যুক্তরাষ্ট্র-ইরান সংঘাতের পরিণতি কী?
ইরান সদর্পে ঘোষণা দিয়ে ইউরেনিয়াম আহরণ জোরালো করেছে। প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি সম্প্রতি এ ঘোষণা দিয়েছেন। একগুঁয়ে ইরানের এই পারমাণবিক কর্মসূচি থামাতে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানও কঠোর। যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের এই সংঘাত মধ্যপ্রাচ্যের উপসাগরীয় এলাকায় শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। প্রশ্ন উঠেছে, পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে।
সংঘাত যেভাবে শুরু
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের সংঘাত নতুন নয়। ছয় দশকের বেশি সময় ধরে চলছে। শাহদের শাসনামলে এই পরিবারের প্রভাব-প্রতিপত্তি কাজে লাগিয়ে অনেক দিন ধরেই ইরানের প্রধান প্রাকৃতিক সম্পদ তেলের ওপর বিরাট ভাগ বসিয়ে আসছিল যুক্তরাষ্ট্র। সঙ্গে ছিল যুক্তরাজ্য।
১৯৫১ সালে ইরানের নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মদ মোসাদ্দেক দেশের তেলসম্পদকে জাতীয়করণের একটা পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। পশ্চিমা দেশে শিক্ষিত মোসাদ্দেক ছিলেন সাহসী ও বুদ্ধিমান। মার্কিন ও ব্রিটিশরা পড়ে গেল সমস্যায়। ভাবল, এই প্রধানমন্ত্রী তাদের স্বার্থ তো দেখবেনই না, বরং এতে কুড়াল চালাবেন। গোপন সলাপরামর্শে বসে গেল মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ ও ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স সার্ভিস। উদ্দেশ্য একটাই—মোসাদ্দেককে উৎখাত করে পশ্চিমা স্বার্থ-সহায়ক নতুন নেতা নিয়ে আসা। পরে যে অভ্যুত্থানটি ঘটানো হলো, এর সাংকেতিক নাম ‘অপারেশন পিটি-অ্যাজাক্স’। এতে পতন হলো মোসাদ্দেকের।
১৯৫৩ সালের আগস্টে এলেন নতুন প্রধানমন্ত্রী। তিনি মুহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভি। তাঁর সরকার ছিল ধর্মনিরপেক্ষ, কমিউনিস্টবিরোধী ও পশ্চিমাপন্থী। কোটি কোটি ডলারের বৈদেশিক সহায়তার বিনিময়ে ইরানের তেলসম্পদের মোট মজুতের ৮০ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের হাতে তুলে দেয় এই সরকার।
ইরানে ক্ষমতার পালাবদল হলেও বেশির ভাগ ইরানি তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মার্কিন হস্তক্ষেপকে ভালোভাবে নেয়নি। জনরোষ ক্রমে শাহ পরিবারের দিকে ধাবিত হতে থাকে। প্রধানমন্ত্রী রেজা শাহ নিজের অবস্থান মজবুত করতে কঠোর অবস্থান নেন। ‘সাভাক’ নামে তাঁর একটি গোপন পুলিশ বাহিনী ছিল। হাজার হাজার মানুষকে তারা নির্যাতন করে, নৃশংসভাবে হত্যা করে।
প্রধানমন্ত্রী রেজা শাহকে এ সময় প্রতিরক্ষাব্যূহ সুরক্ষিত করার পরামর্শ দেয় যুক্তরাষ্ট্র। শাহ সরকার কোটি কোটি ডলার ব্যয়ে আমেরিকার কাছ থেকে অস্ত্র কিনতে থাকে। অর্থের এই শ্রাদ্ধ ইরানের অর্থনীতির বারোটা বাজিয়ে দেয়। ফুঁসে ওঠে জনরোষ। দেশব্যাপী শুরু হয় বিপ্লব। ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লা খোমেনির নেতৃত্বে এই বিশাল বিপ্লবে ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে পতন হয় রেজা শাহর। ক্ষমতা হারিয়ে সপরিবার দেশ ছাড়েন তিনি।
এর কয়েক মাস পর, ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য আমেরিকায় যান শাহ। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় তিনি এ সুযোগ পান। ইরান তা ভালোভাবে নেয়নি। ১৯৭৯ সালের ৪ নভেম্বর একদল ইরানি ছাত্র ঝোড়ো বেগে তেহরানের মার্কিন দূতাবাসে ঢুকে পড়েন। ৬০ জনের বেশি কর্মীকে জিম্মি করে ফেলা হয়।
এ ঘটনায় ক্ষমতাচ্যুত শাহকে শিগগিরই যুক্তরাষ্ট্র ত্যাগ করতে হয়। কার্টার অনেক চেষ্টা করেও তেহরানের ওই ঘটনার কোনো সমাধান করতে পারেননি। এমনকি ‘অপারেশন ইগল ক্ল’ নামের একটি ঝুঁকিপূর্ণ সামরিক অভিযানও ঘটনাক্রমে ব্যর্থ হয়। ইরানি ছাত্ররা কিছু মার্কিন নাগরিককে মুক্তি দিলেও শেষ পর্যন্ত ৫২ জন জিম্মি হিসেবে থেকে যায়।
