ফ্রান্স সেনাবাহিনীর সহায়তায় এবার কল্পকাহিনির লেখকেরা!
এ সময়ে যাঁদের বয়স ৩৫–এর কোঠা পেরিয়েছে, তাঁদের নিশ্চয় ছোটবেলায় কল্পকাহিনিভিত্তিক সিনেমা দেখে বিস্মিত হওয়ার কথা মনে আছে। মনে হতো, যেন সিনেমা বলেই সম্ভব, বাস্তবে তা হয় নাকি! তার ছাড়া ফোনে কথা বলা যায়! অথবা ফোনে কথা বললে ছবি দেখা যায়! ধুরর! তবে যা তখন শুধু কল্পনাই করা যেত, তা এখন বাস্তবে ধরা দিয়েছে। এ তো গেল ছোট পরিসরের বিষয়। যত দিন গেছে, কল্পকাহিনিভিত্তিক সিনেমায় কোনো যন্ত্র, বাহন, অস্ত্রের ব্যবহার দেখে কাহিনি নির্মাতার কল্পনাশক্তি নিয়ে বিস্ময় বেড়েছে। এখন এই কল্পনাশক্তির ওপর ভর করে সেনাবাহিনীকে আরও দক্ষ করে তোলার অভিনব পদক্ষেপ নিয়েছে ফ্রান্স। ভবিষ্যতের বড় বিপর্যয়ের ঘটনাগুলো কী ধরনের হতে পারে, সেই অনুমানের ওপর সেনাবাহিনীর সক্ষমতা বাড়াতে কল্পকাহিনি লেখকদের নিয়ে দল বানানো হচ্ছে।
‘রেড টিম’ নামে ফ্রান্সের নতুন মিশনের অধীনে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি লেখকদের কাজ হচ্ছে ভবিষ্যতের পরিস্থিতি মোকাবিলায় সেনাবাহিনীর জন্য কৌশল তৈরি। লেখকদের বলা হচ্ছে, ‘অকল্পনীয় বিষয়গুলো কল্পনা করুন। এরপর তা লিখে ফেলুন।’
ভবিষ্যতে নতুন ধরনের সন্ত্রাসী আক্রমণের ঘটনা বা বড় ধরনের কোনো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে পারে। বেসামরিক প্রতিরক্ষা ও জরুরি সেবাদাতা দলকে ভবিষ্যতের পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত রাখতে মহড়া দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। ফ্রান্স এমন কিছু মাথায় রেখে আগাম প্রস্তুতি নিচ্ছে। সম্ভাব্য পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাদের কার্যকারিতা প্রমাণের জন্য ‘রেড টিম’ কাজ করবে। কয়েকজন লেখকের কল্পনা করা পরিস্থিতি মোকাবিলায় জরুরি সেবাদাতারা কতটুকু প্রস্তুত, তা দেখা হবে। ভবিষ্যতে অত্যাধুনিক যন্ত্র বা কৌশল খাটিয়ে সন্ত্রাসী দলের আক্রমণের ঝুঁকি সম্পর্কে জানতেও এই টিমের কাজ সহায়তা করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
ব্রিটিশ দৈনিক দ্য ইন্ডিপেনডেন্টের খবরে বলা হয়েছে, ফ্রান্স সরকারের ‘ডিফেন্স ইনোভেশন এজেন্সি’–র বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, ভবিষ্যতের প্রযুক্তিনির্ভর নতুন বাস্তবতায় নিরাপত্তাঝুঁকি মোকাবিলায় ফ্রান্স সেনাবাহিনী বিশেষ দলটি তৈরি করছে। এতে থাকবে চার থেকে পাঁচজন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি লেখক। রেড টিমের কাজ হবে ভবিষ্যতের পরিস্থিতি মোকাবিলায় কৌশল তৈরি করা।
