‘স্যার, খবর শুনছেন নাকি! আমাদের অফিসে নতুন বস জয়েন করতে যাচ্ছেন, নেক্সট উইকে।’ হাঁপাতে হাঁপাতে এসে দুঃসংবাদটা জানাল আমাদের অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টের জুনিয়র অফিসার শাকিল।
দিনটা ছিল শরতের এক রৌদ্রোজ্জ্বল সকাল। মাত্রই অফিসে এসে ইউটিউবটা খুলে আরাম করে বসেছিলাম। উপমহাদেশের নতুন প্রজন্মকে এক সুতোয় বেঁধে রাখা ভারতীয় অভিনেত্রী তৃপ্তি দিমরির একটা নতুন আইটেম সং এসেছে কাল রাতে। সেটা মন দিয়ে দু–তিনবার দেখে একটা কর্মব্যস্ত দিনের সূচনা করব—এমনটাই ভেবে রেখেছিলাম। কিন্তু সাতসকালেই তৃপ্তি দিমরির মতো শরীর বাঁকিয়ে শাকিল এমন একটা দুঃসংবাদ দেবে, ভাবতে পারি নাই।
মনে মনে ‘খাইছে রে’ বললেও মুখে বিরক্তি দেখিয়ে বললাম, ‘নতুন বস আনার কী দরকার! আমরা কি ঠিকমতো কোম্পানি চালাতে পারছি না?’
শাকিল বলল, ‘মালিকপক্ষ নাকি আমাদের কাজকর্মে সন্তুষ্ট না। শুনেছি আমাদের টাইট দেওয়ার জন্য নতুন বসকে তারা অ্যাপয়েন্ট করেছে, সিইও হিসেবে।’
শাকিলের কথা শুনে মনটাই খারাপ হয়ে গেল। মালিকপক্ষ আমাদের ভাবে কী! দিনরাত খেটে মরছি তো এই কোম্পানির জন্যই, নাকি? কম্পিউটার স্ক্রিনে থমকে থাকা তৃপ্তি দিমরির দিকে আনমনেই প্রশ্নটা ছুড়ে দিলাম।
‘স্যার, নতুন বসকে বরণ করা সংক্রান্ত একটা কমিটি গঠন করা হয়েছে। আপনি সেই কমিটির উপপ্রধান। জামিল স্যার আপনাকে এখনই মিটিংরুমে যেতে বলেছেন।’ শাকিলের গলায় উত্তেজনা স্পষ্ট।
জামিল ভাই হচ্ছেন আমাদের স্থানীয় এইচআর ম্যানেজার। সবার আদেশ অমান্য করা যায়, শুধু বউ আর এইচআর কর্তাদের আদেশ বাদে।
মিটিংরুমে গিয়ে দেখি প্রচুর হাউকাউ। নতুন বস আসার খবরে সবাই মনে হয় উত্তেজিত। কিন্তু খানিকক্ষণ ওদের কথাবার্তা শোনার পর ভুল ভাঙল। মিটিংয়ে কি নাশতা আনা হবে, সেটা নিয়ে কমিটির সদস্যরা কয়েক ভাগে বিভক্ত। কারও দাবি পিৎজা, আবার কেউ কলিজার শিঙাড়া খাওয়ার জন্য নানা রকম স্বাস্থ্যসম্মত যুক্তি দিচ্ছে।
আধঘণ্টা পর সবাই যখন পিৎজা খাওয়ার জন্য প্রায় একমত হলো, তখন জামিল ভাই জানালেন, ‘সরি গাইজ, আজকে খাঁটি সরিষার তেল দিয়া মুড়ি মাখা ছাড়া আর কিছু হবে না। নতুন বস আসতেছেন, আপনাদের খাওয়ার পেছনে এখন বাড়তি খরচ করা যাবে না।’
অন্যদিন হলে মুড়িমাখা নিয়ে নানা প্রতিবাদ আসত, কিন্তু আজকে সবাইকে দেখলাম বিনা বাক্যব্যয়ে জামিল ভাইয়ের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছে। ইংরেজিতে এমন সিচুয়েশনকেই বোধ হয় ‘দ্য বাটারফ্লাই ইফেক্ট’ বলে।
জামিল ভাই প্রজেক্টর চালু করতে করতে বললেন, ‘আপনাদের এখন নতুন বসের ছবি দেখাচ্ছি। সবাই মন দিয়ে দেখেন আর সাজেশন দেন—কীভাবে প্রথম দিনে তাঁকে ইম্প্রেসিভ ওয়েতে রিসিভ করা যায়।’
ভেবেছিলাম বুড়া হাবড়া টাইপের কেউ আমাদের বস হয়ে আসছে। কিন্তু প্রজেক্টরে যার ছবি দেখলাম, তাতে সবারই চক্ষু চড়কগাছ। পাতলা ছিপছিপে, সুঠাম দেহের অধিকারী, কোমল-কঠোরে মেশানো একখানা অল্পবয়সী তরুণের মতো চেহারা আমাদের সম্ভাব্য নতুন বসের। এই লোকের তো মাসুদ রানার মতো এসপিওনাজ এজেন্ট হওয়ার কথা, সে কিনা হতে যাচ্ছে আমাদের সিইও! ছ্যাঁ ছ্যাঁ ছ্যাঁ।
