সাফল্য হলো অগ্রগতিতে ব্যর্থতা।
সাফল্য নিয়ে এ কথা বলেছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন, পৃথিবীর মানুষ যাঁর গুণমুগ্ধ। আইনস্টাইনের প্রসঙ্গ এলে একটু খেয়াল করলে দেখবেন, তাঁর মাথা নিয়ে মানুষ বিস্মিত হয়। বলা হয়, তাঁর মাথা আর দশজনের চেয়ে আলাদা ছিল। তবে আরেকটা কথাও শোনা যায় মাঝেমধ্যে। সেটা কী? আইনস্টাইন নাকি ছেলেবেলায় গণিত পরীক্ষায় ফেল করেছিলেন। বিশ্ব, সময় ও স্থান সম্পর্কে মানুষের হাজার বছরের ধারণা যিনি পাল্টে দিয়েছেন, সেই আইনস্টাইন গণিতে ফেল করেছিলেন! তাঁর মতো এতটা সফল মানুষের অতীতে এমন ব্যর্থতাও ছিল? আদতেই কি তা–ই? নাকি এটি বিখ্যাত ব্যক্তির ব্যর্থতা থেকে অনুপ্রেরণা খোঁজার আরেক গল্প?
আইনস্টাইন সম্পর্কে চমৎকার বলেছিলেন আরেক বিস্ময় পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং। তিনি মনে করতেন, এমন এক দিন আসবে, যেদিন সময়ের কিংবা দুনিয়ার সম্পূর্ণ ইতিহাস লিখে ফেলা যাবে চার পৃষ্ঠায়, আর তার তিন পৃষ্ঠাজুড়ে থাকবে কেবল আইনস্টাইনের নাম।
হকিংয়ের এ কথার পর আর কোনো বিশেষণ প্রয়োজন হয় না। আইনস্টাইন সম্পর্কিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় নিবন্ধের সংরক্ষণাগার আছে ইসরায়েলে। সেখানকার সব নিবন্ধই যে সত্য, তা অবশ্য অনেকেই মানেন না। তবে তাঁর জীবন সম্পর্কে জানতে ওই সংরক্ষণাগার নির্ভরযোগ্য নিঃসন্দেহে। এ ছাড়া অনেকের জীবনীতে আইনস্টাইনের ছেলেবেলার কথা উঠে এসেছে।
তো সেসব নথিপত্র ও লেখা থেকে জানা যায়, আইনস্টাইন তিন কিংবা চার বছর বয়স পর্যন্ত কথা বলতে শেখেননি। এ নিয়ে দারুণ এক গল্প আছে। চার বছর পর্যন্ত যখন তিনি কথা বলছিলেন না, তখন তাঁর মা-বাবার চিন্তার শেষ নেই। একদিন হঠাৎ খাবার টেবিলে নির্বাক আইনস্টাইন বলে উঠলেন, ‘স্যুপটা খুব গরম!’
মা–বাবা তো আকাশ থেকে পড়লেন, ‘এত দিন কথা বলোনি কেন?’
