সাইকেলে হালুয়াঘাট থেকে কুয়াকাটা

বাইসাইকেল হাঁকিয়ে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট থেকে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত। দূরত্ব ৪৪৭ কিলোমিটার। চার দিনে এ পথ পাড়ি দিয়েছেন দুই সাইক্লিস্ট। সে গল্পই শোনালেন বাবর আলী

হালুয়াঘাট উপজেলার গোবরাকুড়া স্থলবন্দর

অনেক দিন থেকেই পরিকল্পনাটা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। নানা ঝামেলায় রাস্তায় আর নামা হচ্ছিল না। অবশেষ গত বছর ২১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম থেকে ময়মনসিংহের বাসে উঠে পড়ি। সকাল সকাল পৌঁছাই ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের গোবরাকুড়া সীমান্তে। এখান থেকেই শুরু হবে আমাদের ক্রস কান্ট্রি রাইড। গন্তব্য কুয়াকাটা। সঙ্গী সাকিব মাহমুদ।

ময়মনসিংহ থেকে যে পথে হালুয়াঘাট এসেছিলাম, সে পথে আমরা ফিরলাম না। আরেকটি পথ নেওয়ার উদ্দেশ্য শ্রীশ্রী কামাখ্যা মাতার মন্দির দেখা। ভারতের আসামের বিখ্যাত কামরূপ কামাখ্যা মন্দিরে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল, কিন্তু দেশেরটা দেখিনি। হালুয়াঘাটের মুজাখালিতে গ্রামের নিভৃত পরিবেশে এই মন্দিরের অবস্থান। মন্দিরের এক পূজারির সঙ্গে বেশ খানিকক্ষণ কথা হলো। জানালেন, এখানে বার্ষিক বড় পূজা হয় বৈশাখে। আগাম দাওয়াত দিলেন তিনি।

মন্দির দেখে আবার হালুয়াঘাটের পানে। সরচাপুর বাজারের পরপরই ভোগাই কংস নদীর সঙ্গে দেখা। এই নদী হালুয়াঘাট উপজেলা আর ফুলপুর উপজেলার সীমান্ত হিসেবে কাজ করছে। ফুলপুর উপজেলার প্রথম বাজারের নাম ঠাকুরবাখাই। উপজেলাটা শুরুই হলো বেশ কটি ইটভাটা দিয়ে। রাস্তার পাশে ইটভাটা থাকা মানেই রাস্তার বারোটা। পিচের ওপর মাটি পড়ে এবড়োখেবড়ো হয়ে থাকে। ঝাঁকুনি খেতে হয় বেশ।

চায়ের বিরতি দিতে ছোট্ট একটা টংদোকানে থেমেছি। পেছন থেকে যাত্রীবাহী একটা বাস মৃদু ধাক্কা দিয়ে এক মোটরসাইকেল আরোহীর ব্যাক লাইট ভেঙে দিয়েছে। ওই মোটরসাইকেল আরোহী তৎক্ষণাৎ চায়ের দোকান থেকে চেলা কাঠ নিয়ে বাসের ড্রাইভারের ওপর চড়াও হলেন। ততক্ষণে তাঁদের ঘিরে প্রচুর লোকের ভিড়। ভিড় পেছনে ফেলে দলি বাজার। এখান থেকেই শুরু তারাকান্দা উপজেলা।

ঢাকার যানজটে

শেরপুর থেকে আসা পরিচিত দুই সাইক্লিস্ট ময়মনসিংহ শহরে ঢোকার মুখেই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। তাঁদের সঙ্গে ময়মনসিংহ শহরে প্রবেশ করলাম। ভাত পর্ব শেষ করে চায়ের পর্ব চুকাতে গেলাম বিপিন পার্ক। এক দফা বুলেট চা খেয়ে বিদায় নিলেন সাইক্লিস্টরা। বেশ ঝাঁজাল এই বুলেট চা আমার জন্য টনিকের কাজ করল। বন্ধ নাকটা খুলে গেল নিমেষেই। সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে আসা বাকিরা বাইপাস মোড় পর্যন্ত এগিয়ে দিতে সঙ্গে চললেন। বদরের মোড়, চরপাড়া ইত্যাদি পেরিয়ে মাসকান্দা বাসস্ট্যান্ড। শিকারীকান্দার কিছু পরেই সিটি করপোরেশনের সীমানা শেষ।

একটা ব্যাপারে সাকিব আর আমি বেশ কাহিল হচ্ছিলাম। উল্টো পথে গাড়ি চলে এই রাস্তায়। আর এই কাজে অগ্রণী অটোরিকশা! তবে মোটরসাইকেল আর সাইকেল আরোহীরাও একই দোষে দোষী। বাগান নামের একটা দারুণ গ্রাম পাওয়া গেল। ওখানেই মিনিট দুয়েকের ব্যবধানে দুটো বিস্ফোরণের শব্দ শুনলাম। প্রথমবার প্রাইভেট কারের চাকা পাংচার, পরেরবার বাসের। বাসের চাকা পাংচারের শব্দ শুনে অন্তরাত্মা মোটামুটি কেঁপে উঠেছিল! রাগামারা, চেলেরঘাট, সাইনবোর্ড পার হয়ে ভরাডোবা বাজার। খানিক এগিয়ে ভালুকা বাজারে যখন আজকের মতো যাত্রার সমাপ্তি টানছি, ততক্ষণে দিনের আলো মিইয়ে গেছে।

