২০১৬ সালের মে মাসে পরিবেশ অধিদপ্তর এক জরিপ চালিয়েছিল। তাতে দেখা গেছে (কিংবা শোনা গেছে), ঢাকার শাহবাগ মোড়ে সকাল ৯টার দিকে মিনিটে ১৯টি হর্ন বাজে। দিনের অন্যান্য সময়েও হর্নের এই মাত্রা প্রায় একই থাকে।
আপনার কি মনে হয়, চার বছর পর ২০২০ সালে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে? উত্তর সবার জানা—পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। এর সমাধান কী? এ যেন কাজির গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই।
তবে কেউ কেউ এ বিষয়ে সোচ্চার। শব্দদূষণ রোধে সমাধান খুঁজে চলেছেন প্রতিনিয়ত। তাঁদের মধ্যে একজন মমিনুর রহমান রয়েল। একবারও হর্ন না বাজিয়ে ঢাকা শহরে ৯ হাজার কিলোমিটার মোটরসাইকেল চালিয়েছেন তিনি। শুরু করেছিলেন ২০১৯ সালের ২১ জানুয়ারিতে। ৯ হাজার কিলোমিটার পূরণ হলো ৯ নভেম্বরে।
কীভাবে এল এই ভাবনা? প্রশ্ন করেছিলাম মমিনুর রহমানকে। উত্তরে বলেন, ‘পৃথিবীর এমন অনেক দেশ আছে, যেখানে মানুষ হর্ন একদমই বাজায় না। চাইলে আমাদের দেশেও তো সম্ভব। তাই নিজেই কাজটা শুরু করলাম।’
হর্ন ছাড়া মোটরসাইকেল চালাতে কোনো সমস্যা হয়নি? বিশেষ করে ঢাকার রাস্তায়? মমিনুরের মতে, ‘গাড়ি চালানোতে মনোযোগ, সময় হাতে নিয়ে রাস্তায় বের হওয়া আর নিয়ন্ত্রিত গতিতে চালালে হর্নের কোনো প্রয়োজন নেই।’
স্লোগানে পরিবর্তনের স্বপ্ন
হর্ন না বাজিয়ে গাড়ি চালানোর আগে শব্দদূষণ রোধে আরও কাজ করেছেন মমিনুর রহমান। ২০১৮ সালের শুরুর দিকে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলেন প্ল্যাকার্ড হাতে। সচেতনতার বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমেও। ২০১৫ সালে তাঁর নিজস্ব স্লোগান ‘হর্ন হুদাই বাজায় ভুদাই’ সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে বেশ আলোচিত হয়। প্রমিত বাংলায় স্লোগানটির অর্থ ‘বোকারাই অকারণে হর্ন বাজায়’।
স্লোগানটি জনপ্রিয়তা পাওয়ার কিছুদিন পর একটা চিন্তা আসে মমিনুরের মাথায়। নিজ খরচে ওই স্লোগানসংবলিত টি-শার্ট ও স্টিকার বানাতে শুরু করেন তিনি। স্মারকগুলো বিক্রি করতে শুরু করেন কোনো লাভ ছাড়াই। মমিনুরের ভাষায়, ‘এটা তো কোনো ব্যবসা নয়, সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে ব্যক্তিগত একটি উদ্যোগ।’
একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় চাকরি করেন মমিনুর। পেশাগত অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানান, বিজ্ঞাপনের বিভিন্ন স্লোগান মানুষ খুব সহজেই মনে রাখতে পারে। এগুলোর মাধ্যমে মানুষের অভ্যাস কিংবা রুচির পরিবর্তনও ঘটে। আর এ কারণেই তিনি স্লোগানের মাধ্যমে সমাজেও পরিবর্তন আনতে চান।
শব্দদূষণের ক্ষতি
আচমকা শব্দে (ইমপালস সাউন্ড) ও দীর্ঘ মেয়াদে উচ্চ শব্দের (৭৫ থেকে ৮৫ ডেসিবেল) মধ্যে থাকলে মানুষ শ্রবণক্ষমতা হারাতে পারে। কারণ, এতে কানের কোষ (সেল) মারা যায়। কানের কোষ মারা গেলে তা মনোযোগের মাত্রা কমিয়ে দেয়। এই কোষ নতুন করে আর তৈরি হয় না। যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রভাবশালী চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য সাময়িকী দ্য ল্যানসেট বলে, উচ্চমাত্রার শব্দ মানুষের শ্রবণশক্তি ও স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলে। কানে শোনার ক্ষমতা কমে যায়, ঘুম কম হয়, বিরক্তির মাত্রা বেড়ে যায়। শব্দের কারণে শিশুদের শেখার ক্ষমতা কমে যায়। হৃদ্রোগ, উচ্চ রক্তচাপ ইত্যাদিও হয় দীর্ঘ মেয়াদে।
শব্দদূষণ রোধে নিঃশব্দে আন্দোলন
২০১৫ সালে শুরু করলেও বছর দুয়েকের মধ্যে মমিনুরের এ সচেতনতামূলক প্রচারণা বেশ গতি পায়। তাঁর সঙ্গে শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও একাত্ম হন। মমিনুর বলেন, ‘২০১৮ সালের দিকে আমরা কজন ফুটপাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখন র্যাবের একটা গাড়ি এসে আমাদের সামনে দাঁড়ায়। আমার সঙ্গে থাকা কয়েকজন বেশ ভয় পেয়ে যায়। তারপর ওই গাড়ি থেকে র্যাবের এক কর্মকর্তা নেমে এসে আমাদের উদ্যোগের প্রশংসা করেন। এ রকম উৎসাহ ভালো কাজ করার অনুপ্রেরণা দেয়।’
২০১৭ সালে কপিরাইট অফিস থেকে স্লোগানটির স্বত্বও পেয়ে যান মমিনুর। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও তখন তাঁর স্লোগান বেশ জনপ্রিয়। ফলে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিভাগ ও জেলা শহরগুলোতে তাঁল স্লোগান ও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে জনপ্রিয় ওই স্লোগানের নামে ফেসবুকে হাজারখানেক মানুষের একটি গ্রুপ এবং ফেসবুক পেজ গড়ে উঠেছে। শব্দদূষণ প্রতিরোধে দেশব্যাপী নানা উদ্যোগগুলোর ব্যাপারে মানুষ সেখানে লেখালেখি করে, ছবি বা ভিডিও শেয়ার করে; চলে আলোচনা। আর এখনো সময় পেলেই প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাস্তায় দাঁড়ান মমিনুর। ধীরে ধীরে তাঁর পাশে সচেতন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।
মমিনুর বিশ্বাস করেন, ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসবে। তবে পরিবর্তনের জন্য নিজেকে উদ্যোগী হতে হবে। তিনি বলেন, ‘খাদ্যে ভেজাল, পরিবেশদূষণসহ নানান রকম সমস্যার মধ্যে আমরা বেঁচে আছি। শব্দদূষণও অনেক বড় একটি সমস্যা। এসব সমস্যার জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমরা নিজেরাই দায়ী। তাই সমাধানের জন্য নিজেদের এগিয়ে আসতে হবে।’
মমিনুর তাঁর স্লোগানটি দেশের প্রতিটি রাস্তার মোড়ে ছড়িয়ে দিতে চান। সরকারের কাছে তাঁর আহ্বান, যাঁরা হর্ন না বাজিয়ে রাস্তায় চলাচল করতে পারবেন, তাঁদের জন্য যদি কোনো পুরস্কার বা সম্মাননার ব্যবস্থা থাকে, তাহলে মানুষ এ কাজে আরও উৎসাহী হবে।