ওয়াশিংটন ডিসির ভবন সাজল বাংলাদেশের তাঁতের শাড়িতে
আনাকস্টিয়া ওয়াশিংটন ডিসির নিম্ন আয়ের মানুষের একটি আবাসিক এলাকা। অধিকাংশ মানুষই আফ্রিকান-আমেরিকান। গতকাল শনিবার এই এলাকার পাঁচটি ভবন সাজানো হলো বাংলাদেশের তাঁতের শাড়ি দিয়ে। সেখানে আঁকা হলো নানা রঙের নকশা, লেখা হলো কিছু কবিতা, শুভেচ্ছা বাণী। লেখার মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট বিষয়ের আধিক্য ছিল।
র্যাপচার—WRAPture—এই শিরোনামে প্রকল্পটির উদ্যোক্তা বাংলাদেশি শিল্পী মণিকা জাহান বোস। শাড়িকে শিল্পমাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে নারীদের জীবনসংগ্রামের গল্প তিনি দীর্ঘদিন থেকেই করছেন। তবে ওয়াশিংটন ডিসির প্রকল্পটি কিছুটা ভিন্ন। এর লক্ষ্য অংশগ্রহণমূলক শিল্পের মাধ্যমে জলবায়ু সংকট বিষয়ে মানুষকে সচেতন করা। পাশাপাশি বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র—এই দুই দেশের মানুষের সংগ্রাম ও দৈনন্দিন দিনযাপনের অভিন্নতা প্রকাশের মাধ্যমে তাদের নিকটবর্তী করা। যে শাড়িগুলো দিয়ে ওয়াশিংটন ডিসির ভবনগুলো সাজানো হয়, সেগুলোয় বাংলাদেশের পটুয়াখালীর কাটাখালী গ্রামের মেয়েরা প্রথমে নিজেদের পছন্দমতো নকশা এঁকেছিল। কেউ কেউ আমেরিকার অজ্ঞাতনামা বন্ধুদের উদ্দেশে কবিতাও লিখেছে। একই শাড়ির ওপরেই আনাকস্টিয়ার মানুষেরা নিজেদের পছন্দমতো নকশা এঁকেছে। দুই দেশের মানুষের এই শিল্পকর্মে অংশগ্রহণে একাকার হয়ে যায় বাংলাদেশের কাটাখালী, যুক্তরাষ্ট্রের আনাকস্টিয়া।
প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে মণিকা বোস বলেন, গতকাল সারা দিন প্রায় ২০০ মানুষ এই প্রকল্পে অংশ নেয়। সারা দিন যেন এক উৎসবের ভেতর দিনটা কেটে যায়। যারা এই নকশা উৎসবে যোগ দেয়, তাদের অধিকাংশই বাংলাদেশ সম্বন্ধে প্রায় কিছুই জানে না। কোনো দিন তারা সে দেশে যাবে, তেমন সম্ভাবনাও নেই। কাটাখালীর মেয়েরাও যুক্তরাষ্ট্র বিষয়ে কার্যত কিছুই জানত না। শাড়ির ওপর নকশা তৈরির সময় যে কর্মশালা হয়, তাতে অনেক কিছুই তারা জানতে পারে। শাড়ির মাধ্যমে দূরবর্তী এই দুই দেশের মানুষ অনায়াসে নিকটবর্তী হতে সক্ষম হয়।
মণিকা বোস জানান, জলবায়ু সংকট একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এই প্রকল্পের মাধ্যমে দুই দেশের মানুষই জানল, ব্যক্তিপর্যায়ে এই সংকট কাটাতে তারা কে কী করতে পারে। ছবি আঁকার ফাঁকে ফাঁকে কর্মশালা হয়েছে, যেখানে জলবায়ু সংকটের ভয়াবহ পরিণাম বিষয়ে সবিস্তার জানানো হয়েছে। কম গাড়ি চালানো, জ্বালানির বিচক্ষণ ব্যবহার ও বিদ্যুতের অপচয় রোধের মতো আপাতসামান্য কাজও সংকট মোকাবিলায় ভূমিকা রাখতে সক্ষম, সে কথা সবাইকে বুঝিয়ে বলা হয়েছে।
এই প্রকল্প আয়োজনে আর্থিক অনুদান দিয়ে সাহায্য করেছে ওয়াশিংটন ডিসির শিল্প কমিশন। গতকাল বিকেলে প্রকল্প শেষে এক বিশেষ অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন ওয়াশিংটন ডিসির শিল্প কমিশনার লরেন গ্লোভার ও বাংলাদেশের বিশিষ্ট লেখক ও মণিকা জাহানের মা নুরজাহান বোস।
মণিকা জাহান বোস ছয় বছর ধরে শাড়িতে গল্প বলার এই প্রকল্প নিয়ে কাজ করছেন। এ পর্যন্ত তিনি এ প্রকল্প নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ১০টি অঙ্গরাজ্যসহ কয়েকটি দেশ ঘুরেছেন। তিনি এ প্রদর্শনী আয়োজনের ঘোষণা দেন গত বছরের নভেম্বর মাসে। এ প্রদর্শনীর জন্য পাঁচ মাসেরও বেশি সময় ধরে তিনি শাড়িগুলো তৈরিতে যুক্ত করেন বাংলাদেশের পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার বড় বাইশদিয়া ইউনিয়নের কাটাখালী গ্রামের ১২ জন নারী এবং যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসির বাসিন্দাসহ ১৫০ জনের বেশি মানুষকে। এতে যুক্ত রয়েছেন শিশুদের চিত্রশিল্প শিক্ষা দেওয়ার কাজে নিয়োজিত ওয়াশিংটন ডিসির অলাভজনক প্রতিষ্ঠান প্রজেক্ট ক্রিয়েটের কর্মী-সদস্য, একসময়ের গৃহহীন নারী, শ্রবণপ্রতিবন্ধী এবং সব শ্রেণি, পেশা ও বয়সের নারী-পুরুষ।
বর্ণবাদবিরোধী ও নাগরিক অধিকার আন্দোলনের অবিসংবাদিত কৃষ্ণাঙ্গ নেতা নোবেল শান্তি পুরস্কারজয়ী মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের হত্যার দিনকে স্মরণ করে গত ৪ এপ্রিল এটি উদ্বোধন করা হয়। আরেকটি প্রদর্শনী হয় ১৪ এপ্রিল।
মণিকা জাহান বোস যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েসলেয়ান ইউনিভার্সিটি থেকে চিত্রকর্মের ওপর স্নাতক পাস করেন। পরে ভারতের শান্তিনিকেতন থেকে চিত্রশিল্পের ওপর স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা করেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া ল স্কুল থেকে আইনবিষয়ক ডিগ্রি জুরিস ডক্টরেট (জেডি) অর্জন করেন।