এ ঘটনায় মার্কিন নাগরিকেরাও কার্টারের ওপর আস্থা হারায়। পরবর্তী নির্বাচনে সদর্পে ক্ষমতায় আসেন রিপাবলিকান প্রার্থী রোনাল্ড রিগ্যান। ১৯৮০ সালের নির্বাচনে রিগ্যান ক্ষমতায় আসার পর তেহরানের মার্কিনবিরোধী মনোভাবের পরিবর্তন ঘটে।
১৯৮১ সালের ২১ জানুয়ারি রিগ্যান উদ্বোধনী ভাষণ দেওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর খোমেনির নির্দেশে ছাত্ররা ছেড়ে দেন জিম্মি করা মার্কিন নাগরিকদের। তত দিনে পার হয়ে গেছে ৪৪৪ দিন।
ইতিহাসবিদ ও বিশ্লেষকদের মতে, ক্ষমতাচ্যুত শাহকে চিকিৎসার সুযোগ দেওয়ার কারণেই যে শুধু তেহরানে মার্কিন নাগরিকদের জিম্মি করা হয়, তা নয়। মার্কিনদের ওপর ইরানিদের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ থেকে ওই ঘটনা ঘটে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের সম্পর্কের টানাপোড়েন মূলত তখন থেকেই দৃশ্যমান।
বৈরিতার বিস্তৃতি
মধ্যপ্রাচ্যের ইতিহাসে ইরাক-ইরান যুদ্ধ একটি রক্তক্ষয়ী কালো দাগ হিসেবে চিহ্নিত। এখানেও যুক্তরাষ্ট্র ঝোপ বুঝে কোপ মেরেছে।
ইরানে শাহর স্বৈরশাসনের অবসান ঘটায় ইরাকের তৎকালীন নেতা সাদ্দাম হোসেন চিন্তায় পড়ে যান। এ বিপ্লব তাঁর দেশেও ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করতে থাকেন। কারণ, সাদ্দাম ছিলেন সুন্নি। আর ইরাকের বেশির ভাগ নাগরিক শিয়া। তারা ইরানের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাদ্দামকে হটাতে আন্দোলন করতে পারে বলে আশঙ্কা করছিলেন তিনি।
ইরান যাতে আগ বাড়াতে না পারে, এ জন্য ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বরে ইরানের সীমান্তে হানা দিয়ে কিছুটা জায়গা দখল করে নেন সাদ্দাম। তিনি ভেবেছিলেন, এই সাফল্যে তাঁর প্রভাব বাড়বে।
বিপ্লব–পরবর্তী ধাক্কা সামলে সোজা হয়ে দাঁড়াতে একটু সময় নেয় ইরান। ১৯৮২ সালে ইরাকি সেনাদের নিজ সীমানায় ঠেলে দেয় ইরান। তারপর পাল্টা ইরাকের ভেতর হানা দেওয়ার চেষ্টা চালায়। শুরু হয় দুই প্রতিবেশীর সীমান্ত যুদ্ধ, যা বিশ্বের ইতিহাসে রক্তক্ষয়ী এক ন্যক্কারজনক যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। ভয়াবহতার দিক দিয়ে অনেক বিশ্লেষক এ যুদ্ধকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। আট বছর ধরে চলা এই যুদ্ধে প্রায় ১০ লাখ লোক হতাহত হয়।
এই যুদ্ধে দুই দেশের সেনারা পরিখা খনন করে ভারী অস্ত্র বসিয়ে যুদ্ধ করে। ইরাক এ সময় ইরানের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে। এমনকি দেশের উত্তরাঞ্চলের কুর্দিদের বিরুদ্ধে সাদ্দাম এই অস্ত্র ব্যবহার করেন।
এই যুদ্ধের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা দৃশ্যত নিরপেক্ষ ছিল। একরোখা সাদ্দামকে সমঝে চলত আমেরিকা। তাঁর কারণে ইরাককে সন্ত্রাসে মদদ দেওয়া দেশ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে রাখে তারা। তবে দুই দেশের কারও সঙ্গেই তাদের আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিল না। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রের মূল মাথাব্যথা ছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। বিশ্বে কমিউনিজমের বিস্তৃতি ঘটে কি না, এ নিয়ে বড্ড চিন্তিত ছিল তারা।
ইরাকে ওই সময় কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব ছিল ভালোই। সাদ্দামেরই ছত্রচ্ছায়ায় এই পার্টি দিন দিন শক্তিশালী হচ্ছে বলে ধারণা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। ১৯৮১ সালে সীমান্ত যুদ্ধ বন্ধের আবেদন জানায় এই পার্টি। সাদ্দামের কাছ থেকে এর জবাবটা ছিল নির্মম। তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের ধরে ধরে নির্যাতন চালাতে থাকেন। একই সঙ্গে চলে হত্যাযজ্ঞ।
যুক্তরাষ্ট্র তখন ভাবল, সাদ্দামও তো সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে উদ্বিগ্ন। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসে মদদ দেওয়া দেশের তালিকা থেকে ইরাকের নাম কেটে দিল তারা। দেশটির সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে বোয়িং জেট বিমান বিক্রি করতে লাগল।
