ঋণের 'ফাঁদ' বানাচ্ছে চীন?
এই প্রকল্পকে বলা হচ্ছে একবিংশ শতাব্দীর ‘সিল্ক রোড’। এই প্রকল্পের ফলে সংযুক্ত হবে ৭০টিরও বেশি দেশ। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের অনেকগুলো দেশ সংযুক্ত হবে এই নেটওয়ার্কে। সংযুক্ত দেশগুলোর জনসংখ্যা পুরো পৃথিবীর অর্ধেক। আর দেশগুলোর সম্মিলিত দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) পৃথিবীর চার ভাগের এক ভাগ। বুঝুন অবস্থা!
এর পোশাকি নাম ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’, উদ্যোক্তা চীন। সি চিন পিংয়ের দেশ বলছে, এটি বাস্তবায়িত হলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর অর্থনীতি ও যোগাযোগব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি হবে। তবে শুরুর পাঁচ বছর পর এসে প্রশ্ন উঠছে—এটি কি উন্নয়নের পথ, নাকি ঋণের ফাঁদ? চীন এই প্রকল্প দিয়ে অন্যান্য দেশগুলোর উপকার করতে চাইছে, নাকি গলায় পরাতে চাইছে ফাঁস? নিন্দুকেরা বলছেন, ঋণের ফাঁদে ফেলে সংশ্লিষ্ট এলাকার আঞ্চলিক রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে চীন।
বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বাস্তবায়ন করতে আদতে কত খরচ হচ্ছে? গার্ডিয়ান জানাচ্ছে, ব্যয় হতে পারে এক লাখ কোটি ডলার। এরই মধ্যে ২১ হাজার কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ করে ফেলেছে চীন, যার সিংহভাগই হয়েছে এশিয়ায়। আর এই প্রকল্পের কাজগুলো একচেটিয়াভাবে করছে চীনা নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলোই। ফলে, নানা দেশের সঙ্গে করা চুক্তির ফলে লাভবান হচ্ছে চীন।
‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’-এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে চীনের সঙ্গে প্রায় ৭০টি দেশের সড়ক, রেল ও সমুদ্রপথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করা। এতে করে স্বাভাবিকভাবেই চীনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর অর্থনৈতিক সম্পর্ক ও যোগাযোগব্যবস্থা জোরদার হবে। ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, চীন এই যোগাযোগব্যবস্থা দিয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও হাসিল করতে চাইছে। মূলত, এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকাজুড়ে বিশাল এলাকায় নিজেদের প্রাধান্য বিস্তার করতে চাইছে চীন। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে সংযুক্ত হওয়া নিয়ে উভয়সংকটে আছে মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কাসহ এশিয়ার অনেকগুলো দেশ। কারণ, চীনের এই প্রস্তাবে রাজি না হলে, সি চিনপিংকে অগ্রাহ্য করার ঝুঁকি নিতে হচ্ছে! আর কে না জানে, বর্তমান বিশ্বকাঠামোর অন্যতম প্রভাবশালী দেশ এই চীন। আবার রাজি হলে পড়তে হচ্ছে ঋণের ফাঁদে। কারণ এত বড় প্রকল্পে নিজস্ব অর্থায়ন করা প্রায় অসম্ভব। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে ঋণ নেওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছে চীন। বিশাল অঙ্কের সেই ঋণ নিয়েছেন তো মরেছেন!
চীন সব সময়ই এই উচ্চাভিলাষী প্রকল্পের ‘বৈশ্বিক উপযোগিতার’ বিষয়টি তুলে ধরতে তৎপর। কিন্তু মনে রাখতে হবে, মালদ্বীপ কিন্তু এই প্রকল্পে যুক্ত হতে গিয়েই চীনা ঋণে আটকে গেছে। সুযোগ বুঝে মালদ্বীপের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও নাক গলানোর চেষ্টা করছে চীন। যদিও সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিনের নেতৃত্বাধীন সরকারকে সমর্থন দিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি। মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিতে যান কথিত ভারতপন্থী ইব্রাহিম মোহাম্মদ সলিহ। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট জানাচ্ছে, বেইজিং ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য মালদ্বীপকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। ২০১৩ সাল থেকে দেশটিকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে চীন। পছন্দের লোক না থাকলেও বর্তমান সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে এটিই যথেষ্ট।
ওদিকে শ্রীলঙ্কার অবস্থাও বেগতিক। কিছুদিন আগেই দেশটিতে মাহিন্দা রাজাপক্ষের ‘অসাংবিধানিক’ সরকারকে স্বাগত জানিয়েছিল চীন। কিন্তু শেষে রনিল বিক্রমাসিংহে ফের ক্ষমতার কেন্দ্রে ফিরে এলে কপাল পোড়ে চীনের। এই দ্বীপ দেশটির হাম্বানটোটা বন্দর নিয়েও কম জল ঘোলা হচ্ছে না। এরই মধ্যে বন্দরটি ৯৯ বছরের জন্য ইজারা নিয়েছে চীন। কিন্তু উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য নেওয়া ঋণের সুদ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছে শ্রীলঙ্কা। আর অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত পাকিস্তান তো চীনের তৈরি ‘সিল্ক রোডেই’ দেখছে মুক্তির পথ!
