খাটের নিচে যে এত বড় চমক অপেক্ষা করছে, রঞ্জু কল্পনাও করেনি।
বাড়ির ভেতরে ঢুকতে বেগ পেতে হয়নি একদমই। জানালাগুলো পুরোনো ধাঁচের। এত বড়লোকের বাড়ি, তবু কেন যে এরা ‘উইন্ডোজ আপডেট’ করে না, রঞ্জুর মাথায় ঢোকে না।
গ্লাস খুলতে আধা মিনিট, গ্রিল খুলতে দুই। আড়াই মিনিটের মাথায় জানালা দিয়ে টপ করে ঘরের ভেতর লাফিয়ে পড়ে রঞ্জু। কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে মনে মনে বলে, ‘পিস অব কেক!’
রঞ্জুর কাছে ইনফরমেশন আছে—বাড়িতে কেউ নেই। তবু মিনিট তিনেক সময় নিয়ে পুরো ফ্ল্যাটটা একবার চক্কর দেয় সে। নাহ, সত্যিই কেউ নেই। এবার নিশ্চিন্তে মাথার সঙ্গে লাগানো টর্চটা জ্বালিয়ে নেয়। মোবাইল বের করে বাড়িটার ভিডিও ধারণ করতে শুরু করে। পেশায় চোর হলেও তার একটা আলাদা শখ আছে। সে প্রসঙ্গ আপাতত থাক।
ঝলমলে সব আসবাব। দামি শোপিস, চিকমিকে দেয়ালঘড়ি। বোঝাই যাই, বেশির ভাগই বিদেশ থেকে আনা।
এ ঘর-ও ঘর ঘুরে শোবার ঘরে পা রাখে রঞ্জু। তাড়াহুড়া নেই। রয়েসয়ে চুরি করার জন্য সারাটা রাত পড়ে আছে। বিছানায় গা এলিয়ে ছোট্ট একটা ‘ন্যাপ’ তো নেওয়াই যায়।
তুলতুলে নরম বালিশটায় মাথা রেখে ঘুমটা প্রায় পেয়েই বসেছিল। এমন সময় বিছানার নিচ থেকে খুট করে শব্দ হয়।
কে? রঞ্জু আঁতকে ওঠে। বাড়িতে কুকুরটুকুর নেই তো? বড়লোকের বিশ্বাস নেই। এদের যে কত রকম খায়েশ। মাস দুই আগে এক বাড়িতে চুরি করতে গিয়েছিল রঞ্জু। গিয়ে দেখে বিশাল এক অ্যাকুয়ারিয়াম, ভেতরে সাপ!
ভয়ে ভয়ে খাটের নিচে উঁকি দিয়েই সে চমকে ওঠে। একজন ‘ভদ্রলোক’। খাটের নিচে উপুড় হয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে! এর চেয়েও ভয়ানক ব্যাপার—লোকটা রঞ্জুর চেনা। একটু আগে রঞ্জু তাকে দেখেছে—শোবার ঘরের দেয়ালে টাঙানো ছবিতে।
মুখ দিয়ে একটা ছোটখাটো চিৎকার প্রায় বেরিয়েই যাচ্ছিল। তার আগেই ‘ভদ্রলোকটি’ রঞ্জুর মুখ চেপে ধরে। ‘চুপ! আস্তে, শব্দ করবেন না!’
রঞ্জু ঘাবড়ে যায়। আজীবন তাকে দেখে বাড়ির লোক চিৎকার করে উঠেছে। এই প্রথম উল্টোটা ঘটল।
লোকটা হামাগুড়ি দিয়ে খাটের নিচ থেকে বেরিয়ে আসে। ফিসফিস করে বলে, ‘আশপাশে প্রতিবেশীরা কেউ টের পেলে বিপদ আছে। কেউ যদি পুলিশে খবর দেয়…আপনি-আমি দুজনই ধরা খাব।’
‘আপনার বাড়িতে আপনি ধরা খাইবেন ক্যান?’ রঞ্জু প্রশ্নটা করেই ফেলে।
‘দুঃখের কথা কী আর বলব ভাই…’, বাড়ির কর্তা মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে। নিচু গলায় বলে, ‘নিজের বাড়িতে নিজেই চোরের মতো লুকিয়ে আছি।’
‘ক্যান?’
লোকটা একটু অবাকই হয়। ‘আপনি আমাকে চিনতে পারেন নাই?’
‘নাহ। তবে এই বাড়ি আপনার, সেইটা বুঝছি। কিন্তু আপনি কে, সেইটা তো জানি না।’
‘যাক, বাঁচাইলেন। শোনেন না ভাই আমার, একটা হেল্প করেন। আমি এক মাস ধরে বন্দী। রাস্তায় বের হই না পিটানির ভয়ে। যদি কিছু খাবারদাবার কিনে দিয়ে যান, খুব উপকার হয়। টাকা যা লাগে আমি দেব।’
‘আচ্ছা…বুঝছি।’ রঞ্জু এবার হাসে। ‘আপনে তাইলে সরকারি চোর।’
‘মানে?’
‘চোর দুই প্রকার। একটা সরকারি, আরেকটা বেসরকারি। সরকারি চোরেরা মনে করেন সরকারের সুবিধা নিয়া রাজার হালে চুরি করে। ব্যাংক চুরি, ব্রিজ চুরি, রাস্তা চুরি, ভবন চুরি। আর বেসরকারি চোর হইলাম আমরা। আমাগো কোনো সুযোগ-সুবিধা নাই।’
‘ভাই, আপনি যা বলেন, তা-ই সই। কিন্তু দোহাই, আমারে ধরায়ে দিয়েন না। টাকাপয়সা যা লাগে দেব।’
‘বারবার টাকাপয়সার আলাপ দিয়েন না তো। চোর হইতে পারি, আমারও একটা প্রফেশনাল ইথিকস আছে। আমরা চোর। আর আপনারা হইলেন খচ-চোর।’
গালাগাল খেয়ে বাড়ির কর্তা চুপসে যায়। কী কপাল। নিজের বাড়িতে একটা চোরের হাতে-পায়ে ধরতে হচ্ছে। মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালিয়ে যায় সে। ‘ভাই প্লিজ, পুলিশে খবর দিয়েন না। আপনার যা লাগে নিয়ে যান।’
‘আরে ভাই কইলাম তো, টাকাপয়সা লাগবে না। আমার যা পাওয়ার পাইয়া গেছি।’
‘কী পাইছেন?’
‘ভিউ।’ বলেই রঞ্জু মুচকি হাসে। পকেট থেকে মোবাইল বের করে সে ভিডিও করতে শুরু করে।
‘গায়েজ, শুরু করছি ভ্লগ নাম্বার ২২৭। গায়েজ, আজকের ভিডিও অনেক ইন্টারেস্টিং। গায়েজ, আজকে আমাদের সঙ্গে যে আছে, তাকে দেখলে তোমরা চমকে যাবে…’