ডায়াবেটিসের নতুন কারণ আবিষ্কারকারী দলের মূল গবেষক সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে
ডায়াবেটিসের নতুন এক কারণ আবিষ্কার করেছেন বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা। মূল গবেষক হিসেবে তাঁদের নেতৃত্বে ছিলেন ড. মধু এস মালো। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের সাবেক সহকারী অধ্যাপক তিনি। বর্তমানে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির উপদেষ্টা ও বারডেমের খণ্ডকালীন অধ্যাপক। তাঁর জীবনের গল্প শুনলেন সজীব মিয়া
ঢাকার ধামরাইয়ের সূয়াপুর গ্রামে মধুসূদন মালোর বাড়ি। বাড়ির পাশেই গাজীখালী। এ নদীর জলের সঙ্গে মিশে আছে তাঁর শৈশব। ধীরে ধীরে সেই শৈশবে ঢুকে পড়লেন ড. মধু এস মালো। বললেন, ‘সূয়াপুর আমার আত্মা। এটা আমার স্বপ্নভূমি।’
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে বসে ডায়াবেটিস নিয়ে তাঁর সাম্প্রতিক আবিষ্কার সম্পর্কে কথা হচ্ছিল। সেই আলাপই কখন যেন তাঁর শৈশবে চলে গিয়েছিল। শোনালেন পঞ্চম শ্রেণির এক গল্প।
সমাপনী পরীক্ষায় প্রথম হয়েছেন মধু এস মালো। বন্ধুদের সঙ্গে গিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তিও হলেন একদিন। কিন্তু তাঁর আনন্দে পানি ঢাললেন বাবা তারাশঙ্কর মালো। বাড়িতে ডেকে কড়া ভাষায় জানিয়ে দিলেন, পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পেলে তবেই ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হতে পারবেন, তার আগে নয়!
মনটাই খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু কী আর করা, বাবার আদেশ। ফাঁকি দেওয়ারও জো নেই। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক যে তাঁরই বাবা। অতএব পুরোনো ক্লাসেই আবার ফিরলেন মধু।
এভাবে তিন মাস চলে গেল। প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় বসেছেন। হঠাৎ এক শিক্ষক এসে হাতে হ্যাঁচকা টান দিয়ে বললেন, ‘চল, তোর আর পরীক্ষা দিতে হবে না।’ ভ্যাবাচেকা খেয়ে বেরিয়ে এসে মধু জানলেন, তিনি আসলে বৃত্তি পেয়েছিলেন। অন্য স্কুলে চলে গিয়েছিল তাঁদের ফলের কাগজ। সেটাই এসেছে এত দিন পর!
তারাশঙ্কর মালো ও প্রেমদা মালোর ছয় সন্তানের মধ্যে সবার বড় মধু। সূয়াপুরের স্কুলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। গ্রামের স্কুলে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার সুযোগ ছিল না। পাড়াতো এক দাদার পরামর্শে ভর্তি হন সাড়ে তিন মাইল দূরে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর হাইস্কুলে। বাড়ি থেকে স্কুলে যাতায়াত করা অসুবিধা। পরিচিত একজনের মাধ্যমে সিঙ্গাইরের একজনের বাড়িতে লজিং থাকলেন। মধু এস মালো বলেন, ‘বাবা সামান্য বেতনে শিক্ষকতা করতেন। অনেক ভাইবোন। দরিদ্র পরিবারে কষ্ট করে পড়াশোনা করতে হয়েছে আমাকে।’
সিঙ্গাইর স্কুল থেকে এসএসসি পাসের পর ঢাকা কলেজে পড়েছেন তিনি। ১৯৭০ সালে ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়—সব সময় বৃত্তি নিয়েই পড়েছেন ড. মধু মালো।
চিকিৎসা দিতে ইরাকে
১৯৭৬ সাল। সবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস করেছেন মধু এস মালো। সে সময় বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসক নিচ্ছিল ইরাক। বন্ধুদের অনেকের মতো তিনিও আবেদন করলেন। হয়েও গেল। ইরাকের দিনগুলো কাটছিল ব্যস্ততায়। রাত ১১টা পর্যন্ত রোগী দেখতে হতো। কিন্তু মধু মালোর স্বপ্ন তো রোগী দেখা নয়, ‘ছোটবেলা থেকেই আমি গবেষক হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম।’