খবরে আরও বলা হচ্ছে, ফ্রান্স সরকারের ‘ডিফেন্স ইনোভেশন এজেন্সি’ ও ‘ডাইরেক্টরেট জেনারেল ফর ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনস অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজি’ সংস্থার সহায়তায় গড়ে উঠবে রেড টিম। ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবেন—এমন বিশেষজ্ঞ ও বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির লেখকদের জড়ো করা হবে এই দলে। প্রযুক্তিনির্ভর পরিবর্তিত বাস্তবতা কেমন হবে, সে সময় কী ধরনের পরিণতি ঘটতে পারে, সেসব বিষয়ে আভাস দেবে রেড টিম। একই সঙ্গে সেসব পরিস্থিতি মোকাবিলায় দলটি বৈধ কৌশল নির্ধারণ করবে।
বর্তমানে বিশ্ব জটিল ও সমন্বিত চ্যালেঞ্জের ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। বৈশ্বিক এ ঝুঁকি বেসামরিক প্রতিরক্ষার নানা বিষয় যেমন জলবায়ু পরিবর্তন, সাইবার হামলা, প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো বিষয়গুলোয় বেশি হবে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ‘বিশ্ব ঝুঁকি’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুসারে, প্রভাব বিবেচনায় এগুলো সর্বোচ্চ ঝুঁকি।
ফ্রান্সের সেনাবাহিনী ইতিমধ্যে সেনাদের সাহায্যে ‘ব্ল্যাক হরনেটস’ নামের বিশেষ ড্রোন সরবরাহ করেছে, যা মাত্র ১৫ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের ও ৩৩ গ্রাম ওজনের। এ ড্রোন ব্যবহার করে আশপাশে লুকানো বিপদ সম্পর্কে টের পাবে তারা।
গত ১৪ জুলাই প্যারিসে বাস্তিল দিবস উদ্যাপন অনুষ্ঠানে উদ্ভাবক ও সাবেক জেট-স্কি চ্যাম্পিয়ন ফ্রাংকি জাপাটা উড়ুক্কু ‘হোভারবোর্ড’ চালিয়ে সবার দৃষ্টি কাড়েন। ওই অনুষ্ঠানে বেশ কিছু চমকপ্রদ অস্ত্রের প্রদর্শনী করেছে দেশটির সেনাবাহিনী। এর মধ্যে ড্রোনবিধ্বংসী অস্ত্র ও জেটশক্তিতে চালিত ‘হোভারবোর্ড’ বেশ নজর কেড়েছে।
প্রদর্শনীর পরে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ সামাজিক মাধ্যমে একটি ভিডিও শেয়ার করেন। সেখানে দেখা যাচ্ছে, হোভারবোর্ড নিয়ে এক সৈনিক আকাশে উড়ছেন। ভিডিওয়ের নিচে তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের সেনাবাহিনীর জন্য আমরা গর্বিত। তারা আধুনিক ও সৃষ্টিশীল।’
সামরিক বাহিনী ও প্রযুক্তির মধ্যে সম্পর্ক রক্ষায় ফ্রান্স বেশ তৎপর। দেশটির সরকার চাইছে, ফ্রান্সে যত ধরনের আক্রমণ হতে পারে, সম্ভাব্য সব কটি নিয়েই ভাবুক রেড টিম। এ ক্ষেত্রে তাই বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির লেখকদের কল্পনা কাজে লাগাতে চাইছে তারা। অতীতে যেসব বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির যন্ত্র বা ঘটনা সম্পর্কে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, এখন তার অনেকটাই বাস্তবে পরিণত হয়েছে।
ষাটের দশকে টিভি সিরিজ ‘স্টারটেক’–এ দেখানো কমিউনিকেটর ডিভাইসটির মতোই ১৯৯০ সালে মটোরোলা ফ্লিপ ফোন বাজারে ছাড়ে। ভিডিও কলিং প্রযুক্তি দীর্ঘদিন ধরেই মানুষের কাছে পরিচিত। ১৯৬৮ সালে স্ট্যানলি কুবরিকের চলচ্চিত্র ‘২০০১: আ স্পেস ওডিসি’–তে তা দেখানো হয়; যদিও এখনো অনেক ডিভাইস বাস্তবের মুখ দেখেনি।