবনতি ঘটবে। এ ছাড়া এর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ঘটবে ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, লেবানন, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে। ফলে হাজি কাসেমের মৃত্যু আসলে আন্তর্জাতিক এক যুদ্ধের ঘোষণা মাত্র বলা যায়। যে যুদ্ধ দীর্ঘদিন ধরে গোপনে চলছিল সেটা এবার প্রকাশ্য হয়ে গেল।

ইরানের প্রচারমাধ্যম শুরু থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে এর নির্দেশদাতা হিসেবে উল্লেখ করছে। এর মানে হলো, দেশটিতে রাজনৈতিক সংস্কারপন্থী এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার পক্ষাবলম্বনকারীদের আপাতত বিদায় ঘটল।

ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। ছবি: এএফপি
ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি। ছবি: এএফপি


আইএসের জন্য বিরাট স্বস্তি
হাজি কাসেমের মৃত্যুতে সবচেয়ে ক্ষতি হবে ইরাকের। যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলায় কাসেমের সঙ্গে ইরাকের ‘পপুলার মবিলাইজেশন ইউনিট’-এর দ্বিতীয় প্রধান কমান্ডার আবু মাহদিও মারা গেছেন। পপুলার মবিলাইজেশন হলো সিরিয়া ও ইরাকে গত কয়েক বছর আইএসবিরোধী যুদ্ধের প্রধান সামরিক শক্তি। ফলে এই দুজনের নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়া ইরাকে আইএসকে বড় স্বস্তি এনে দেবে। একই সঙ্গে ইরাকে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার আরও অবনতি ঘটাবে এই ঘটনা। এ ধরনের নৈরাজ্যকর অবস্থায় আধা-বিধ্বস্ত দশায় থাকা আইএস আবারও পুনর্গঠিত হওয়ার সুযোগ পেয়ে যেতে পারে। ইতিমধ্যে ইরাকের আনবারসহ একাধিক স্থানে এবং সিরিয়াতেও পপুলার মবিলাইজেশনের একাধিক গ্যারিসনে মার্কিন বিমান হামলার খবর পাওয়া গেছে, যা আইএসের জন্য বিরাট এক প্রাপ্তি।

হামাস ও হিজবুল্লাহর জন্য বড় আঘাত 
আপাতত ইরাকে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে পাল্টাপাল্টি হামলাকে জেনারেল সোলাইমানির মৃত্যুর তাৎক্ষণিক কারণ বলা হলেও প্রয়াত জেনারেল বহুদিন থেকে ওয়াশিংটন ও তেল আবিবের টার্গেট হয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র কেন তাঁকে হত্যা করেছে না, এটা বহুদিন থেকেই ওয়াশিংটনের প্রতি ইসরায়েলের বড় গোসসার বিষয় হয়েছিল। জেনারেল সোলাইমানি ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন ‘হামাস’ এবং লেবাননের হিজবুল্লাহর অন্যতম সামরিক পরামর্শদাতা ও অনুপ্রেরণার উৎস ছিলেন। ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধে এই দুই শক্তির সামরিক সরবরাহে ইতিমধ্যে টান পড়েছিল। এখন হাজি কাসেমের শারীরিক অনুপস্থিতি তাদের জন্য আরও বড় আঘাত হিসেবে কাজ করবে। ইসরায়েল তাৎক্ষণিকভাবে এই সুযোগ নিতে চাইবে এবং গাজা ও লেবাবনে তার প্রকাশ্য ও গোপন অভিযান বাড়াবে।

ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি। ছবি: এএফপি
ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি। ছবি: এএফপি


ইরান যুদ্ধ ছড়াবে বলে মনে হয় না
ইরানজুড়ে ক্ষোভের বিস্তার যত গভীরই হোক, জেনারেল সোলাইমানির বিকল্প খুঁজে পাওয়া ইরানের জন্য মোটেই সহজ হবে না। প্রয়াত এই জেনারেল ব্যতিক্রমী ছিলেন। ফলে তাঁর অনুপস্থিতি সিরিয়া ও ইরাকে তেহরানকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এ রকম অবস্থায় ইরান প্রতিশোধ হিসেবে এখনই যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের স্থাপনাগুলোতে হামলা চালাবে বলে মনে হয় না। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে এটা ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার চেয়েও বেশি কিছু। কিন্তু অর্থনৈতিক অবরোধের মাঝে তাদের কয়েকটি দেশজুড়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সামর্থ্যে ঘাটতি রয়েছে। আর এ রকম যুদ্ধে তাদের লড়তে হবে সৌদি আরব ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধেও। ফলে ইরান আপাতত কুদ্দস ফোর্সকে প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানেই রাখবে।

বাহিনীর দ্বিতীয় প্রধান ব্রিগেডিয়ার ইসমাইল ঘানিকে সামনে রেখেই আলী খামেনিকে জেনারেল সোলাইমানির কাছাকাছি কোনো অসাধারণ জেনারেলকে খুঁজে পেতে হবে আন্তর্জাতিক ছদ্মযুদ্ধে ইরানের অবস্থান ধরে রাখতে হলে। কিন্তু সেটা সময়সাপেক্ষই হবে। বরং ইরাককে নিজেদের প্রভাববলয় রক্ষাতেই ইরানকে বেশি মনোযোগী হতে হবে এখন। যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে যথার্থ হিসাব কষেই সঠিক সময়ে এই হামলা চালানো হয়েছে। তবে অঞ্চলজুড়ে তাদের মিত্রদের সঙ্গে ইরানের বৈরিতা আরও বাড়বে। এটা না বাড়িয়ে ইরানের নেতৃবৃন্দের উপায় নেই। নিজ দেশে তাদের নেতৃত্বের বৈধতা দেখানোর জন্যও সেটা করতেই হবে। এ ক্ষেত্রে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের বদলে ইরান ওয়াশিংটনের আঞ্চলিক মিত্রদের আগে দুর্বল করে নিতে চাইবে। বিশেষ করে ইয়েমেনে হুতিদের মাধ্যমে সৌদি আরবে আক্রমণ বাড়তে পারে ইরান।

তেহরান চাইবে তেলের দাম আরও বাড়ুক। হাজি কাসেমের মৃত্যু তাই সৌদি-ইরান সংঘাতকে আরও খারাপ দিকে টেনে নেবে। এই বিবেচনায় ৩ জানুয়ারি শুক্রবার সকালের বিমান হামলাটি সারা বিশ্বের শিল্প অর্থনীতির জন্যও বড় দুঃসংবাদ। অনেক দেশই এই হামলার পর তাদের জ্বালানি তেলের খরচ মেটাতে গিয়ে বিপদে পড়ে যাবে।