অফিসে কাজ কম থাকলে পুরোনো সিনেমা দেখি। আমার আবার একটা গুণ আছে, নতুন সিনেমা দেখার কিছুদিনের মধ্যেই কাহিনি ভুলে যাই! তাই সিনেমা পুরোনো হলেও সেটা দেখার সময় প্রতিবারই ‘যা দেখি নতুন লাগে’! আজ দেখছিলাম ফাস্ট অ্যান্ড ফিউরিয়াস নাইন। ভেন ডিজেল পাহাড়ের গা–ঘেঁষা রাস্তায় গাড়ি নিয়ে রকেটের বেগে ছুটে চলেছেন, সামনে রাস্তা শেষ! টানটান উত্তেজনা! এর মধ্যে ফোন বেজে উঠল। বউ ফোন করেছে, ‘এই, তোমার বাইক কি ডিজেলে চলে?’
‘আরে, কী আশ্চর্য! বাইক কেন ডিজেলে চলবে?’
‘আমি এত কিছু জানি নাকি? পত্রিকায় দেখলাম, ডিজেলের দাম নাকি লিটারপ্রতি ১৫ টাকা করে বেড়েছে, ডিজেলে চললে বলতাম, আগে থেকে কয়েক ড্রাম কিনে রাখতা। আরও যদি বেড়ে যায়!’
‘ওহ হো! এটা তোমার আটা, ময়দা, পেঁয়াজ নাকি যে দাম বাড়লে কিনে রাখতে হবে? ডিজেলের দাম বাড়লে আমার কী!’
‘আচ্ছা আচ্ছা! ভালো কথা মনে করেছ, আসার সময় বাসার জন্য মাছ–মুরগি কিছু নিয়ে এসো। আর অফিস থেকে আসার সময় তোমার ট্রাভেল এজেন্সি হয়ে আসার কথা। আচ্ছা, শোনো, প্লেন কি ডিজেলে চলে? তাহলে তো প্লেনের ভাড়া বাড়বে, তাই না?’
‘হুঁ, দুনিয়ার সব ডিজেলে চলে, আমি জুনায়েদ, আমিও ডিজেলে চলি! রাখি...।’
অফিস থেকে বের হয়ে ট্রাভেল এজেন্সিতে গেলাম টার্কি ভিসার ব্যাপারে। সেখানে বলল, কাল পাসপোর্ট আর ছবি নিয়ে যেতে। গুলশানের এক স্টুডিওতে ঢুকে টাই বেঁধে চেয়ারে বসেছি। জানেনই তো, তারপর ক্যামেরাম্যান কী বলবেন। ‘থুতনিটা একটু উঠবে, মাথা একটু ডাইনে কাইত হবে...’—এই সবই তো, তাই না? ক্যামেরাম্যান আমাকে পজিশনে বসিয়ে বললেন, ‘ভাই, আজকে ছবির খরচ একটু বেশি লাগব। ডিজেলের দাম বাড়ছে তো।’
‘কী! ডিজেলের দাম বাড়লে আপনার কী? আপনার ক্যামেরা ডিজেলে চলে নাকি?’
‘ক্যামেরা না, ভাই, মার্কেটে সারা দিন কারেন্ট নাই, জেনারেটরে চলতাছে সব। জেনারেটর আবার চলে ডিজেলে, এই জন্য আরকি! আচ্ছা ভাই, স্মাইল প্লিজ! এক দুই তিন...।’ ক্লিক!
রাগে গা রি রি করছে, কিন্তু চেহারায় সেটা বোঝানো যাবে না। আবার ব্যাটা এমন এক সিচুয়েশনে বসিয়ে ব্যাপারটা বলেছে, হাসি ভাবটাও ধরে রাখতে হচ্ছে! কী একটা অবস্থা!
ছবি তোলার কাজ শেষ করে বাসার পথ ধরতেই বাড্ডা লিংক রোডে দেখলাম, মাছের মেলা বসেছে। টাটকা কিছু মাছ দেখে দাম জিজ্ঞেস করলাম, বলল, ‘স্যার, নেন। একদম টাটকা, বারো শ টেকা কেজি মাত্র!’
‘বারো শওও! তিন দিন আগেই তো দেখলাম সাত শ না আট শ করে ডাকতাছো!’
‘ডিজেলের দাম বাড়ছে না, স্যার!’
‘আরে! ডিজেলের দাম বাড়লে তোমার কী? মাছ কি ডিজেল খাইয়া বড় হইছে?’
‘স্যার, ডিজেল ইঞ্জিনের ট্রলারে ধরা মাছ! ডিজেলের দাম বাড়ছে দেইখা মহাজন মাছের দাম বাড়ায়া দিছে। আমরা কী করুম, কন!’
‘লাগব না তোমার মাছ, তুমার এই কুপিবাত্তিও কি ডিজেলে চলে?’
