১.
এক লোক ডিম কিনতে গেছে। লোকটি খুব লম্বা। ডিমওয়ালার দোকানে গিয়ে দর-কষাকষি করার জন্য ডিমওয়ালাকে সে জিজ্ঞেস করে, ‘ডিমের হালি কত?’
ডিমওয়ালা: তিন ট্যাকা। লন লন, খুব হস্তায় দিছি।
ক্রেতা: এতটুকু কবুতরের আন্ডার মতো ডিমের দাম তিন টাকা?
বিক্রেতা: ছাব, আপনে তো হালায় তালগাছটার হমান লম্বা। দেখতাছেন তো আসমান থাইক্যা। একটু নিচা অইয়া দেহেন, দেখবেন আমার আন্ডা ফুটবলের হমান।
২.
কলতাবাজারে এক ভদ্রলোক বাজার করতে গেছেন। ঢাকায় নতুন এসেছেন তিনি। গ্রাম থেকে আসা আনকোরা মানুষ এসহাক ভূঁইয়া। ঢাকা শহর তাঁর কাছে বিস্ময়। আলো ঝলমল শহর। পিচঢালা রাস্তা। হরেক কিসিমের লোকজন। গাড়ি-ঘোড়া। সিনেমা-বায়োস্কোপ তামাশা বেশুমার। মানুষের এত তকিচকি, মক্কর-সক্কর যে তাল ঠিক রাখা কঠিন। লোকজনের মুখ দেখে মনের ভাব-চক্কর বোঝা যায় না। লোকে চোখেমুখে কথা বলে। তো এই সব দেখেটেখে এসহাক ভূঁইয়া সব সময় ভেতর-গুঁজা হয়ে থাকেন। কথাটথাও বলেন খুব কম।
এই এসহাক ভূঁইয়াকে বাজারে যেতেই হলো। বাসায় মেহমান আসবে। ভালো দেখে মুরগি কিনতে বলা হয়েছে তাঁকে। মোটাতাজা, চনমনে মুরগি। মুরগিহাটায় যেতেই চারদিক থেকে হইচই সহকারে তাকে ছেঁকে ধরে মুরগির দোকানের লোকজন। কেউ বলে, ‘লইয়া যান, ব্যাপারী ছাব। একেরে মাখ্খন (মাখন)। এমুন মাল আর পাইবেন না।’ আবার কেউ বলে, ‘পানির দরে দিছি, লন লন। দেখতাছেন না, ত্যাল চুয়াইয়া পড়তাছে। ইম্মুন আন্ডা-পাড়া মুরগি পাইবেন কই!’ কেউবা বলে, ‘ট্যাকার অভাবে বেচি। নাইলে হালায় ইমুন কড়কড়া মুরগি ব্যাচে কোন ব্যাক্কলে!’
এত কথা শুনে এসহাক ভূঁইয়া ভড়কে যান। কী করবেন ঠিক ভেবে পান না। এর মধ্যে একটু বয়স্ক এক দোকানদারের মুরগির খাঁচার কাছে গিয়ে দাঁড়ান এসহাক। লোকটি বলে, ‘আহেন ব্যাপারী ছাব। ১ নম্বর মুরগি দিমু। গোস্ত খাইয়া কইবেন, হালায় পঙ্খিরাজের গোস্ত খাইছেন। দামিভি খুব কম লাগাইছি।’ মুরগিওয়ালা মুরগির রশি হাতে ধরিয়ে দিয়ে দেয় আরকি!
এসহাক ভূঁইয়ার মনে হয়, এ মুরগি ভালো না। অসুখওয়ালা মুরগি। তো তিনি বলেন, ‘না, মুরগি তো ঝুমছে, এ মুরগির রোগ আছে। নেব না।’ মুরগিওয়ালা জিব কেটে বলে, ‘ওই হালার মুরগি, হুনছ তো, ব্যাপারী ছাব কইত্যাছে কী? তরে না কইছিলাম, ছারা রাতি কাওয়ালি হুনিছ না। তাইলে দিনের বেলায় ঝুমবি। অহন কেমুন অইল! ছাবে তো অহন মুরগি লইব না। হেয় কয় তর অছুক। অছুক-বিমার না ছাব। অই ছারা রাতি কাওয়ালি হুনছে তো, তাই দিনেরটায় ঝিমাইবার লাগাইছে।’
৩.