অর্থাৎ রাজনৈতিক অঙ্গনে পিছু হটলেও, ঋণের কারণে চীনকে অগ্রাহ্য করতে পারছে না কেউই। ইদানীং দক্ষিণ এশিয়ায় চীন-ভারতের ‘ছায়াযুদ্ধ’ বেশ দেখা যাচ্ছে। প্রভাব বিস্তারের এই প্রতিযোগিতায় আপাতভাবে জয়ী দলের নাম ভারত হলেও, মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়ে তক্কে তক্কে আছে চীনও। এই জায়গাতেই পিছিয়ে আছে ভারত।
সেন্টার ফর গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠান গত বছর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। তাতে দেখা গেছে, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে যুক্ত হওয়া দেশগুলোর মধ্যে ২৩টি ঋণ সংকটে ছিল। এই দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে মিয়ানমার, পাকিস্তানসহ আরও অনেকে।
সম্প্রতি বিজনেস ইনসাইডারে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের কারণে যুক্ত দেশগুলোর জীববৈচিত্র্যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়তে পারে। এতে করে ভিন্ন ভিন্ন দেশের বিভিন্ন ধরনের প্রাণিজগতের মধ্যে এমন একটি মিথস্ক্রিয়া হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা লাভের চেয়ে ক্ষতিই করবে বেশি। আরও একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, রাস্তাঘাট ভালো হলে পণ্য আনা-নেওয়ায় যেমন সুবিধা হবে, তেমনি আসতে পারে সৈন্যসামন্তও!
অবস্থাপন্ন দেশগুলো অবশ্য একটু ভেবেচিন্তেই এগোচ্ছে। ইকোনমিস্ট বলছে, মালয়েশিয়া এরই মধ্যে বেঁকে বসেছে। নাজিব রাজাকের সরকার চীনের বিভিন্ন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে মুক্ত হস্তে অনুমোদন দিয়েছিল। কিন্তু মাহাথির মোহাম্মদের নতুন সরকার তা আটকে দিয়েছে। মালয়েশিয়া বলছে, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে যুক্ত হতে ২০ বিলিয়ন ডলারের উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালনা করতে হবে। সেই কাজ করবে চীনা কোম্পানি, শ্রমিকও থাকবে চীনা। অর্থাৎ মালয়েশিয়ার কোনো নাগরিকের সেখানে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। আবার যে অঞ্চলে এই প্রকল্প চলবে, তাতে মালয়েশিয়ার লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, চীনকে ‘না’ করে দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা দোটানায় আছে মালয়েশিয়া। সম্প্রতি দেশটির এক মন্ত্রী বলে দিয়েছিলেন, উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়া হবে। আবার মাহাথির জানান, এর ব্যয় বহন করার সাধ্য নেই তাঁর দেশের। কিন্তু এর এক দিন পরই উল্টে যায় এই অভিজ্ঞ রাজনীতিকের বয়ান। তিনি জানিয়ে দেন, এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি!
অর্থাৎ মালয়েশিয়ার মতো দেশও এই মুহূর্তে চীনকে চটাতে চাইছে না। এর মূল কারণ হলো—চীনের সামরিক শক্তি ও কাঁড়ি কাঁড়ি ইউয়ান। আর সেই সুবিধাকে কাজে লাগিয়েই কিস্তিমাত করতে চাইছেন সি চিন পিং। এখন চীনকে কেউ ‘চেক’ দিতে পারে কি না, সেটাই দেখার।