পরিবারের চাওয়া পূরণ করতে মেডিকেলে পড়াশোনা করেছেন। ইরাকে এসে ভাবলেন আর নয়। এবার নিজের পথে হাঁটতে হবে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে থাকলেন। ইরাকে বসে যুক্তরাষ্ট্রে আবেদন করতে পারলেন না। এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার মোনাস বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তিসহ ভর্তির সুযোগ পেলেন। কিন্তু মনে তাঁর দ্বিধাদ্বন্দ্ব। বিবিসিতে প্রচারিত পাঁচ পর্বের একটি প্রতিবেদন দেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মলিকুলার বায়োলজি পড়বেন। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, আগামী দুনিয়া শাসন করবে মলিকুলার বায়োলজি। কিন্তু মোনাস বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয়টি তখনো চালুই হয়নি। শেষে সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ে মলিকুলার বায়োলজি নিয়ে উচ্চতর পড়াশোনার সুযোগ পেলেন। এ বিষয়েই তিনি পিএইচডি করেছেন।
চলে এলেন যুক্তরাষ্ট্রে
১৯৯০ সালে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি) পোস্টডক্টরাল করার সুযোগ এল। চলে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রে। এরপর জীবনের বড় একটি সময় ল্যাবরেটরিতেই কাটিয়ে দিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ফাইজারেও কাজ করেছেন কয়েক বছর। ২০০৩ সালে যোগ দিয়েছিলেন হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলে। বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানটিতে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে ২০১৩ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেছেন।
স্ত্রী-সন্তান নিয়ে এখনো বস্টনেই থাকেন তিনি। ২০১৬ সালে সেখানেই অ্যাটোক্সিন বায়োটেক নামে স্টার্টআপ চালু করেছিলেন। সেটারও কাজ ছিল ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের চিকিৎসা সহজীকরণ নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের পেটেন্ট অফিসে তাঁর নিজের ও সহযোগী হিসেবে ছয়টি উদ্ভাবনের পেটেন্ট করানো আছে। যার বেশির ভাগই ডায়াবেটিস চিকিৎসা নিয়ে।
আইএপি নিয়ে গবেষণা
২০০৬ সালের কথা। ড. মালো সে সময় আইএপি (ইনটেস্টিনাইল অ্যালকেলাইন ফসফেটাস) এনজাইম বিষয় একটি গবেষণা প্রতিবেদন পড়েছিলেন। এরপর বিষয়টি নিয়ে বিস্তর ঘেঁটেছেন। একসময় ইঁদুরের আইএপি নিয়ে গবেষণা করেন। ইঁদুরের আইএপি জিনকে সরিয়ে দিয়ে আইএপি শূন্য বা স্বল্পতা তৈরি করে তাদের ওপর গবেষণা করে দেখেন, ইঁদুরের স্থূলতা, ফ্যাটি লিভার ও ডায়াবেটিস হয়েছে। যেহেতু সব প্রজাতিতে এই জিন ও এনজাইম রয়েছে, সেখান থেকে তাঁর মাথায় আসে, মানুষের ডায়াবেটিসের কারণ হবে এই এনজাইম। এরপর গবেষণা শুরু। পাশে পান বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতিকে। তাঁর গবেষণায় যুক্ত হয় দেশের আরও কয়েকজন চিকিৎসক। পাঁচ বছর ধরে চলে গবেষণা। সে গবেষণার যুগান্তকারী ফল তো অনেকের জানা। ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নালেও তা প্রকাশিত হয়েছে।
ডায়াবেটিস নির্মূলের স্বপ্ন
ড. মধু মালো নিজে ডায়াবেটিসের রোগী। দীর্ঘদিন ভুগছেন এ রোগে। চিকিৎসা ব্যয় ও ধকল ভালো করেই জানেন তিনি। তাই হয়তো বলছিলেন, ‘কোনো মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়া মানে তাঁর জীবনকাল থেকে ১০টা বছর হারিয়ে যাওয়া।’
অথচ চাইলেই এখন জানা যাবে কার ডায়াবেটিসে আক্রান্তের আশঙ্কা আছে, কার নেই। মধু মালো চান তাঁদের গবেষণার সুফল দেশের মানুষ পাক। সরকার এগিয়ে আসুক। দেশজুড়ে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির মতো ডায়াবেটিস পরীক্ষা করার ব্যবস্থা করা হোক।
সেটা কীভাবে? বুঝিয়ে বলেন ড. মালো, ‘এ জন্য কিট তৈরি করতে হবে। আইএপি পরীক্ষা করতে হবে। সেটা ঘরে বসেই করা যাবে। আয়ের চিন্তা না থাকলে ২০০ টাকায় একেকটি কিট তৈরি করে মানুষের কাছে পৌঁছানো সম্ভব।’
ড. মধু এস মালো ডায়াবেটিস নির্মূলের যে স্বপ্ন দেখছেন, তা হয়তো দূর অতীত নয়।