এক ভদ্রলোক তাঁর ছেলেকে নিয়ে চকবাজারে গেছেন ফজলি আম কিনতে। বিভিন্ন দোকানে ঘুরে ঘুরে তিনি আম পরীক্ষা করে দেখছিলেন। শেষে এক বিক্রেতার কাছে এসে আম দেখতে চাইলেন। বিক্রেতা ভদ্রলোককে বিভিন্ন দোকানে আম নিয়ে দরাদরি করতে দেখেছিলেন। তাঁর দোকানে আসার পর দোকানি বলেন, ‘ছাব, এমুন মাখনের লাহান আম আর পাইবেন না। ইমানে কইতাছি, আমার আম বেছ্তের মেওয়ার মতো মিঠা।’
ভদ্রলোক বলেন, ‘ওই রকম তো সকলেই কয়। খেতে গিয়ে দেখি পানসে, না হলে টক।’
আমওয়ালার ত্বরিত উত্তর, ‘হায় হায় হায়! ছাবে কয় কী! আমার চৌদ্দ পুরছেও চুকা আম ব্যাচে নাইক্যা। আমরা মিঠা আম বেচি দেইখ্যা আব্বাজান আমার নাম রাখছে মিঠা খাঁ। আম চুকা অইলে আমার নাম বদলাইয়া বান্দর আলি রাইখেন।’ এই কথা বলে আমওয়ালা ধারালো ছুরি দিয়ে একটি আম থেকে ঘ্যাচ করে এক টুকরো আম কেটে ভদ্রলোকের হাতে দিয়ে বলেন, ‘ছাব, আজাইরা প্যাচাল পাইড়া লাভ নাই। খাইয়া টেছ্ কইরা লন।’
ক্রেতা আমের টুকরো হাতে নিয়ে মুখে দেন। চেখে দেখে বলেন, ‘না, তেমন মিঠা না।’ আমওয়ালা তখন আরেক চাক আম কেটে ভদ্রলোকের ছেলের হাতে দিয়ে বলেন, ‘আব্বাজান, আপনে খাইয়া কন তো, আম মিঠা কি না।’ ছেলে বলে, ‘মিঠা।’
ভদ্রলোক বলেন, ‘তুই ছেলেমানুষ, তোর কাছে সব আমই তো মিঠা লাগে। চল চল, অন্য দোকানে যাই।’
মিঠা খাঁ গোঁফে হাত বুলিয়ে একটু মুচকি হাসেন। ওদিকে ভদ্রলোক ছেলের হাত ধরে সামনের দোকানের দিকে পা বাড়াচ্ছেন। আমওয়ালা তখন রসভরা কণ্ঠে বলেন, ‘ছাব, খাড়ন খাড়ন, যাইয়েন না।’ ইতিমধ্যে আমওয়ালা চটজলদি আরেক টুকরো আমের ফালি কেটে ভদ্রলোকের হাতে গুঁজে দিয়ে বলেন, ‘ছাব, আপনে টেছ করছেন, আপনের পোলাও ভি টেছ করছে, আমার আম পছন্দ অয় নাইক্কা। এই টুকরাডা দিলাম, বাইত্তে যাইয়া ভাবি ছাবরে দিয়া টেছ করাইয়েন। হ্যায় যদি আম মিঠা কয়, তয় আবার আইয়া লইয়া যাইয়েন।’
সূত্র: ঢাকাই রঙ্গ-রসিকতা বই থেকে
শামসুজ্জামান খান: বাংলাদেশি লোকসংস্কৃতি ও পল্লিসাহিত্য গবেষক ও বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক। তাঁর লেখা বইগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের লোককাহিনি, বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা, রাষ্ট্র ধর্ম ও সংস্কৃতি, বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস, গ্রামবাংলার রঙ্গগল্প অন্যতম। শামসুজ্জামান খানের জন্ম মানিকগঞ্জে, ১৯৪০ সালে। মৃত্যু ২০২১ সালে।