বিপ্লবের কারণে ইরানে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে বিশাল স্বার্থ থেকে বঞ্চিত যুক্তরাষ্ট্র আসলে এমনই এক মিত্র চাইছিল। দূর থেকে সরাসরি তো আর ইরানকে চাপে ফেলা যাবে না। তাই ইরাকের কাঁধে বন্দুক রাখার চেষ্টা চালায় তারা।
১৯৮৩ সালে লেবাননভিত্তিক শিয়াপন্থী সশস্ত্র মিলিশিয়া দল হিজবুল্লাহ বেশ কিছু পশ্চিমা নাগরিককে জিম্মি করে ফেলে। এর মধ্যে ছয়জন মার্কিন ছিল। তাঁদের উদ্ধারের কোনো কিনারা করতে পারছিল না যুক্তরাষ্ট্র। সুযোগ বুঝে একদল মধ্যপন্থী ইরানি নেতা এগিয়ে আসেন। গোপনে তাঁরা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লা খোমেনির বিরোধিতা করতেন। যুক্তরাষ্ট্রকে এই নেতারা প্রস্তাব দিলেন, হিজবুল্লাহর কাছে আটক জিম্মিদের ছাড়িয়ে আনতে মধ্যস্থতা করবেন তাঁরা। বিনিময়ে ইরানের কাছে অস্ত্র বিক্রি করতে হবে।
প্রস্তাবটা পছন্দ হলো আমেরিকার। খোমেনির বয়স হয়েছে। তিনি আর কদিন? তিনি যখন থাকবেন না, তখনকার ইরানের নতুন সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে চাইলে এটাই সুযোগ।
১৯৮৪ সালে ইরাক-ইরান যুদ্ধ সীমান্ত থেকে পারস্য উপসাগরে ছড়িয়ে পড়ে। দুই দেশ পরস্পরের তেলবাহী জাহাজে হামলা চালাতে থাকে। শিয়াপন্থী ইরান এ সময় অন্য দুটি সুন্নি দেশ সৌদি আরব ও কুয়েতের তেলবাহী ট্যাংকারেও আঘাত হানে। এ সময় এখানে যুক্তরাষ্ট্রও জড়িয়ে পড়ে।
কুয়েতের সঙ্গে তখন ইরাকের বাণিজ্য বেশ রমরমা। কুয়েত আমেরিকাকে প্রস্তাব দেয় যে তারা তাদের জাহাজে মার্কিন পতাকা ব্যবহার করবে। ওই জাহাজ তখন আর কুয়েতের জাহাজ নয়, মার্কিন জাহাজ। এতে ইরান জাহাজটিতে হামলা চালালে তা হবে মার্কিন জাহাজে হামলা। তখন আমেরিকা পাল্টা সামরিক শক্তি প্রয়োগ করতে পারবে।
যুক্তরাষ্ট্র শুরুতে রাজি হতে চায়নি। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন এগিয়ে এল, যুক্তরাষ্ট্র সঙ্গে নেই তো কী হয়েছে? আমরা আছি।
যুক্তরাষ্ট্র দেখল যে ক্ষমতা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে, তখন তারা রাজি হলো কুয়েতের প্রস্তাবে। তাদের জাহাজ রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র উপসাগরে সশস্ত্র টহল দিতে লাগল।
১৯৮৫ সালে ইরানের কাছে গোপনে অবৈধভাবে অস্ত্র বিক্রি শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। অস্ত্র বিক্রির টাকা ব্যয় হতে থাকে নিকারাগুয়ার কন্ট্রা বিদ্রোহীদের পেছনে। বিদ্রোহী এই যোদ্ধারা তখন দেশটির কমিউনিস্ট সরকারকে উৎখাতে লড়ছে। ১৯৮৬ সালে বিষয়টি জানাজানি হলে তা ইরান-কন্ট্রা কেলেঙ্কারি হিসেবে সংবাদমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এই কেলেঙ্কারি প্রেসিডেন্ট রিগ্যানকে তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদে বেশ চাপের মধ্যে ফেলে।
এ পর্যায়ে দুই দেশের সঙ্গেই সম্পর্ক রাখাটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। শ্যাম রাখি না কুল রাখি পরিস্থিতি সামলাতে ইরানকে ত্যাগ করে ইরাকের পক্ষ নেয় তারা। ইরাক-ইরান যুদ্ধ বন্ধে জাতিসংঘের শান্তি আলোচনায় ইরাকের পক্ষে জোরালো ভূমিকা রাখে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৮৮ সালে এই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটার সঙ্গে সঙ্গে ইরানের সঙ্গে সম্পর্কও চুকে যায়।
পরবর্তী সময়ে ইরানের নিয়ন্ত্রণাধীন গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ হরমুজ প্রণালিকে কেন্দ্র করে চলতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের সংঘাত। সংকীর্ণ এই নৌপথ পারস্য উপসাগরের সঙ্গে বাকি বিশ্বের যোগসূত্র তৈরি করেছে। বিশ্বের ৪০ শতাংশ তেলবাহী ট্যাংকার এই প্রণালি দিয়ে চলাচল করে।
ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় ইরান হুমকি দিয়েছিল যে তারা এই নৌপথ বন্ধ করে দেবে। এই হুমকির পর থেকে ইরানের পেতে রাখা মাইন হরমুজ প্রণালিতে চলাচলে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। দুই দেশের যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পরও এসব মাইন থেকে যায়। তখন এই নৌপথকে নিরাপদ রাখতে বাহরাইনের ঘাঁটি থেকে মার্কিন নৌবাহিনীর পঞ্চম নৌবহর টহল দিচ্ছিল।
১৯৮৮ সালের ১৮ এপ্রিল মার্কিন নৌবাহিনী একটি ফ্রিগেট ইরানের পেতে রাখা মাইনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাল্টা জবাবে যুক্তরাষ্ট্র ইরানের তিনটি যুদ্ধজাহাজ ডুবিয়ে দেয়। ধ্বংস করে ইরানের দুটি নজরদারি মঞ্চ। মাত্র এক দিনের যুদ্ধে এসব ঘটনা ঘটে।
তবে ইরানের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয় একই বছরের ৩ জুলাই। যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে একটি ইরানি যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ ধ্বংস করা হয়। এতে ২৯০ জন যাত্রীর সবাই নিহত হয়। এর মধ্যে ৬৬ জনই ছিল শিশু। অন্যরা ছিল হজযাত্রী। যুক্তরাষ্ট্র পরে এ ব্যাপারে কৈফিয়ত দেয়, যুদ্ধবিমান ভেবে ভুল করে এই ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়।
এরপর যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে যেসব সংঘর্ষ বা সংঘাত হয়েছে, কোনোটাই এত ভয়াবহ নয়।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি, নিষেধাজ্ঞা ও সংকট
যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের সংঘাতে নিষেধাজ্ঞা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইরানকে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিকভাবে পর্যুদস্ত করতে গত শতকের আশির দশকের গোড়া থেকে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র।
শুরুতে বিভিন্ন সময় নিজ স্বার্থে এককভাবে ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তারা। পরবর্তী সময়ে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে জাতিসংঘ ও পশ্চিমা বিশ্বের সহায়তায় ব্যাপক আকারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্র প্রথম নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ১৯৭৯ সালের নভেম্বরে, তেহরানের মার্কিন দূতাবাসের জিম্মি নাটকের ঘটনায়। তারা ইরান থেকে বিভিন্ন পণ্য আমদানি বন্ধ করে দেয় এবং ১২০০ কোটি ডলারের ইরানি সম্পদ জব্দ করে।
১৯৮৪ সালের জানুয়ারিতে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ইরানকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের মদদদাতা বলে অভিহিত করে। এর সূত্র ধরে তারা দেশটির ওপর আরও কিছু নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
১৯৯২ সালে মার্কিন কংগ্রেসে এমন নীতি অনুসরণ করে বিল পাস হয়, যেখানে উল্লেখ করা হয় যে এখন থেকে যুক্তরাষ্ট্র সেই সব সামগ্রী ও প্রযুক্তি ইরাক বা ইরানের কাছে হস্তান্তরের বিরোধিতা করবে, যা দিয়ে তারা রাসায়নিক, জীবাণুবাহী, পারমাণবিক বা উন্নত মানের অন্য কোনো অস্ত্র তৈরি করতে পারে।
১৯৯৬ সালে ইরানের পেট্রোলিয়াম শিল্পে বিনিয়োগের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। এই শিল্পের বিপুল আয় থেকে ইরান গণবিধ্বংসী অস্ত্র তৈরি করতে পারে বা সন্ত্রাসে অর্থ ঢালতে পারে—নিষেধাজ্ঞার পেছনে এই অজুহাত দেখানো হয়। ওই সময় ইরানের তেল ও গ্যাস খাতে বিদেশি কোম্পানিগুলোর মোটা অঙ্কের বার্ষিক বিনিয়োগ ছিল।
এর কয়েক মাস পরই তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের এক নির্বাহী আদেশে ইরান থেকে সব ধরনের পণ্য আমদানি এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে সব ধরনের পণ্য ইরানে রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। এই নিষেধাজ্ঞার মধ্যে সব ধরনের সেবার বিষয়ও রয়েছে।
