ব্র্যাড পিটকে পাশ্চাত্য বিনোদন শিল্পের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের একজন হিসেবে উল্লেখ করা হয়। একাডেমি অ্যাওয়ার্ড বা অস্কার, ব্রিটিশ একাডেমি ফ্লিম অ্যাওয়ার্ড, এমি অ্যাওয়ার্ডসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন পিট। বহু বছর ধরে বিভিন্ন গণমাধ্যম জরিপে সবচেয়ে আকর্ষণীয় অভিনেতা হিসেবে উঠে এসেছে তাঁর নাম। সারা বিশ্বের সিনেমাপ্রেমীদের কাছে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ব্যাপক চর্চার বিষয়।
উইলিয়াম ব্র্যাডলি পিটের জন্ম ১৯৬৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমায়। বাবা ছিলেন পরিবহন ব্যবসায়ী ও মা স্কুলশিক্ষিকা। পিটের জন্ম ওকলাহোমায় হলেও তাঁর ছোট দুই ভাইবোনের জন্ম মিসৌরির স্প্রিংফিল্ডে। পিট হাইস্কুলে পড়াশোনার সময় গলফ, সাঁতার ও টেনিস দলের সদস্য ছিলেন। স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন। ১৯৮২ সালে মিসৌরি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন পিট। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে হঠাৎ অভিনয়ের কথা চিন্তা করেন। যদিও তখন পর্যন্ত অভিনয় করার কোনো অভিজ্ঞতা তাঁর ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা অসম্পূর্ণ রেখেই ১৯৮৬ সালে মাত্র ৩২৫ ডলার পকেটে নিয়ে পাড়ি জমান লস অ্যাঞ্জেলসে। সেখানে গিয়ে নানা ধরনের কাজ করেছেন পিট। একপর্যায়ে অভিনয়ের শিক্ষক রয় লন্ডনের সন্ধান পান এবং তাঁর কাছ থেকে অভিনয়ে হাতেখড়ি পিটের।
১৯৮৭ সালে পিট ‘নো ওয়ে আউট’, ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ ও ‘লেস দ্যান জিরো’ সিনেমায় পার্শ্ব চরিত্র দিয়ে অভিনয়জীবন শুরু করেন। এসব সিনেমায় তাঁর কোনো সংলাপ ছিল না এবং তাঁকে খুব সামান্য সময়ের জন্য পর্দায় দেখা গিয়েছিল। একই বছর একটা টিভি সিরিজে আত্মপ্রকাশ করেন পিট। এরপর আরও কয়েকটি টিভি সিরিজে অভিনয় করেন। ১৯৮৮ সালে মুক্তি পাওয়া ‘দ্য ডার্ক সাইড অব দ্য সান’ সিনেমায় পিট অন্যতম প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন। ১৯৯১ সালে ‘থেলমা অ্যান্ড লুইস’ সিনেমায় এক বখাটের চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। এরপর ‘রিভার রানস থ্রু ইট’ ও ‘ক্যালিফোর্নিয়া’ সিনেমায় অভিনয় করে পান খ্যাতি। পরের বছর ‘ইন্টারভিউ উইথ দ্য ভ্যাম্পায়ার’ ও ‘লিজেন্ডস অব দ্য ফল’-এর মতো ব্যবসাসফল সিনেমায় অভিনয় করে অভিনেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।
ব্র্যাড পিট এরপর একে একে ‘টুয়েলভ মাংকিস’, ‘দ্য ডেভিলস ওন’, ‘সেভেন ইয়ারস ইন টিবেট’, ‘ফাইট ক্লাব’, ‘দ্য মেক্সিকান’, ‘ওশেনস ইলেভেন’, ‘ট্রয়’, ‘ওশেনস টুয়েলভ’, ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস স্মিথ’, ‘বাবেল’, ‘দ্য ট্রি অব লাইফ’, ‘মানিবল’, ‘ওয়ার্ল্ড ওয়ার জি’, ‘দ্য কিউরিয়াস কেস অব বেঞ্জামিন বাটন’, ‘ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস’, ‘ওয়ানস আপন আ টাইম ইন হলিউড’সহ বিভিন্ন সিনেমায় অভিনয় করে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তা পান। ২০১৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত থ্রিলার সিনেমা ‘ওয়ার্ল্ড ওয়ার জি’ পিটের সবচেয়ে ব্যবসাসফল সিনেমা হিসেবে পরিচিত। ব্র্যাড পিটের সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ‘বুলেট ট্রেন’। সিনেমাটি ২০২২ সালের আগস্টে মুক্তি পায়। পিটের আরেকটি সিনেমা ‘ব্যবিলন’ খুব শিগগির মুক্তি পাওয়ার কথা। পিট অভিনয়ের পাশাপাশি তাঁর নিজস্ব প্রযোজনা সংস্থা ‘প্ল্যান বি এন্টারটেইনমেন্ট’ গড়ে তোলেন।