জামিল ভাই আমাদের বেশির ভাগের মনোভাব বুঝে নিয়ে বললেন, ‘আমাদের নতুন বস হয়তো অনেকেরই বয়সে ছোট হবেন, তবে তিনি কিন্তু এই বয়সেই একটা সমৃদ্ধ ক্যারিয়ার অর্জন করেছেন। দু–দুটি আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়েছেন অলরেডি।’
ঝাড়ু মারি তোমার ওই আন্তর্জাতিক পুরস্কারের ওপর—মনের কথা মনে রেখেই মুখে বললাম, ‘বাহ! ভেরি ইম্প্রেসিভ! নতুন স্যারকে বরণ করার ক্ষেত্রে তাহলে কোনো কমতি রাখা যাবে না।’
বাকিরাও একমত হলো আমার কথায়। একমত না হয়ে অবশ্য উপায় নাই কারও। প্রত্যেকে আমরা বসের তরে—এই নীতিতে আমরা সবাই কোমরের কাছটায় একটা করে তেলের ড্রাম নিয়ে ঘুরে বেড়াই।
তো একটা দীর্ঘ মিটিং শেষে আমরা কয়েকটা সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম। নতুন বস যেদিন আসবেন, সেদিন ভোরবেলায় সবাই তাড়াতাড়ি অফিসে উপস্থিত হব। প্রতিটি ডিপার্টমেন্ট থেকে একজন করে ফুলের তোড়া উপহার দেবে নতুন বসকে। এরপর নতুন বসের বর্ণাঢ্য জীবন সম্পর্কে ছোট করে জানিয়ে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেবেন জামিল ভাই। মার্কেটিং ডিপার্টমেন্ট থেকে নোরা গাইবে, ‘এসো হে সিইও এসো এসো’ শিরোনামে স্বাগত সংগীত। আর সবশেষে কাঁপা কাঁপা গলায় আমাকে পড়ে শোনাতে হবে বিশেষ মানপত্র।
হাতে যেহেতু সময় কম, তাই সবাই দ্রুত প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য যার যার ডেস্কে চলে গেলাম। আমার ডেস্ক কম্পিউটারে তখনো তৃপ্তি দিমরি ‘পজড’ হয়ে আছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তৃপ্তি দিমরির বদলে হাতে কলম তুলে নিলাম। একটা ঠিকঠাক মানপত্র না হলে নতুন বসের সামনে আমার ‘মান’টা ঠিকমতো উপস্থাপিত হবে না যে।
দেখতে দেখতে চলে এল সেই (অনাকাঙ্ক্ষিত) দীর্ঘ প্রতীক্ষিত দিন। অতি উত্তেজনার কারণেই হয়তো সেদিন আমাদের সবারই অফিসে পৌঁছাতে দেরি হয়ে গেল। ফলে যে ফুলের তোড়া নতুন বসকে দেওয়ার কথা, সেই তোড়া দিয়েই নতুন বস আমাদেরকে একে একে অফিসে বরণ করে নিলেন। গলাব্যথার অজুহাত দেখিয়ে নোরা গান গাইল না, আমারও গলা অনেক বেশি কাঁপাকাঁপি করায় মানপত্র পড়ার রিস্কে গেলাম না।
নতুন বস আমাদের উদ্দেশে ছোট করে বক্তৃতা দিলেন। যার সারমর্ম হলো এই, কোম্পানির বিশালত্বের তুলনায় কর্মিসংখ্যা অত্যন্ত ছোট। ফলে আমাদের কষ্ট কমানোর জন্য খুব তাড়াতাড়ি কোম্পানিতে বিশাল নিয়োগ দেওয়া হবে।
বিশাল নিয়োগ মানে বসের আগের কোম্পানি থেকে একঝাঁক প্রতিভাবান কর্মীরা এসে ধীরে ধীরে আমাদের জায়গা দখল করবে। এসব করপোরেট কালচার আমরা খুব ভালো করেই বুঝি। দীর্ঘদিনের চর্চা বলে কথা! বলিউডে সদ্য হাউকাউ হলেও আমাদের এখানে নেপোটিজমের শিকড় গেড়ে আছে সৃষ্টির শুরু থেকেই।
নতুন বস আসার দিন থেকে তাই তৃপ্তি দিমরির বদলে ব্রাউজার হিস্টোরিতে যোগ হলো চাকরি খোঁজার সাইটগুলো।
ইদানীং জেমসের গানটা খানিকটা বদলে গুনগুন করে গেয়ে উঠি প্রায়ই, ‘একটা চাকরি হবে? চাকরি?’