পরবর্তী সময়ে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে দফায় দফায় বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। এখানে লক্ষণীয়, যে পারমাণবিক কর্মসূচি এখন যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথার বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, একদিন ইরানকে তারাই কিন্তু এ পথ দেখিয়েছিল। গত শতকের পঞ্চাশের দশকে ইরানে শাহর শাসনামলে ‘ইউএস অ্যাটমস ফর পিস’ কর্মসূচির আওতায় ইরানকে তারা কারিগরি সহায়তা দেয়। ১৯৭৯ সালে তেহরানে মার্কিন দূতাবাসের ওই ঘটনার পর এ সহায়তা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এ ব্যাপারে ইরানের আগ্রহ রয়েই যায়। পরে তারা পাকিস্তান, চীন ও রাশিয়ার সহযোগিতায় এ কর্মসূচিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে।
২০০২ সালে ইরানের একটি বিরোধী দল দেশের পারমাণবিক কর্মসূচির গোপন বিষয়টি ফাঁস করে দেয়। তারা বলে, ইরান তাদের একটি পারমাণবিক স্থাপনায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করে যাচ্ছে। এরপরই যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ তুলল, পারমাণবিক কর্মসূচির আড়ালে তারা ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে, মানে পারমাণবিক বোমা তৈরির ধান্দা। ইরান তা অস্বীকার করে।
২০০৭ সালে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব পাস হলো, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ ও সহায়তা বন্ধ।
কট্টর রক্ষণশীল ইরানি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ আরও জোরালো করে তুললেন এই কর্মসূচি। ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞার খাঁড়া আরও চেপে বসতে লাগল। পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্র বহনে সক্ষম ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিল জাতিসংঘ। ইউরোপীয় দেশগুলো ইরান থেকে তেল আমদানি বন্ধ করে দিল। একের পর এক নিষেধাজ্ঞার চাপে ইরানি মুদ্রার বাজার মূল্য দুই-তৃতীয়াংশ গেল কমে।
২০১৩ সালে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি ঘটে। মধ্যপন্থী নেতা হাসান রুহানি ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। সেপ্টেম্বরে, ক্ষমতায় আসার মাত্র এক মাস পর তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ হয় তাঁর। ৩০ বছরের বেশি সময়ের মধ্যে দুই দেশের শীর্ষ নেতার মধ্যে এটাই প্রথম সংলাপ। এরপর সমঝোতার জন্য শুরু হয় কূটনৈতিক তৎপরতা।
২০১৫ সালে ছয় দেশ মিলে ইরানকে একটি চুক্তিতে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়। ছয় দেশের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র বাদে অন্য পাঁচটি দেশ হচ্ছে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, রাশিয়া, চীন ও জার্মানি। এই চুক্তির অধীনে ইরান তার পারমাণবিক কার্যক্রম সীমিত করতে রাজি হয়। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা পরিদর্শনে যেতে দিতে সম্মত হয়। বিনিময়ে ইরানের ওপর থেকে তাদের অর্থনীতির জন্য বিপর্যয়কর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ারও শর্ত থাকে।
ওবামা ক্ষমতায় থাকতেই এই চুক্তি অনুযায়ী পারমাণবিক বিষয়ক নিষেধাজ্ঞা ইরানের ওপর থেকে তুলে নেওয়া হয়। অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নও একই রকম প্রস্তুতি নেয়। তবে ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের প্রাথমিক বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা বহালই থাকে।