ব্র্যাড পিট বিশ্বব্যাপী অনেক সেবামূলক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত। ‘ওয়ান ক্যাম্পেইন’ নামের একটা সংস্থা গঠন করেছেন তিনি, যা আফ্রিকা মহাদেশে দারিদ্র্য ও এইডসের বিরুদ্ধে লড়াই করে। পিট আন্তর্জাতিক ত্রাণ ও মানবিক সাহায্য সংস্থা ‘নট অন আওয়ার ওয়াচ’ প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। সংস্থাটি গণ-নৃশংসতা বন্ধে বিশ্বব্যাপী সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। পিট ও তাঁর সাবেক স্ত্রী অভিনেত্রী অ্যাঞ্জেলিনা জোলি বিভিন্ন দেশে উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। ২০০৬ সালে পিট ও জোলি ‘জোলি-পিট ফাউন্ডেশন’ গঠন করে সারা বিশ্বে মানবিক সহায়তা দেন। একই বছর পিট হারিকেন ক্যাটরিনায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সাহায্য করার জন্য ‘মেক ইট রাইট ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা করেন।
ব্র্যাড পিট তাঁর অভিনয়জীবনের শুরু থেকেই বেশ কিছু সহ-অভিনেত্রীদের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছেন। এই অভিনেত্রীদের মধ্যে আছেন গিনেথ প্যাল্ট্রো, রবিন গিভেন্স, জিল শোয়েলেন, জুলিয়েট লুইস, থ্যান্ডি নিউটন, জেনিফার অ্যানিস্টন ও অ্যাঞ্জেলিনা জোলি। গিনেথ প্যাল্ট্রোর সঙ্গে তাঁর প্রেম ছিল ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত। তাঁদের বাগদানও হয়েছিল বলে জানা যায়। পিট অভিনেত্রী জেনিফার অ্যানিস্টনের সঙ্গে সম্পর্কে জড়ান এবং ২০০০ সালে তাঁরা বিয়ে করেন। সুখী দম্পতি হিসেবে পরিচিতি পেলেও ২০০৫ সালে তাঁরা আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। অ্যানিস্টনের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ প্রক্রিয়া চলাকালে পিট ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস স্মিথ’ সিনেমায় অভিনয় করার সময় অভিনেত্রী অ্যাঞ্জেলিনা জোলির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। সাত বছর প্রেম করার পর ২০১২ সালে তাঁদের বাগদান হয় এবং বিয়ে করেন ২০১৪ সালে। জনপ্রিয় এই দম্পতি ‘ব্র্যাঞ্জিলিনা’ নামে পরিচিতি পান। বিয়ের মাত্র দুই বছর পর জোলি বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করেন এবং ২০১৯ সালে তাঁদের বিবাহবিচ্ছেদ কার্যকর হয়।
পিট ও জোলির ছয় সন্তান আছে, যাদের মধ্যে তিনজন আন্তর্জাতিকভাবে দত্তক নেওয়া। ২০০৫ সালে পিট ও জোলি ইথিওপিয়া থেকে তাঁদের দ্বিতীয় সন্তান জাহারা মার্লেকে দত্তক নেন। এর আগে পিট কম্বোডিয়া থেকে জোলির প্রথম দত্তক নেওয়া সন্তান ম্যাডক্স চিভানের দত্তক বাবা হন। জোলি ২০০৬ সালে নামিবিয়ায় তাঁদের মেয়ে শিলোহ নুভেলের জন্ম দেন। মিডিয়ার দৃষ্টি এড়াতে তাঁরা তাঁদের সন্তানের জন্মের জন্য নামিবিয়ায় যান। এই তারকা দম্পতি শিলোহর প্রথম ছবির স্বত্ব যুক্তরাষ্ট্রে ৪ দশমিক ১ মিলিয়ন ডলারে এবং যুক্তরাজ্যে সাড়ে ৩ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি করেন। ছবি বিক্রি থেকে আয়ের পুরোটা তাঁরা আফ্রিকার সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের কল্যাণে ব্যয় করেন। ২০০৭ সালে তাঁরা ভিয়েতনামের একটি এতিমখানা থেকে তিন বছরের শিশু প্যাক্স থিয়েনকে দত্তক নেন। ২০০৮ সালে তাঁদের পুত্র নক্স লিওন এবং কন্যা ভিভিয়েন মার্চেলিনের জন্ম হয়। এই দুই সন্তানের ছবি তাঁরা ১৪ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি করেন। ছবি বিক্রির পুরো অর্থ ‘জোলি-পিট ফাউন্ডেশন’-এ দান করা হয়। তাঁদের সব সন্তানের উপাধি পরিবর্তন করে ‘জোলি-পিট’ রাখা হয়। বিবাহবিচ্ছেদের পর তাঁরা সন্তানদের হেফাজত নিয়ে আইনি লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়েন।