যাপিত রম্য
যে কারণে আমি আমার স্বামীকে ডিভোর্স দিই না
মানুষ কত কিছু আবিষ্কার করে! আমি আমার বউয়ের ডায়েরি আবিষ্কার করেছি। তাতে বিতং করে লেখা আছে আমারই কথা। অন্যের ডায়েরি পড়া অন্যায় ভেবে এড়িয়ে যেতে পারিনি। কারণ, লেখা তো আমাকে নিয়েই। লেখার শিরোনাম, ‘যে কারণে আমি আমার স্বামীকে ডিভোর্স দিই না’! এই শিরোনাম পড়ার পর বাকি লেখা না পড়ে আর অন্য উপায় আমার ছিল না।
১.
আমার স্বামীটা একটা গবেট। বোকার বোকা। আমার ধারণা, বিয়ের পর তার বোকামি আরও বেড়েছে। কাঁচাবাজারে গেলে প্রতিটা সবজি বিক্রেতা তাকে ঠকায়। গত বছরের টমেটো তাকে গতকালকে মাঠ থেকে তুলে আনা টমেটো বলে চালিয়ে দেয়। মাছ বিক্রেতারা পচা মাছ ধরিয়ে তাকে বলে তাজা মাছ। আর সে তা-ই মেনে নিয়ে ঢ্যাং ঢ্যাং করে বাসায় ফেরে। অদ্ভুত একটা! রিকশাওয়ালারা পর্যন্ত তাকে ঠকায়। ৩০ টাকার ভাড়া তার কাছ থেকে ৫০ টাকা আদায় করে। আমি আমার এক জীবনে এত গবেট মানুষ দেখিনি! এ রকম মানুষের সাথে সংসার করার কোনো মানে নেই!
২.
আমার স্বামীটা একটা অলস। যেনতেন অলস না, আমার ধারণা আলসেমির কোনো অস্কার থাকলে সে পরপর সাত-আটবার অস্কার পেয়ে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লেখাত। তার সবচেয়ে বেশি আলসেমি মশারি টানানোয়। সে পারলে মশারি গায়ে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। এমনকি সে ঘুমের মধ্যেও আলসেমি করে বলে আমার ধারণা। কারণ, এক কাতে ঘুমানোর পর সারা রাত সে অন্য কাতে যায় না। ওভাবেই সকালে ঘুম থেকে ওঠে। তারপর মুখে ব্রাশ নিয়ে ঢুলতে থাকে। দাঁত ব্রাশ করার মতো সহজ একটা কাজেও তার রাজ্যের আলসেমি। তিন দিন আগে সে এক গ্লাস পানি খেতে চেয়েছিল। আমি রান্নায় ব্যস্ত ছিলাম বলে তাকে সেটা না দিয়ে বলেছিলাম, ‘নিজে নিয়ে নাও!’ আমার ধারণা, তারপর সে আর পানি খায়নি। এমনও হতে পারে, সে হয়তো এই তিন দিনেও পানি খায়নি! তাকে দিয়ে কিচ্ছু বিশ্বাস নেই।
৩.
আমার স্বামীটা খুবই আড্ডাবাজ। আড্ডাবাজ, কিন্তু সে শুধুই তার বন্ধুদের সাথে আড্ডাবাজি করবে। আমরা যখন কাজিন-টাজিন মিলে গল্প করি, তখন সে চুপচাপ ভ্রু কুঁচকে বসে থাকে। বোঝাই যায়, সে আমাদের কথাবার্তায় বিরক্ত। অথচ সেই মানুষটাই যখন তার বন্ধুবান্ধবের সাথে বসে তখন হা হা হি হি করে অস্থির হয়ে যায়। কথায় কথায় মজা করার চেষ্টা করে। তার হিউমারে অন্যরা হেসে হেসে গলে গলে পড়ে (জঘন্য একেকটা!), অথচ আমার কোনো হাসি পায় না। কারণ, এই কৌতুকগুলো সে আমাকে আমাদের বাসররাতেই শুনিয়েছিল, আর সেগুলো খুবই খুবই খুবই পুরোনো। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে শুরু করলে এই লোকের কোনো সময়জ্ঞান থাকে না। আমি যে ওর সাথে আছি, সম্ভবত সেই বোধটাও থাকে না। আমি যতবার বলি, ‘এবার চলো...!’ সে বলে, ‘আরেকটু আরেকটু...!’ অথচ এই লোক শপিংয়ে যাওয়ামাত্রই বাসায় ফিরতে চায়। আমার সাথে কিছুক্ষণ ঘুরলেই তার মুখে রাজ্যের ক্লান্তি। শুধু বন্ধুদের সাথে আড্ডায় তার কোনো ক্লান্তি নেই। এ রকম একটা লোকের সাথে বাকিটা জীবন পার করার চেয়ে বনবাসে যাওয়া ভালো!