পারমাণবিক কর্মসূচি সীমিত করা নিয়ে ইরানের সঙ্গে ছয়টি দেশের চুক্তি হলেও মূল দুটি দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাসের অভাব থেকেই যায়। ২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে আসার পর এই সংশয় প্রকট হয়ে ওঠে। ইরানের সঙ্গে চুক্তিতে শর্তের ঘাটতি রয়েছে এবং ইরান এখনো মাত্রাতিরিক্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে বলে অজুহাত তুলে ২০১৮ সালের মে মাসে ট্রাম্প এই চুক্তি থেকে সরে আসেন। ইরানের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্র সর্বশেষ গত মঙ্গলবার ইরানের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ওয়েবসাইটে দেওয়া বিবৃতি অনুযায়ী, ইরানের একটি বেসামরিক মহাকাশ সংস্থা এবং দুটি গবেষণা সংস্থার ওপর এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। আমেরিকার অভিযোগ, ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উন্নয়ন কর্মসূচিতে এসব সংস্থা সহায়তা করছে। নিষেধাজ্ঞা অনুযায়ী আন্তর্জাতিক কোনো বিজ্ঞানবিষয়ক সংস্থা ইরানের ওই তিন সংস্থাকে সহযোগিতা করতে পারবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের ভয়, এই কর্মসূচিতে সফল হলে ইরান পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্র বহনে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সূত্র ধরে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার কারণে বর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে কঠিন এক সংকটে ইরান। বিশ্বে তেলের মজুতে চতুর্থ বৃহত্তম দেশ তারা। কাজেই নিষেধাজ্ঞা না থাকলে তারা যে কতটা মজবুত অবস্থানে থাকত, তা সহজেই অনুমেয়।
তেল রপ্তানিকারক দেশগুলোর সংস্থা ওপেকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালের শুরুতে ইরান প্রতিদিন গড়ে ৩৮ লাখ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল উৎপাদন করেছে। প্রতিদিন গড়ে রপ্তানি করেছে ২৩ লাখ ব্যারেল। এখানে উৎপাদন ও রপ্তানির মধ্যে বিরাট বৈষম্য লক্ষণীয়। এর মধ্যেই ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞার খড়্গ, ইরান থেকে আর তেল আমদানি নয়। ওই সময় ইরান থেকে আটটি দেশ তেল আমদানি করছিল। তারা হলো চীন, ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, তুরস্ক, গ্রিস ও ইতালি। এই আটটি দেশকে অবশ্য ছয় মাসের সুযোগ দিয়ে বলা হয়, এই সময়ের মধ্যে তেলবিষয়ক সব লেনদেন চুকিয়ে ফেলতে হবে।
বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, গ্রিস, তাইওয়ান ও ইতালি এর মধ্যে ইরান থেকে তেল আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। অন্যতম বড় ক্রেতা চীন ও ভারত যথাক্রমে ৩৯ ও ৪৭ শতাংশ করে আমদানি কমিয়েছে। এতে চলতি বছরের মার্চ নাগাদ ইরানের অপরিশোধিত তেল রপ্তানি প্রতিদিন ১১ লাখ ব্যারেলে নেমে এসেছে। একজন মার্কিন কর্মকর্তার তথ্য অনুযায়ী, তেল রপ্তানি খাতে ইরান এর মধ্যে এক হাজার কোটি ডলারের বেশি রাজস্ব হারিয়েছে।
গত মে মাসে ট্রাম্প সদর্পে ঘোষণা করেছেন, ইরানের তেল রপ্তানি তিনি শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনবেন। বাস্তবে তাঁর এই চেষ্টা কতটা কার্যকর হবে, তা দেখার বিষয়। চীন এর মধ্যে বলেছে, ইরানের সঙ্গে ব্যবসা তারা চালিয়ে যাবে। এটা বৈধ। এখানে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। তুরস্ক বলেছে, পুরোনো মিত্রের সঙ্গে তারা সম্পর্ক নষ্ট করবে না। তেল রপ্তানিতে বিরূপ প্রভাবের কারণে কয়েক বছর ধরেই ইরানে মুদ্রাস্ফীতি চলছে। ২০১৭ সালে রুহানি অনেক চেষ্টায় তা যাও–বা ৯ শতাংশে নামিয়ে এনেছিলেন, এখন তা বেড়ে ৩১ শতাংশ ছাড়িয়েছে। স্ট্যাটিস্টিক্যাল সেন্টার অব ইরানের গত ১২ মাসে জিনিসপত্রের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। মাংস ও মুরগির দাম বেড়েছে ৫৭ শতাংশ, দুধ–ডিমের দাম বেড়েছে ৩৭ শতাংশ, সবজির দাম বেড়েছে ৪৭ শতাংশ। গরিব মানুষের আবাসন ও চিকিৎসা ব্যয় বেড়েছে ২০ শতাংশ।
ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ইরানের চিকিৎসাসেবা। বর্তমানে বহাল নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানে খাবার থেকে চিকিৎসা পর্যন্ত সব ধরনের মানবিক সহায়তা কাটছাঁট করা হয়েছে। এতে গুরুতর ও জটিল রোগে আক্রান্ত মানুষ সঠিক চিকিৎসা পাচ্ছে না। মারা যাচ্ছে ক্যানসারের রোগী।
বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ পরিণতি
