জীবিকার প্রয়োজনে কাঁচা ঘুম ভেঙে প্রতিদিন সকালে রাস্তায় নামতে হয়। সত্যি বলছি, ঢের কষ্ট চোখ খুলতে। তবু খুলতে হয়। জানেনই তো, পেটের টান বড় টান। সেই টানে নিজেকে টেনে তুলে নামতে হয় রাস্তার মোড়ে। নিজের বাজেটের মধ্যে রিকশা না পেলে হন্টনই ভরসা। তাতে আস্থা রেখে রুটিরুজি জোগাড়ের স্থানে ঢোকার ঠিক আগমুহূর্তে প্রয়োজন হয় এক কাপ চা। এবার কিনা সেই চায়ের কাপেই লাগল গন্ডগোল।
সাম্প্রতিক এক সকালের গল্প বলি। রবি ঠাকুরের গান কানে গুঁজে হাঁটছিলাম। রাস্তার চারপাশের তীব্র হট্টগোলের মধ্যে মাথায় ছিল, ‘এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম, প্রেম মেলে না,/ শুধু সুখ চলে যায়।/ এমনি মায়ার ছলনা...’। সুখের জন্য প্রেম খুঁজতে গিয়েই পরিচিত টংয়ে চা চাওয়া হলো। সে সময় কিছু বিস্কুটেও পড়ল শকুনের নজর। সেগুলো মুখেও ঢুকল। নাহ্, বেহিসাবি খাইনি। খেয়েছি পকেটে থাকা খুচরা পয়সার অনুপাতে। কিন্তু পরিচিত দোকানি একগাল হেসে জানিয়ে দিলেন, অনুমিত ব্যয়ের চেয়ে তিন টাকা বেশি দিতে হবে। কারণ, এক কাপ চায়ের দাম বেড়ে গেছে। আশপাশের দোকানিদের কথা শুনে বোঝা গেল, দাম বেড়েছে আগের চেয়ে এক থেকে তিন টাকা পর্যন্ত।
কথাটা শুনে আমার শুরু হলো আঁতিপাঁতি করে কয়েন খোঁজার অভিযান। টাকা রাখার চর্মবটুকায় হারিকেন জ্বালিয়ে প্রচুর খোঁজাখুঁজির পর সমাধান মিলল। তবে মনে একটা খচখচানি রয়েই গেল। শেষে কি গরিবের চায়ের কাপেও মূল্যবৃদ্ধির স্টিকার লাগবে? ততক্ষণে অবশ্য এটাও বুঝে গেছি যে চায়ের কাপে প্রেম আর মিলবে না। সুখ চলে যাবে পাখা মেলে!
মুক্তবাজারের দেশে যেকোনো সময় পণ্যের দাম বাড়তেই পারে। ওই দোকানি যা বললেন, তা আমিও পত্রিকা পড়ে জেনেছি। দাম বেড়েছে চিনির, বেঁধে দেওয়া দামে বিক্রি হচ্ছে না। পাড়ামহল্লার দোকানে নাকি খোলা চিনি ৮০ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনি বিক্রি হচ্ছে ৮৪ থেকে ৮৬ টাকায়। দোকানির দাবি, দুধেরও দাম বাড়তি। আর এসবের ফল হলো, দামের দিক থেকে চায়ের অনাকাঙ্ক্ষিত পদোন্নতি। এদিকে এই অধমের খরচেও জোয়ার চলে বারো মাস।
আগেই বলেছি, ওই সকালের চা খাওয়ায় থুড়ি চা পানে রবি ঠাকুরের গানের প্রভাব ছিল। বিশ্বকবি কিন্তু চায়ের একজন সমঝদার ছিলেন।
