২০২০ সাল ছিল বাঁশময় বিস্ময়কর এক বছর। জনে জনে বাঁশ খেয়েছে এ বছরে। আপনি–আমিও এর বাইরে নই। কিন্তু বাঁশ খাওয়ার পর তা হজম করে ফেলাও কিন্তু একটা শিল্প। সেই শৈল্পিক পারদর্শিতা অর্জন করা অত্যন্ত জরুরি বিষয়। কারণ, এই পারদর্শিতা অর্জনের মাধ্যমেই নতুন ২০২১ সালে আমরা হাসির উপলক্ষ খুঁজে পেতে পারি।
বিশে বাঁশ দিয়েছে একটি ছোট্ট ভাইরাস। মানুষ শত্রুরও ডাকনাম দেয়। নতুন করোনাভাইরাস তাই হয়ে যায় শুধুই করোনা। এটি বিশ্বজুড়েই সব মানুষের জীবনযাত্রা বদলে দিয়েছে। কমবেশি সবার মুখে মাস্ক উঠেছে। আমাদের দেশে আবার মাস্ক যে থুতনিতে রাখার জিনিস, তা–ও দেখিয়ে দিয়েছে। মাস্ক খুলে যে পিচিক করে রাস্তায় কফ-থুতু ফেলতে হয়, তা শিখিয়েছে। এ বছরের কথা উঠলেই বিজ্ঞজনেরা মাথা নেড়ে বলেন, করোনা আমাদের অনেক কিছু শিখিয়ে গেল। শেখাতে চেয়েছে ঠিকই, তবে আমরা আদতে কতটুকু শিখেছি, তা রাস্তায় নামলে অনেকটাই টের পাওয়া যায়। একবার রাস্তায় নেমে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করলে যে কেউ তা বুঝতে পারবেন বলেও আশা রাখি।
বিশে বাঁশ খায়নি কে? আমির খেয়েছে, ফকিরও খেয়েছে। তবে কোনো কোনো রাজরাজড়া ধনসম্পদ ও ক্ষমতার প্রাবল্যের কারণে তা অনুভব করতে পারেননি। ফকিরের অবশ্য অনুভব না করে উপায় ছিল না। তাদের চামড়া পাতলা কিনা। একটু আঁচড়েই রক্ত ঝরে। আর করোনা তো শুধু আঁচড় কেটেই ক্ষান্ত হয়নি, জোরসে কামড়ও দিয়েছে।
বিশের বিষ সবচেয়ে বেশি টের পাওয়া যায় মনের গহিনে। দুদিন আগে অ্যাভেঞ্জার সিরিজের একটি সিনেমা দেখছিলাম। তা দেখতে দেখতে প্রথম যে খটকা চোখে লাগল, তা হলো কোনো সুপারহিরোর মুখে মাস্ক নেই! আয়রনম্যানকে তা–ও মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু থরকে পুরোনো স্বাভাবিকে দেখে প্রথমে বিস্ময়, পরে নিজের কথা ভেবে মায়া এবং সর্বশেষ বিশের বাঁশের সুতীব্র যন্ত্রণা অনুভূত হলো। বুঝে দেখুন, সুপারহিরোদের নিয়েও যখন এ ভাবনা মাথায় আসে, তখন সাধারণের ক্ষেত্রে তা কোন পর্যায়ে আছে?
বাঁশ আরও আছে। জীবনযাপনের খরচের খাতায় আলু, পটোল, বেগুনের পাশাপাশি মাস্ক, স্যানিটাইজারও লিখতে হয়। করোনার শুরুতে তা অস্বাভাবিক বেশি দামে কিনতেও হয়েছে। ৫ টাকার জিনিস ৫০ টাকায় কেনার বা কিনতে বাধ্য হওয়ার যাতনাই আলাদা। এটা অনেকটা বাধ্য হয়ে বাঁশ খাওয়ার মতো।
নিরুপায় হয়ে বাঁশ চিবোনোর ঘটনা আরও আছে। করোনায় অনেকের কর্মজীবন ওলটপালট হয়ে গেছে। চাকরি, ব্যবসা সবখানেই করোনা নিজের প্রভাববলয় তৈরি করে নিয়েছে। কেউ চাকরি হারিয়েছেন, চাকরি থাকলেও কারও কর্মস্থল প্যারাময় হয়েছে, কারও ব্যবসা মার খেয়েছে, কেউ আবার নতুন স্বাভাবিকে দ্রুত নিজেকে মানিয়ে নিয়ে চাকরি-ব্যবসায় সফলও হয়েছেন। তবে সামগ্রিকভাবে দেখলে হয়তো মলিন মুখই বেশি নজরে আসবে।
শিক্ষার্থীদের মতো এত বিশাল সাইজের অবসর মনে হয় করোনায় কেউ পায়নি। যে মুঠোফোনে সময় কাটানোর জন্য একসময় মা–বাবার সঙ্গে তাদের যুদ্ধ করতে হতো, অনলাইন ক্লাস করার জন্য তা তাদের হাতের মুঠোয় এসেছে অবলীলায়। যদিও সেই সঙ্গে নিয়মিত পড়াশোনা করার বিষয়টিও ছিল। অবসর হয়তো ছিল, কিন্তু তা দিন শেষে যন্ত্রণা হয়েই ফিরেছে। স্কুল-কলেজের মাঠ কি আর শিক্ষার্থী ছাড়া প্রাণ পায়?
জানার যেমন কোনো শেষ নেই, বিশে তাই বাঁশেরও কোনো শেষ নেই। নানা দিকে নানাভাবে ওত পেতে ছিল তারা। তবে বাঁশেও কিন্তু ‘ভাইটামিন’ আছে। ভেবে দেখুন, দিনে ১৪ ঘণ্টা বাঁশ খেয়েও পান্ডারা দিব্যি গোলগাল, নাদুসনুদুস আছে। আমরা কি পান্ডাদের কাছ থেকে কিছু শিখতে পারি না?
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে আক্ষরিক অর্থেও মানুষ বাঁশ খায়। পরোক্ষ খাওয়ার বিষয়টি তো সর্বজনীন। খাবার হিসেবে বাঁশের পুষ্টিগুণ ভালো, খেলে নাকি ক্ষুধামান্দ্য কমে। সুতরাং বাঁশ খান, খিদে বাড়ান।
আর মনে রাখবেন, সবাইকেই বাঁশ খেতে হয়। কেউ চিরদিন বাঁশ দিয়ে যেতে পারে না। এর জন্য শুধু বাঁশ খাওয়ার পর তা হজম করে ফেলার সামর্থ্য অর্জন করতে হবে, খিদে বাড়াতে হবে। দেখবেন, একদিন বাঁশ দেনেওয়ালারাই বাঁশ খেতে বাধ্য হচ্ছে। যেমনটা হতে পারে করোনার ক্ষেত্রে। টিকা সবার জন্য চলে এলেই বাঁশের অভিমুখ ঘুরে যাবে ভাইরাসের দিকে।
তাই একটু ধৈর্য ধরুন। এক মাঘে শীত (পড়ুন বাঁশ) যায় না। বিশের বাঁশ একুশেই হয়তো হবে দুনিয়া কাঁপানো খুশি।