মাছওয়ালা ফিচেলমার্কা একটা হাসি দিয়ে বললেন, ‘না স্যার, ওইটা কেরোসিনের কুপি। আপনাগো দোয়ায় কেরোসিনের দামও বাড়ছে!’
সেখানে আর থাকার পরিবেশ নেই। আমি মোটরসাইকেল আবার স্টার্ট করলাম। একটু সামনেই গাড়ির বিশাল জটলা। সামনে একটা বাসে নাকি মারামারি চলে। সামনের রিকশাওয়ালা দেখি বাসের ভেতরের লাইভ অ্যাকশন সিনেমা দেখতে রিকশাটা যানজটে দাঁড় করিয়ে সামনে এগিয়ে গেলেন। রিকশাওয়ালা ফিরে আসার পর জিজ্ঞাসা করলাম, ‘ঘটনা কী? ওই বাস এমন কোমর ব্যাকাইয়া রাস্তার মাঝে দাঁড়াইয়া আছে ক্যান?’
‘আরে মামা, ভাড়া নিয়া ক্যাচাল। গ্যাসের গাড়ি, কন্ডাক্টর যাত্রীর কাছে বলে ডিজেল গাড়ির কথা কইয়া বেশি ভাড়া নিছে। যাত্রীও কম না, গাড়ি থামাইয়া বাসের তলে গ্যাসের ট্যাংকি খুইজ্জা বাইর কইরা ফালাইছে! এখন মারামারি করতাছে যাত্রী আর কন্ডাক্টর, ফাটাফাটি অবস্থা!’
দেশে কী এক তেলবাজি শুরু হলো ভাবতে ভাবতে ট্রাফিক পুলিশ এসে যানজট কিছুটা ছাড়িয়ে দিলেন। এর মধ্যে পকেটে ফোনটা বেজেই যাচ্ছে। বাইকটা সাইড করে ইমার্জেন্সি ভেবে ফোন ধরলাম। ওপাশ থেকে ভেসে এল, ‘স্লামালেকুম স্যার, আমাদের মুরগির ডিমের ওপর কিছু অফার ছিল, সাথে তেল, মসলা...’।
‘আপনাদের কাছে ডিজেল হবে?’
‘জি, স্যার?’
‘ডিজেল, ডিজেল! তেলের কথা বললেন না? ডিজেল তো এক প্রকার তেল, জানেন তো?’
‘স্যার, আপাতত আমাদের সয়াবিন তেলের ওপর অফার চলছে!’
‘কিন্তু জাতির এখন ডিজেলের ওপর অফার দরকার, পুরো দেশ চলে ডিজেলে আর আপনারা দিয়ে রেখেছেন সয়াবিন তেলে অফার! আপনাদের কোম্পানিকে ওটার জন্য অফার দিতে বলুন!’
‘ধন্যবাদ, স্যার, আপনার মতামতের জন্য! আপনার মতামতটি যথাযথ কতৃ...’। লাইনটা কেটে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা ফোন। ভাবলাম, এবার আবার কোন অফার! তবুও কী মনে করে ধরলাম।
‘জুনায়েদ ভাই, মানিক বলছিলাম। আপনার বন্ধু বাপ্পির চাচাতো ভাইয়ের ছোট বোনের পাশের বাড়ির বান্ধবীর ছোট ভাই। বাপ্পি ভাই আপনার নম্বর দিল। আমার একটা বিশাল কাজ আছে সামনে। আপাতত একটু কম বাজেটে লোগো আর ব্র্যান্ড পোর্টফোলিওটা দাঁড় করিয়ে দিতে হবে।’
‘“সামনের বিশাল কাজ” পরে, ব্র্যান্ডিং প্যাকেজের জন্য **** টাকা নিই আমি। বাসায় গিয়ে কোটেশন পাঠিয়ে দিচ্ছি আপনাকে। মেইল অ্যাড্রেসটা টেক্সট করে রাখেন।’
‘কী বলেন, ভাই! আপনার তেল লাগে না, মালমসলা লাগে না, তবু এত চান?’
এবার আমার মেজাজ গেল বিগড়ে, ‘কে বলেছে তেল লাগে না? আমি জুনায়েদ, আমি ডিজেলে চলি। আমার কলম, কম্পিউটার সব ডিজেলে চলে! ডিজেলের দাম বাড়ছে, জানেন তো? ডিজেলচালিত সব সার্ভিসের চার্জ বেড়েছে ২৭ পারসেন্ট। আমার ডিজাইন ফি–ও ২৭ পারসেন্ট বাড়িয়েছি। ফুল অ্যান্ড ফাইনাল!’
ওপাশ থেকে টুট টুট একটা আওয়াজ হলো। পারিশ্রমিকের অঙ্কটা শুনে ওপাশের মোবাইলের ডিজেল শেষ হয়ে গেল কি না ঠিক বোঝা গেল না!