অবশ্য জোয়ার কি আর শুধু চায়ে? সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, অল্প আয়ের মানুষ আমিষের অভাব পূরণে যে ব্রয়লার মুরগি ও ফার্মের ডিম কেনেন, এগুলোর দামও কয়েক সপ্তাহ ধরে বাড়তি। ১৩৫ টাকায় কেজি বিক্রি হওয়া ব্রয়লার মুরগির দাম এখন ১৫৫ থেকে ১৬৫ টাকা। ফার্মের ডিমের দাম প্রতি ডজনে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়ে এখন ১১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম প্রতি লিটার ১৫৩ টাকা। ও হ্যাঁ, কচুঘেঁচু খেয়ে উদরপূর্তির দিনও শেষ। সবুজ সবজিও লালবাতি দেখাচ্ছে। প্রায় সব ধরনের সবজির দাম নাকি কেজিতে ১৫ থেকে ২০ টাকা বেড়েছে। অবশেষে একটু সজীব হতে চুমুক দেওয়া সান্ত্বনার চায়েও এল অশান্তির ঝোড়ো হাওয়া।
আগেই বলেছি, ওই সকালের চা খাওয়ায় থুড়ি চা পানে রবি ঠাকুরের গানের প্রভাব ছিল। বিশ্বকবি কিন্তু চায়ের একজন সমঝদার ছিলেন। অন্তর্জালে জাল ফেলে জানা গেল, ঠাকুর পরিবার এ বঙ্গে চায়ের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল। আর রবি ঠাকুরের ছিল জাপানি চায়ের প্রতি অনুরাগ। শান্তিনিকেতনে নাকি চা–চক্রও চালু হয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে। চা নিয়েই হয়তো তিনি লিখেছিলেন, ‘হায় হায় হায় দিন চলি যায়। চা-স্পৃহ চঞ্চল চাতক দল চল চল চল হে...’।
কিন্তু আমার মনে যে চা–স্পৃহ চঞ্চলতা তখন অবসাদে ডুব দিচ্ছে। ধনাঢ্য কেউ কেউ বলতেই পারেন, ২ থেকে ৩ টাকা বেড়েছে, তা নিয়ে ন্যাকামো হচ্ছে! ঠিক আছে, এবার দিনে দিনে গুনে মাসের হিসাব করুন। সেটি বছরে নিয়ে যান। দেখবেন বাড়তি খরচের অঙ্কটা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়! এমনিতেই দ্রব্যমূল্যের পাগলা ঘোড়া স্বস্তি দিচ্ছে না, তাই বলে কি টংয়ের চায়েও অস্বস্তি সইতে হবে?
আমি যেখানে চা খেয়ে দিলে দাগা সহ্য করলাম, সেখানে এলে রবি ঠাকুর কী করতেন? নিশ্চয়ই হতাশ হতেন। অন্তত ‘চা-স্পৃহ’ আর ‘চঞ্চল’ থাকত না। হয়তো নতুন কোনো গান বা কবিতার সৃষ্টি হতো। বাঙালি মানবহৃদয়ের সব আনন্দ–ব্যথা যে রবীন্দ্রসংগীতে ব্যক্ত করা যায়, সেখানে এই গরিবও নিশ্চয়ই আশ্রয় খুঁজে পেত।
প্রবল পরিতাপের বিষয়, রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনো ‘চা’ খেতে আসেননি এবং আসবেনও না। হ্যাঁ, এ দেশের জনপ্রিয় লেখক মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের থ্রিলার উপন্যাসের নাম থেকেই ভাবনাটা এল মাথায়। এ নিয়ে আবার ওয়েব সিরিজও হয়েছে, তা হয়েছে বেশ আলোচিতও। যাক, প্রসঙ্গে ফিরে আসি। আসল কথা, আমার জায়গায় রবি ঠাকুর থাকলে অবশ্যই আমার বুকের ব্যথাটা টের পেতেন বলেই বিশ্বাস করি। মনের গহিনে যে একটা বাক্যই সেই থেকে বারবার উথলে উঠছে তা হলো—‘ওরা কি আমাকে চা–ও খেতে দেবে না?’
(পুনশ্চ: দয়া করে ‘ওরা কারা’—এমন প্রশ্ন তুলবেন না। এত কিছু বিস্তারিত বলে দিলে তো চলে না! প্লিজ, ভাবুন। ভাবা প্র্যাকটিস করুন।)