আইনস্টাইন জীবনের দ্বিতীয় বাক্যটি ব্যবহার করলেন এভাবে, ‘এত দিন তো সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল।’
কথা না হয় হলো, আইনস্টাইন পড়তেও শিখেছিলেন বেশ দেরিতে—সাত বছর বয়সে। ৯-১০ বছর বয়সেও কিছুটা থেমে থেমে কথা বলতেন। ফলে পরিবারের দুশ্চিন্তা কমছিল না। ভেবেছিলেন, ছেলেটার মাথা বুঝি আর খুলবে না। আশঙ্কাটা আরও পোক্ত হয়েছিল আইনস্টাইন বেজায় শান্তশিষ্ট লাজুক ছিলেন বলে। সমবয়সীদের থেকে একেবারেই আলাদা। খেলাধুলা, দৌড়ঝাঁপে তো মোটেও আগ্রহ ছিল না।
এটা তো জানেনই, আইনস্টাইনের জন্ম জার্মানিতে। ১৫ বছর পর্যন্ত সেখানকার স্কুলেই পড়াশোনা করেছেন। জার্মানির মিউনিখে তাঁর স্কুলজীবনের দিকে তাকালে দেখা যাবে, আইনস্টাইন ছাত্র হিসেবে বেশ ভালো ছিলেন। কেবল ভালো বললে কম বলা হবে, বরং ‘ব্যতিক্রমী’ বলাই জুতসই। পরীক্ষায় মোটামুটি সর্বোচ্চ নম্বর পেতেন। অবশ্য ভীতি ছিল যন্ত্র সম্পর্কিত বিষয়গুলোতে। জার্মানিতে সে সময় সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া বাধ্যতামূলক। আইনস্টাইন তা ভীষণ অপছন্দ করতেন। তাই জার্মানি ত্যাগ করতে বাধ্য হন ১৫ বছর বয়সে। তার আগপর্যন্ত যত পরীক্ষা দিয়েছেন, সব কটিতেই ধারাবাহিকভাবে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছেন। এমনকি জটিল গাণিতিক ও বৈজ্ঞানিক ধারণা সহজেই বোঝার জন্য শিক্ষকেরা তাঁকে আলাদাভাবে চিনতেনও।
আইনস্টাইন বেঁচে থাকতেই তাঁর গণিতে ফেল করার গল্পটি মুখে মুখে রটে গিয়েছিল। এমনকি একসময় সংবাদমাধ্যমেও চলে আসে। অথচ আইনস্টাইন বলেছিলেন, ‘আমার বয়স ১৫ বছর হওয়ার আগেই অন্তরকলন ও সমাকলন ক্যালকুলাস আয়ত্ত করেছিলাম।’ সুতরাং এ থেকে এটা অন্তত স্পষ্ট যে আইনস্টাইন আর যা–ই হোক গণিতে মোটেও কাঁচা ছিলেন না, ফেল করার প্রশ্ন তো আরও দূরের।
তবে তিনি যে কখনো কোনো বিষয়ে ফেল করেননি, তা বলা ঠিক হবে না। গণিতে তিনি বরাবরই ভালো করেছেন। সুইজারল্যান্ডের জুরিখ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে ১৬ বছর বয়সে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সময় গণিতে যথেষ্ট ভালো করলেও ভাষা, উদ্ভিদবিদ্যা এবং প্রাণিবিদ্যায় ডাব্বা মেরেছিলেন তিনি। পরীক্ষায় যা লিখেছিলেন, তাতে বেশ কিছু ভুলভাল ছিল।
মোটকথা, গণিতে আইনস্টাইনের ফেল করার তথ্যটি স্রেফ ভুল। কে জানে, কৈশোরে হয়তো ভাষা, উদ্ভিদবিদ্যা এবং প্রাণিবিদ্যায় সচেতনভাবেই অতটা মনোযোগ দেননি বলে ফল খারাপ হয়েছিল। মনোযোগ দিলে ওসব বিষয়ে হয়তো ভালো করতেন। এই ধারণার পেছনে যুক্তি হিসেবে সায় দেয় আইনস্টাইনের জীবনের মজার আরেক ঘটনা। এক সহকর্মী একদিন আইনস্টাইনের টেলিফোন নম্বর চাইলেন। আইনস্টাইন তখন ঢাউস টেলিফোন বইটা নিয়ে এসে খুঁজতে লাগলেন নিজের নম্বরটাই!
সহকর্মী ভীষণ অবাক, ‘কী ব্যাপার, নিজের টেলিফোন নম্বরটাও মনে নেই আপনার?’
আইনস্টাইনের সরল স্বীকারোক্তি, ‘না। তার দরকারই-বা কী? যেটা আপনি বইয়ে পাবেন, সেটা মুখস্থ করে মস্তিষ্ক খরচ করবেন কেন?’
সূত্র: হিস্ট্রি ডটকম ও দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট