বদলে যাচ্ছে বৈশ্বিক মাদক বাণিজ্যের রুট
সারা বিশ্বেই মাদক এক বড় সমস্যা। মাদকের ধরনে ভিন্নতা থাকতে পারে, কিন্তু এর সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি তৈরিতে কোনো ভিন্নতা নেই। বাংলাদেশে ইয়াবার মতো মাদক যে সংকট তৈরি করছে, সেই একই সংকট যুক্তরাষ্ট্রে হয়তো তৈরি করছে ফেন্টানিল। উদাহরণ হিসেবে এ দুই দেশের কথা বলা হলেও, বিশ্বের প্রায় সব দেশ কম-বেশি এ সংকটে আক্রান্ত। এই মাদক বাণিজ্যের রাশ টেনে ধরতে বিভিন্ন দেশের উদ্যোগেরও খামতি নেই। কিন্তু কিছুতেই যেন কিছু হচ্ছে না। জাতীয়-আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপের বিপরীতে মাদক ব্যবসায়ীরাও প্রতিনিয়ত তাদের কৌশল বদল করে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক মাদক বাণিজ্যের রুটে আসছে বদল। এ ক্ষেত্রে সম্প্রতি পশ্চিম আফ্রিকা অঞ্চলের কথা আলোচনায় আসছে।
পশ্চিম আফ্রিকার দেশ গিনি-বিসাউ। গত ১ সেপ্টেম্বর দেশটির কানচুঙ্গো শহরের একটি ভদ্রস্থ বাংলো থেকে জব্দ করা হয় দেশটির ইতিহাসের অন্যতম বড় মাদক চালান। ওই দিন প্রায় ১ হাজার ৬৬০ কিলোগ্রাম কোকেন জব্দ করা হয়, যার মাধ্যমে ১০০ মিটার দীর্ঘ কোকেনের লাইন তৈরি করা সম্ভব। ওই বাংলোর নিকটবর্তী অন্য দুটি বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয় আরও ২৫০ কিলোগ্রাম মাদক। ওই অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয় তিনজন কলম্বিয়ান ও একজন মেক্সিকানসহ অনেককে। জব্দ করা হয় ১৮টি গাড়ি ও একটি স্পিডবোট। মাদকের ওই চালানটি মালির উদ্দেশ্যে যাত্রার অপেক্ষায় ছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মালি হয়ে ওই চালান পৌঁছাত ইউরোপে।
গিনি-বিসাউ হয়ে এত বড় মাদক চালান যাওয়া নিয়ে কেউ বিস্মিত হয়নি। পুলিশ চালানটি জব্দ করাতেই বরং বিস্ময়ের জন্ম হয়েছে। কারণ ২০০৫ সাল থেকেই দেশটির মধ্য দিয়ে বিপুল পরিমাণে মাদক চোরাচালান হয়। জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ সম্পর্কিত কার্যালয় অন্তত এক দশক আগে থেকে সতর্ক করে আসছে যে, দেশটি ‘নারকো-স্টেটে’ পরিণত হতে পারে। নারকো স্টেট বলতে মূলত মাদক বাণিজ্য ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত রাষ্ট্রকে বোঝায়।
কথা হচ্ছে গিনি-বিসাউ দিয়ে কী পরিমাণ মাদক চোরাচালান হয়। দেশটির রাজধানী বিসাউয়ে নিযুক্ত আন্তর্জাতিক কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট জানাচ্ছে, প্রতি বছর অন্তত ১০ টন কোকেন দেশটির মধ্য দিয়ে চোরাচালান হয়। ইউরোপের পথেঘাটে যে দামে এগুলো বিকোয়, সে দাম ধর্তব্যে নিলে যার অর্থমূল্য দাঁড়ায় প্রায় ১৩৫ কোটি ডলারে, যা গিনি-বিসাউয়ের মোট দেশজ উৎপাদন সমান।
>পশ্চিম আফ্রিকার গিনি-বিসাউই শুধু নয়, কোকেন বাণিজ্য ঘাঁটি গেড়েছে আরও বেশ কয়েকটি দেশে। গত ফেব্রুয়ারিতেই কেপ ভার্দের একটি জাহাজ থেকে নয় টন কোকেন জব্দ করা হয়। গত জুনে সেনেগালে ব্রাজিল থেকে আসা এক গাড়ি থেকে জব্দ করা হয় ৮০০ কেজি কোকেন