২০১৮ সালে চুক্তি থেকে সরে আসার পর ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আবার সেই সাপে–নেউলে। যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি থেকে চলে আসার পরপরই উপসাগরে একটি বিমানবাহী রণতরি মোতায়েন করে। যেকোনো হামলার জন্য প্রস্তুত রেখেছে বি-৫২ যুদ্ধবিমান। এ ছাড়া বাহরাইন, কুয়েত, সিরিয়া, ইরাকে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি রয়েছে।
কিন্তু ঘটনা ঘটে গেছে। মে ও জুনে ওমান উপসাগরে ছয়টি তেলের ট্যাংকারে বিস্ফোরণ ঘটে। কেউ এ হামলার দায়িত্ব স্বীকার না করলেও যুক্তরাষ্ট্র এর পেছনে ইরানের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছে। কথাটা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ইরাক-ইরান যুদ্ধের সময় উপসাগরে এ ধরনের হামলা চালানো হতো।
২০ জুন হরমুজ প্রণালির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের একটি সর্বাধুনিক সামরিক ড্রোন ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ভূপাতিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, এটা আন্তর্জাতিক জলসীমায় ছিল। ইরান বলেছে, এটা তাদের সীমানা হানা দিয়েছিল। এসব ঘটনায় এটা স্পষ্ট যে ইরানও কোনো ছাড় দেবে না।
পারমাণবিক কর্মসূচিবিষয়ক ওয়াচডগ আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) গত ১ জুলাই নিশ্চিত করেছে যে ইরান তার চুক্তি ভঙ্গ করে নির্দিষ্ট মাত্রার চেয়ে বেশি ইউরেনিয়াম মজুত করছে। ইরানকে জ্বালানি খাতে ব্যবহার উপযোগী ইউরেনিয়াম আহরণের মাত্রা ৩ দশমিক ৬৭ শতাংশে বেঁধে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ইরান এর চেয়ে বেশি মাত্রায় ইউরেনিয়াম মজুত করছে। পারমাণবিক বোমা বানাতে লাগে ৯০ শতাংশ ইউরেনিয়াম।
আইএইএর এই তথ্য অনুযায়ী, শত বাধাবিপত্তি ও নিষেধাজ্ঞার মুখেও যেহেতু তারা এই প্রকল্প ছেড়ে নড়ছে না, এটা পরিষ্কার যে অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ৬ সেপ্টেম্বর থেকে ইরান তার বিভিন্ন পারমাণবিক স্থাপনায় জোরালোভাবে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের এসব স্থাপনায় পরিদর্শনে আসতে দেওয়া হবে না।
রুহানি এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে বলেন, সব নিষেধাজ্ঞা তুলে না নেওয়া পর্যন্ত কোনো আলোচনা নয়। সব মিলিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে কিছুতেই অবাধে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করতে দেবে না। ইরানও যেকোনো মূল্যে এ কর্মসূচিতে অটল থাকবে? এর ভবিষ্যৎ পরিণাম তাহলে কী?
ইরানকে তার ব্যয়বহুল পারমাণবিক কর্মসূচির জন্য তেলের টাকার ওপর নির্ভর করতে হবে। নিষেধাজ্ঞার কারণে এখন তেল রপ্তানি বাধাগ্রস্ত। এ ক্ষেত্রে বিকল্প পথ বেছে নেবে তারা। গোপনে তেল বিক্রির চেষ্টা চালাবে।
এর মধ্যে সেই নজির রেখেছে ইরান। জিব্রালটার সম্প্রতি অপরিশোধিত তেলসহ একটি ইরানি জাহাজ (আদরিয়ান দরিয়া-১) আটক করে। এই ট্যাংকারের আগের নাম গ্রেস-১। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ইরান এই জাহাজে সিরিয়ায় ২০ লাখ ব্যারেলের বেশি তেল পাঠাচ্ছিল বলে সন্দেহ করা হয়। সিরিয়ায় তেল নিয়ে যাবে না—এমন মুচলেকা দিয়ে জাহাজটি সপ্তাহ দুয়েক আগে ছাড়া পায়।
পরে জাহাজটি দ্রুত গতিপথ বদলে প্রথমে তুরস্ক ও পরে লেবাননের দিকে যায়। তবে লেবাননের কর্মকর্তারা বলেন, এমন কোনো জাহাজের খবর তাঁদের কাছে নেই। যুক্তরাষ্ট্র জাহাজটিকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে। উপসাগরীয় অঞ্চলে এমন ঘটনা বারবারই ঘটবে। সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।
ড্রোন ভূপাতিত করার ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ট্রাম্প ইরানকে পাল্টা জবাব দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু ১০ মিনিটের মধ্যে এ সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেন। বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞরা এতে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন। কারণ, দেশটি হচ্ছে ইরান। পাল্টাপাল্টি হামলায় কোথাকার জল কোথায় গড়ায়, তা কে জানে। ২০০৩ সালে ইরাক অভিযানে যুক্তরাষ্ট্র সহজেই যে সাফল্য পেয়েছিল, ইরানে হামলা চালালে মোটেও তা হবে না।