৪.
বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা শুরু হলে আমার স্বামী কেমন পাগলের মতো হয়ে যায়। সেদিন হয় সে অফিস যায় না, না হলে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে দ্রুত ফিরে আসে। তারপর টিভির সামনে রিমোট হাতে গ্যাট হয়ে বসে থাকে। এ সময় তার কাছে রিমোট চাইতে গেলে তার চোখ ধকধক করে জ্বলে। মনে হয় যেকোনো সময় সে চিৎকার করে উঠবে। যদি বলি, ‘এখন আমার সিরিয়াল দেখার সময়। চ্যানেল চেঞ্জ করো।’ তখন সে বড় বড় করে নিশ্বাস ফেলতে থাকে। আমি দুই দিন জোর করে রিমোট নিয়ে চ্যানেল চেঞ্জ করে দেখেছি, লোকটা কাউকে কিছু না বলে বাসা থেকে বেরিয়ে মহল্লার টং দোকানে বসে খেলা দেখছে। আমার ধারণা, বাংলাদেশের ম্যাচ চলাকালে সে আধপাগলা হয়ে যায়। এ রকম আধপাগলা লোকের সাথে কীভাবে আমি দিনের পর দিন কাটাচ্ছি, ভাবতেই আমার শরীরে কাঁটা দিচ্ছে!
আমার পছন্দ ফ্রায়েড চিকেন আর তার পছন্দ কিনা ছোলামুড়ি! সে মাঝে মাঝে এতই অন্যমনস্ক থাকে যে আমার মনে হয় কোনো একদিন সে ভুলে কোনো বাসে চড়ে ভুল কোনো জায়গায় গিয়ে নেমে পড়বে! এই আতঙ্ক নিয়ে জীবন যাপন করা দুরূহ!
৫.
আমার স্বামীর সঙ্গে আমার কোনো কিছুতেই মেলে না। আমার পছন্দের রং পিংক, তার পছন্দ খ্যাত একটা সবুজ। আমি রোমান্টিক সিনেমা পছন্দ করি, আর সে পছন্দ করে তামিল টাইপ মারদাঙ্গা সিনেমা। আমি টিভিতে নাটক দেখি, আর সে দেখতে চায় খেলা (কিন্তু চাইলে কী হবে? আমি দেখতে দিলে তো!)! আমার পছন্দ ফ্রায়েড চিকেন আর তার পছন্দ কিনা ছোলামুড়ি! সে মাঝে মাঝে এতই অন্যমনস্ক থাকে যে আমার মনে হয় কোনো একদিন সে ভুলে কোনো বাসে চড়ে ভুল কোনো জায়গায় গিয়ে নেমে পড়বে! এই আতঙ্ক নিয়ে জীবন যাপন করা দুরূহ!
কিন্তু এত কিছুর পরও আমি আমার স্বামীকে ডিভোর্স দিই না! কারণ, ও যা কিছুই করতে চাক না কেন, আমি তাকে যখন বলি, ‘শোনো, আমার কথা শোনো...’, তখন সে আমার কথা শোনে। কোনো রকম ভেজাল করে না। এ রকম নির্ভেজাল মানুষ আজকাল শুধু স্বামী হিসেবেই পাওয়া যায় বোধ হয়!
(আগামীকাল পড়ুন ‘স্বামীর ডায়েরি থেকে’)