শুধু গিনি-বিসাউ নয়, পুরো পশ্চিম আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের মধ্যেই একটি সমান্তরাল অর্থনীতি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে মাদক বাণিজ্য। এই সমান্তরাল কাঠামো যেমন প্রশাসনিক দুর্নীতিকে আশ্রয় করে বিস্তার পাচ্ছে, ঠিক তেমনি এটি দুর্নীতি ও সহিংসতারও বিস্তার ঘটাচ্ছে। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, সারা বিশ্বে সরাসরি মাদক উৎপাদন ব্যাপকভাবে বেড়েছে। গত দশকে অর্থনৈতিক সংকট ও নানা ফ্রন্টে শুরু হওয়া যুদ্ধের বাস্তবতায় মাদক উৎপাদন কমে এলেও সম্প্রতি এটি আগের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। কলম্বিয়ায় ফার্ক গেরিলাদের সঙ্গে দেশটির সরকারের শান্তি চুক্তির পর কোকা চাষ বেড়েছে। অনেকগুলো গোষ্ঠী প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়ায় বেড়েছে এর দামও। ফলে এ আবাদ দিনদিন লাভজনক হওয়ায় কৃষকেরাও এর দিকে বেশি করে ঝুঁকছেন। একই অবস্থা আফগানিস্তানে। ২০১৪ সাল থেকে দেশটি থেকে ন্যাটো বাহিনী নিজেদের গুটিয়ে নিতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে বাড়তে থাকে আফিম চাষ। আর ‘এন্টারটেইনমেন্ট ড্রাগ’ হিসেবে পরিচিত বিভিন্ন কৃত্রিম মাদকের উৎপাদন সারা বিশ্বেই বেড়ে চলেছে।
ধনী দেশগুলোতে মাদকের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। গত কয়েক বছরে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবস্থাপত্রে উল্লিখিত ওষুধকে মাদক হিসেবে ব্যবহারের হার ভয়াবহ মাত্রায় বেড়েছে। ২০১৭ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন বিষয়টিকে স্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে বাধ্য হয়। কিন্তু তারপরও সামাল দেওয়া যায়নি। ২০১৮ সালেই দেশটিতে অতিমাত্রায় মাদক গ্রহণের ফলে ৭০ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে। এদের অধিকাংশই কিন্তু তরুণ। ব্রিটেনেও ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে মাদক গ্রহণের হার আগের তুলনায় বেড়েছে। এশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতেও কৃত্রিম মাদকের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।
প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত মাদকের অধিকাংশই আফগানিস্তান ও কলম্বিয়ার মতো দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপে চালান করা হয়। মাদক নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন দেশের প্রশাসন যত সক্রিয় হচ্ছে, মাদক চোরাচালানকারীরাও তত কৌশলী হয়ে উঠছে। ব্রিটেন, নেদারল্যান্ডসসহ বিভিন্ন দেশের প্রশাসন ক্যারিবীয় রুটের দিকে কড়া নজর রাখায়, চোরাচালানকারীরা তাদের রুট বদলে পশ্চিম আফ্রিকার দিকে সরে যাচ্ছে। মূলত দুর্বল ও দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোকেই তারা রুট হিসেবে বেছে নিচ্ছে। এতে করে ওই সব রাষ্ট্র আরও দুর্বল ও শেষতক দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অ্যাগেইনস্ট ট্রান্সন্যাশনাল অর্গানাইজড ক্রাইমের মার্ক শ বলেন, মাদকের ব্যাপ্তি বিশ্বের অন্য অঞ্চলের তুলনায় আফ্রিকার ওপর বেশি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এর কারণ, আফ্রিকান দেশগুলো তুলনামূলক বেশি ভঙ্গুর। চোরাচালানকারীরা তাই সহজেই এসব দেশের প্রশাসনের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে। একবার এটি করা গেলে সংশ্লিষ্ট দেশের প্রশাসনকে আরও দুর্বল করে ফেলার কাজটি তারা দায়িত্ব মেনেই করে নেয়।