দাঁড়াও বিবিকে বলে আসি

নাসিরুদ্দিন হোজ্জার জন্ম তুরস্কে ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে। নানা চরিত্রে ও পেশায় তাঁকে তাঁর কয়েক শ গল্পে হাজির হতে দেখা যায়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, হোজ্জা এখন আর তুরস্কের নন, সারা বিশ্বের। ইউনেসকো তাঁর গল্পগুলোকে বিশ্বসাহিত্যিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিয়েছে। হোজ্জা অবশ্য একেক অঞ্চলে একেক নামে অভিহিত। যেমন উজবেকিস্তান ও চীনে তিনি আফেন্দি বা এফেন্দি। তাঁর গল্প কখনো নির্মল হাস্যকৌতুকে, কখনো বুদ্ধির ঝলকে, কখনো বা নৈতিক শিক্ষার দ্যুতিতে উজ্জ্বল। কখনো নিজেকে নিজেই ব্যঙ্গ করেছেন।

একদিন সন্ধ্যাবেলা কয়েকজন বন্ধুবান্ধব গল্প করতে করতে এসে নাসিরুদ্দিনকে বললেন, ‘ভাই, আজ তোমার বাড়িতে আমরা সকলে খেতে চাই, খুব ইচ্ছে করছে তোমার বাড়িতে খেতে। অনেক দিন হলো ভালোমন্দ খাওয়া হয়নি।’

‘সে তো খুব ভালো কথা। চলো আমার বাড়ি। যে যত খেতে চাও আজ তোমাদের পেট ভরে খাওয়াব।’

তারপর বাড়ির দোরগোড়ার কাছে এসে তিনি বললেন, ‘ভাই, তোমরা একটু অপেক্ষা করো, আমি বিবিকে বাড়ির ভেতর গিয়ে বলে আসি খাওয়াদাওয়ার সব ব্যবস্থা করতে, যাতে তাড়াতাড়ি হয়।’ এ কথা বলে মোল্লা বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেলেন।

মোল্লার বিবি সব শুনে তো খেপে আগুন। বললেন, ‘আমি এখন এই রাতে তোমার এসব বেআক্কেলে দোস্তদের জন্য রান্না করতে যাব, চালাকি পেয়েছে? যাও, এখনই গিয়ে বলো, এখানে ওসব হবে-টবে না। সবাইকে যে যার বাড়িতে গিয়ে মনের সাধ মিটিয়ে খেতে বলে দাও। যা-ই বলো, আমাকে দিয়ে এখন কোনো কাজই হবে না।’

এদিকে বন্ধুরা অনেকক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করে শেষটায় কড়া নেড়ে হাঁক দিল, ‘ভাই নাসিরুদ্দিন, আমরা আর দাঁড়াতে পারছি না, দরজা খোলো। অনেকক্ষণ দাঁড়াতে দাঁড়াতে পায়ে খিল ধরে গেল যে!’

‘ছিঃ ছিঃ বিবি, ওসব কথা বলা যায় বন্ধুদের? ভীষণ লজ্জায় পড়ে যেতে হবে। ওদের প্রত্যেকের বাড়িতে আমি ভালোমন্দ খাবার অনেকবার খেয়েছি। আমি যদি আজ ওদের এভাবে ফিরিয়ে দিই, তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াবে বলো তো? না করার কথা আমি ভাবতেই পারছি না।’

‘তাহলে তুমি ওপরের ঘরে গিয়ে চাদরমুড়ি দিয়ে বসে থাকো। ওরা এলে যা বলার আমিই বলব।’

এদিকে বন্ধুরা অনেকক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করে শেষটায় কড়া নেড়ে হাঁক দিল, ‘ভাই নাসিরুদ্দিন, আমরা আর দাঁড়াতে পারছি না, দরজা খোলো। অনেকক্ষণ দাঁড়াতে দাঁড়াতে পায়ে খিল ধরে গেল যে!’

বিবি দরজা না খুলেই ভেতর থেকে বললেন, ‘উনি বেরিয়ে গেছেন। বাড়িতে নেই।’

‘সে কি, আমরা তো দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছি, ওকে বাড়ির মধ্যে ঢুকতে দেখেছি; কিন্তু ওকে তো বেরিয়ে যেতে আমরা দেখিনি?’

গিন্নির সাফ জবাব, ‘আমি কিন্তু বলছি উনি বেরিয়ে গেছেন। বাড়িতে নেই। আজ আর উনি বাড়ি ফিরবেন না বলে জানিয়ে গেছেন। কাল এলে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পারবেন।’ এ কথায় নাসিরুদ্দিন আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। তিনি দোতলার ঘরের জানালা থেকে চেঁচিয়ে বললেন, ‘সে খিড়কি দিয়ে বেরিয়ে গেছে। সামনের দিক দিয়ে বের হলে তো আপনারা দেখতেই পেতেন।’

সূত্র: আখতার হুসেনের সংকলন ও সম্পাদনায় প্রথমা প্রকাশনের নাসিরুদ্দিন হোজ্জার ১০০ গল্প বই থেকে

আরও পড়ুন