ভারত মহাসাগরের উপকূলে ভয়াবহ সুনামির আঘাত

সুনামি আঘাত হানার পর সুমাত্রার বান্দা আচেহর শহরতলীর দৃশ্য
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

ভারত মহাসাগরের উপকূলবর্তী বিভিন্ন দেশের সমুদ্রসৈকতে তখন বড়দিনের ছুটি কাটাতে আসা পর্যটকের আনাগোনা, সঙ্গে আছে স্থানীয় মানুষের কর্মচাঞ্চল্য। হঠাৎ খামখেয়ালি সমুদ্র যেন দুলে উঠল। ভাটার টানের মতো পিছু হটতে শুরু করল সমুদ্রের পানি। যেন মানুষের কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে সমুদ্র। এর কিছুক্ষণ পরই ফিরে এল প্রাচীরসমান ঢেউ নিয়ে। এক নিমেষে হাজার হাজার মানুষকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল অতল সমুদ্রে। ২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর ভারত মহাসাগরের উপকূলবর্তী ১৪টি দেশে এভাবেই হানা দিয়েছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বিধ্বংসী সুনামি।

ভারত মহাসাগরের উপকূলবর্তী ১৪টি দেশে এভাবেই হানা দিয়েছিল ইতিহাসের সবচেয়ে বিধ্বংসী সুনামি
জিআইএফ: উইকিমিডিয়া কমনস

সেদিন ইন্দোনেশিয়ার দক্ষিণ সুমাত্রা থেকে ১০০ মাইল পশ্চিমে সমুদ্রগর্ভের প্রায় ১৯ মাইল নিচে উৎপন্ন হয় ৯ দশমিক ৩ মাত্রার ভূকম্পন। ইন্দোনেশিয়ার স্থানীয় সময় ৭টা ৫৮ মিনিটে শুরু হওয়া ভূকম্পনটি ৮ থেকে ১০ মিনিট স্থায়ী হয়। এই কম্পন এতটাই শক্তিশালী ছিল যে যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা পর্যন্ত কেঁপে ওঠে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিরোশিমায় ফেলা পারমাণবিক বোমার চেয়ে ২৩ হাজার গুণ বেশি শক্তিশালী ছিল ভূকম্পনটি। ভূকম্পন পরিমাপক যন্ত্র উদ্ভাবনের পর ১৯৬০ সালে চিলির ৯ দশমিক ৫ মাত্রার ভূকম্পনের পর এটি ছিল সবচেয়ে বেশি মাত্রার ভূকম্পন। মাত্রার দিক দিয়ে দ্বিতীয় হলেও সময়ের দিক দিয়ে এটি ছিল ইতিহাসের দীর্ঘতম ভূকম্পন।

দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে সুদূর আফ্রিকা পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের উপকূলে আঘাত করে এই ভয়াবহ সুনামি। কোথাও কোথাও প্রায় ১০০ ফুট উঁচু ঢেউ উপকূলে আছড়ে পড়ে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো ছিল ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, ভারত ও থাইল্যান্ড। সুনামিতে মোট ১ লাখ ৯০ হাজার লোকের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয় এবং আরও ৪০ থেকে ৪৫ হাজার লোক নিখোঁজ হয়। গৃহহীন হয় আরও কয়েক লাখ মানুষ। ভূকম্পনের পর সুনামি আসতে বেশ কয়েক ঘণ্টা সময় লাগলেও সমুদ্রতটের অধিকাংশ মানুষই বিপদ উপলব্ধি করতে পারেননি। সুনামির ঢেউ মানুষের পাশাপাশি ভাসিয়ে নিয়ে যায় হাজার হাজার ঘরবাড়ি ও যানবাহন।

সুনামিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ইন্দোনেশিয়া। ভূকম্পন সৃষ্টির ১৫ মিনিটের মধ্যে প্রায় ১০০ ফুট উঁচু ঢেউ সুমাত্রা দ্বীপের উত্তর প্রান্তে বান্দা আচেহ প্রদেশের একটি ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে আছড়ে পড়ে। কয়েক মিনিটের মধ্যে বসতির সমস্ত লোকজন পানিতে ভেসে যায়। সমুদ্রের পানি উপকূল থেকে লোকালয়ের প্রায় ৪ কিলোমিটার পর্যন্ত ভেতরে চলে যায়। এতে দ্বীপরাষ্ট্রটির ১ লাখ ৭০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়।

সুনামির সাক্ষী হয়ে থাকা বান্দা আচেহ শহর
ছবি: উইকিমিডিয়া কমনস

ভূকম্পনের ৯০ মিনিট পর সুনামি আঘাত হানে শ্রীলঙ্কায়। সেখানে মারা যায় ৩৫ হাজারের বেশি মানুষ। একটি যাত্রীবাহী চলন্ত ট্রেন সুনামির আঘাতে উল্টে যায় এবং ১ হাজার ৭০০ জন যাত্রী প্রাণ হারায়। ভারতে প্রায় ১০ হাজার এবং থাইল্যান্ডে ৮ হাজার মানুষ মারা যায়। ভূকম্পনের ১৬ ঘণ্টা পর ৫ হাজার ৩০০ মাইল দূরে দক্ষিণ আফ্রিকাতেও ৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস আছড়ে পড়ে এবং ৮ জন প্রাণ হারায়। সেদিন বাংলাদেশেও ভূকম্পন অনুভূত হয়েছিল। তবে তুলনামূলক কেন্দ্রের কাছাকাছি দেশ হওয়া সত্ত্বেও খুব কম হতাহতের ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশের উপকূলে প্রায় আট ফুট উঁচু ঢেউয়ের সৃষ্টি হয় এবং প্রাণ হারায় দুজন।