‘কাপড়চোপড় খুলে রড ও লাঠি দিয়ে আমাকে নির্মমভাবে পেটান তাঁরা। প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে চলে নির্যাতন। আমি যখন চেতনা হারিয়ে ফেলি, তখন আমাকে জাগিয়ে তুলতে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়। নির্যাতনের যন্ত্রণা সইতে না পেরে তাঁদের বলেছিলাম, নির্যাতন না করে একেবারে গুলি করে মেরেই ফেলুন।’
ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে নির্যাতনের এই বীভৎস বর্ণনা এক কাশ্মীরির। আরও অনেকেই এই রকম নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন বিবিসির সাংবাদিকের কাছে। তবে ভারতীয় সেনাবাহিনী নির্যাতনের কথা অস্বীকার করেছে। এসব নির্যাতনের ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে বিবিসির ওই প্রতিবেদনে।
৫ আগস্ট জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পর সেখানে রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, অধিকারকর্মীসহ প্রায় তিন হাজারজনকে আটক করা হয়।
বিবিসির সাংবাদিক কাশ্মীর উপত্যকার পরিস্থিতি দেখতে দক্ষিণাঞ্চলের অন্তত ছয়টি গ্রামে ভ্রমণ করেন। একটি গ্রামের অধিবাসীরা বলেন, রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের কয়েক ঘণ্টা পর সেনাবাহিনী বাড়ি বাড়ি গিয়ে অভিযান চালায়। গ্রামটির বাসিন্দা দুই সহোদর অভিযোগ করেন, ঘুম থেকে তুলে দুর্গম এলাকায় নিয়ে যাওয়া হয় তাঁদের। গ্রামের আরও বেশ কয়েকজনকে সেখানে আগেই নেওয়া হয়। ওই দুই সহোদরের একজন বলেন, ‘তাঁরা হঠাৎই আমাদের মারধর শুরু করলেন। তাঁদের কাছে জানতে চাইলাম, আমাদের দোষ কী? কিন্তু তাঁরা আমাদের কোনো কথাই শোনেননি। তাঁরা আমাদের পেটাতেই থাকলেন।’
ওই যুবক আরও বলেন, ‘তাঁরা আমাদের লাথি মারেন, লাঠি দিয়ে পেটান, বৈদ্যুতিক শক দেন। আমাদের পায়ের পাতায়ও পেটানো হয়েছে। নির্যাতনে আমরা চেতনা হারিয়ে ফেললে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে চেতনা ফেরানো হয়। অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করছিলাম আমরা। কান্নার আওয়াজ থামাতে আমাদের মুখে কাদা লেপে দেওয়া হয়।’
তবে বিবিসিকে পাঠানো এক বিবৃতিতে ভারতীয় সেনাবাহিনী বলেছে, সব অভিযোগ ভিত্তিহীন ও অবান্তর। কোনো বেসামরিক নাগরিককে নির্যাতনে করা হয়নি।
নির্যাতনের শিকার এক তরুণ বলেন, কারা নিরাপত্তা বাহিনীকে লক্ষ্য করে পাথর ছোড়ে, তাদের নাম জানতে চেয়ে নির্যাতন করা হয় তাঁকে। তিনি জানেন না বলতেই তাঁকে চশমা, কাপড়, জুতা খুলে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘আমি কাপড় খোলার পর আমাকে রড ও লাঠি দিয়ে প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে নির্বিচারে পেটানো হয়। আমি জ্ঞান হারালে বৈদ্যুতিক শক দিয়ে জাগানো হতো।’ ওই ব্যক্তি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘তারা (সেনা) যদি আবারও আমার সঙ্গে এটা করে, তাহলে আমি যেকোনো কিছু করতে পারব। আমি অস্ত্র তুলে নেব। আমি প্রতিদিন এটা সহ্য করতে পারব না।’ ছেড়ে দেওয়ার সময় তাঁকে সতর্ক করা হয়েছিল এই বলে যে তিনি যেন গ্রামের প্রত্যেককে গিয়ে জানান, কেউ যদি নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অংশ নেয়, তাহলে তাদেরও এমন নির্যাতন ভোগ করতে হবে।
গ্রামবাসীর মতে, তাঁদের এভাবে নির্যাতন করা হচ্ছে, যেন তাঁরা বিক্ষোভ করার মতো সাহস না দেখান।
সেনাবাহিনীর মুখপাত্র কর্নেল আমান আনন্দ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘এ ধরনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আমাদের নজরে আনা হয়নি। বেসামরিক ব্যক্তিদের সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেনাবাহিনীর পদক্ষেপের কারণে হতাহত হওয়ার কোনো ঘটনা ঘটেনি।’
বিবিসি সাংবাদিক কয়েকটি গ্রামে যান, যেসব গ্রামের অনেক বাসিন্দা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতি সহানুভূতিশীল। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে এমন একটি এলাকায় (পুলওয়ামা) পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠনের আত্মঘাতী বোমা হামলায় ভারতীয় আধা সামরিক বাহিনীর ৪০ সদস্য নিহত হন। এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানের অভ্যন্তরে জঙ্গিশিবির লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালায় ভারত। এ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ–পরিস্থিতি তৈরি হয়।
এই অঞ্চলে সেনাবাহিনীর ক্যাম্প রয়েছে এবং সেনাসদস্যরা নিয়মিত সেখানে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে এবং জঙ্গিদের প্রতি সহানুভূতিশীল ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে চিরুনি অভিযান চালান। বিবিসির সাংবাদিক তাঁর প্রতিবেদনে জানান গ্রামবাসী বলছে, তাঁরা প্রায়ই এই দুই পক্ষের মাঝখানে সংকটে পড়েন।
তেমন পরিস্থিতিতে পড়া একজন গ্রামবাসী জানান, তাঁর ২০ বছর বয়সে সেনাবাহিনী একবার তাঁকে জঙ্গিদের তথ্য জানানোর জন্য সেনাদের ইনফরমার হিসেবে কাজ করতে বলে। তিনি অস্বীকৃতি জানালে তাঁকে এমন পিটুনি দেওয়া হয় যে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত তিনি পিঠের ব্যথায় বিছানায় শুতে পারেননি।
ওই গ্রামবাসী বলেন, ‘এভাবে চলতে থাকলে বাড়ি ছেড়ে যাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় থাকবে না। তারা এমনভাবে মারে যেন আমরা পশু। তারা আমাদের মানুষ বলেই ভাবে না।’
আরেকজন গ্রামবাসী জানান, তাঁর সঙ্গে এক তরুণের দেখা হয়েছিল। ওই তরুণ তাঁকে জানিয়েছিলেন, তাঁর ভাই ভারতের সরকারবিরোধী অন্যতম বড় বিদ্রোহী গ্রুপ হিজবুল মুজাহিদীনে যোগ দিয়েছেন। ভাইয়ের কারণে তাঁকে সেনাক্যাম্পে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। ওই তরুণ অভিযোগ করেন, তাঁকে প্রচণ্ড নির্যাতন করা হয়েছিল। তাঁর পা ভেঙে দেওয়া হয়েছিল।