আট কোটির বেশি মানুষের দেশ ইরান আয়তনে ইরাকের চেয়ে চার গুণ বড়। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে অর্থনীতির দিক দিয়ে ইরানের অবস্থান এখনো দ্বিতীয়। কাজেই ইরান বড় সহজ কথা নয়।
ইরাক আক্রমণ করে যুক্তরাষ্ট্রের ফায়দা লোটার পেছনে কারণ ছিল। শিয়াপ্রধান দেশটিতে সাদ্দাম ছিলেন সংখ্যালঘু সুন্নিদের প্রতিনিধি। তিনি শিয়া, কুর্দিসহ অন্যান্য গোষ্ঠীর মানুষের ওপর নির্যাতন চালাতেন। তাই সেখানে তাঁর শত্রু ছিল। আর মুখে যতটা বড়াই করেছেন, প্রতিরক্ষার জন্য সে রকম যথেষ্ট অস্ত্র ছিল না।
ইরান শিয়াদের দেশ। বিপ্লবের অভিজ্ঞতায় তারা সাহসী। দেশাত্মবোধ, দেশপ্রেম ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে ইরানিরা একপ্রাণ। তাদের শৌর্যবীর্যও কম নয়। ইরানি সেনারা কেবল নিজ ভূখণ্ডে নেই। তারা ছদ্মবেশে ভিন্ন পরিচয়ে ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন জায়গায়। লেবাননের হিজবুল্লাহ ইসরায়েলে যেসব রকেট ছোড়ে, তা মিলিশিয়া দলের সদস্য হিসেবে ইরানি সেনারাই ছুড়ে থাকে বলে ধারণা করা হয়।
ইরাকের ভেতর অসংখ্য ছদ্মবেশী ইরানি যোদ্ধা রয়েছে। সিরিয়া ও বাহরাইনে রয়েছে। রয়েছে ইয়েমেনের হুতিদের মধ্যে। কাজেই ইরানকে যুক্তরাষ্ট্রের খোঁচা মারা হবে ভিমরুলের চাকে ঘা মারার মতো।
ইরানিরা সাগরে ছোট ছোট বোটে ঝাঁক বাঁধা মাছের মতো হামলা চালাতে পটু। আরও আছে জাহাজের তলা ফুটো করে দেওয়ার মতো সাবমেরিন। সে ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র বিমানবাহী রণতরি দিয়ে কতটা সুবিধা পাবে, তা দেখার বিষয়। আর ইরান যদি কোনোভাবে তাদের কোনো রণতরি ডুবিয়ে দেয়, আর্থিকভাবে তা হবে বিরাট ক্ষতি। চীন ও রাশিয়া তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে আর হাসবে।
ইরানের কাছে কী পরিমাণ অস্ত্র রয়েছে, এ ব্যাপারে বিশদ কোনো তথ্য নেই। তবে অস্ত্রের মজুত তাদের নেহাত কম নয়। ট্যাংকের মতো ভারী অস্ত্র তারা নিজেরাই তৈরি করে। আছে সাবমেরিন বিমানবাহী তরি, যুদ্ধবিমান, গোলাবারুদসহ ভারী অস্ত্র। আরও আছে স্বল্প, মধ্যম ও দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র। শাহাব, আশুরা, কাদের, সেজ্জিল—এসব ক্ষেপণাস্ত্র এক হাজার থেকে তিন হাজার কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে গিয়ে আঘাত হানতে পারে। মিশকাত নামের ইরানি ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের দৌড় দুই হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত।
বর্তমানে অস্ত্র কেনার ওপর জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা থাকায় ইরান বাইরে থেকে কোনো অস্ত্র কিনতে পারছে না। ২০২০ সালের অক্টোবরে এই নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ শেষ হবে। সেদিকে তাকিয়ে ইরান এর মধ্যে নতুন অস্ত্র কেনার তোড়জোড় করছে।
ইরানের বিমান শিল্প সংস্থার পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল করিম বানিতারাফি বলেছেন, রাশিয়া ও চীন বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র ও যুদ্ধবিমান বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছে। এর মধ্যে রাশিয়ার পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান রয়েছে। ইরানের ঘনিষ্ঠ এই দুই মিত্র তাদের জন্য বড় শক্তি। কাজেই উপসাগরীয় এলাকায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের টক্কর পরিণামে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটাতে পারে; বিশেষ করে সশস্ত্র যুদ্ধ।
শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
ই–মেইল: [email protected]