দ্বিতীয় দিনের শুরু কুয়াশামাখা সকালে

ভালুকা থেকে শ্রীনগর

সকাল সাড়ে ছয়টায় বেরোনোর পরিকল্পনা থাকলেও অতিরিক্ত কুয়াশার কারণে প্যাডেলে পা রাখতে রাখতে সোয়া সাতটা বেজে গেল। শিল্পকারখানায় ভালুকা জায়গাটা বেশ জমজমাট। সবাই ছুটছে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে। নারীরাই সংখ্যায় বেশি। এর পরপরই পড়ল ড্রিম ওয়ার্ল্ড পার্ক। কুয়াশার কারণে আশপাশের বাজারগুলোর নাম পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছিলাম না। রাস্তার পাশে কারখানা পানে ছুটে চলা মানুষের ঢল কিছুটা কমল সিডস্টোর বাজারে এসে। মাস্টারবাড়ি এসে সে ভিড় হয়ে এল একদমই পাতলা। ততক্ষণে ঘড়ির কাঁটায় আটটা পার।

জৈনাবাজার থেকে ময়মনসিংহের সীমানা পেরিয়ে প্রবেশ করলাম গাজীপুর জেলায়। ইচ্ছে ছিল বোর্ডবাজারের কিছুটা সামনের রাস্তা দিয়ে গাছার দিকে এগিয়ে ঢাকা প্রবেশ করব। গুগল ম্যাপ গাড়ির রাস্তা না দেখালেও হাঁটাপথ দেখাচ্ছিল। সেদিকে ঢুকে পথ হারালাম মিনিট দশেকের মধ্যেই। একটা কানাগলিতে গিয়ে পথ শেষ। ইতিউতি খুঁজে সুবিধা করতে না পেরে আবার মহাসড়কই ধরলাম। জ্যামের কথা ভেবে এর মধ্যেই আমি বেশ শঙ্কিত। শঙ্কা নিয়েই মহাব্যস্ত টঙ্গী পেরিয়ে ঢাকার উত্তরা। পরের গল্পটুকু খালি শুকনো মুখে জ্যাম ঠেলার গল্প।

পোস্তগোলা সেতুর ওপর দিয়ে পার হলাম বুড়িগঙ্গা নদী। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানা লাগোয়া এক ছাপরা দোকানের সামনে ব্রেক কষল সাকিব। দোকানের সামনে মাত্রই খেয়ে বের হওয়া দুজন পুলিশ দাঁড়িয়ে ছিল।বেশ কিছু ভারী যানবাহনও দোকান ঘেঁষে দাঁড়ানো। দেখেই বোঝা যায় ড্রাইভারদের মধ্যে এর বেশ নামডাক আছে। এই দোকানের খাবার ভালো না হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। ফুলকপি দিয়ে রুই মাছের তরকারি আর শোল মাছ দিয়ে জম্পেশ খাওয়া শেষে আবার পথে। এবার গন্তব্য মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে ধরে মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর। ম্যাপের দিকে চোখ না রেখেই ভুলটা করেছিলাম। কোন ফাঁকে দুজনেই বাবুবাজারের রাস্তায় চলে এসেছি, বুঝতেই পারিনি। অগত্যা আবার পেছনপানে চলা। এবার ভালোমতো বেশ কিছুক্ষণ ম্যাপ সার্ফিং করে তবেই প্যাডেল ঘোরালাম। প্রথম কয়েক কিলোমিটার বেশ কিছু ওভার পাস পার হতে হলো। ভরপেট দুপুরের খাবার খেয়েই এসব আপহিল টপকাতে কারই–বা ভালো লাগে!

মেঠোপথ ধরে এগিয়ে চলা

ঢাকা জেলার সীমানা ছাড়িয়ে প্রবেশ করলাম মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে। কুচিয়ামোড়ার বিক্রমপুর আদর্শ কলেজের মাঠে খেলা উপলক্ষে প্রচুর ভিড়। এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়িগুলো অতিক্রম করছে প্রচণ্ড গতিতে। সাইড ঘেঁষে কোনোমতে গা বাঁচিয়ে চলছি। সড়কের দুপাশে নানান হাউজিং সোসাইটির মনোলোভা বিজ্ঞাপন আর তার অধিগ্রহণকৃত জমি। বিকট সব সাইনবোর্ড। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিমতলা হয়ে হাসাড়া বাজার।

শ্রীনগর বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু এবং সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদের জন্মস্থান। এ অঞ্চলের ট্রেডমার্ক সুদৃশ্য টিনের চালার ঘরের দেখা পেতে শুরু করলাম শ্রীনগরে ঢুকেই। সড়কের দুই পাশে দুই চিত্র। হাতের বাঁয়ে খাল–লাগোয়া অংশে সব দোকানই টিন আর কাঠের। আর ডানের অংশে ইট-সুরকির ভবনের প্রাধান্য। ছোট একটা সেতু পেরিয়ে শ্রীনগরে যখন ঢুকেছি, দিনের আলো তখন ফিকে হতে শুরু করেছে মাত্র। ঘোলের আশায় এদিক-ওদিক ঘুরেও কপাল খুলল না।

শ্রীনগর-বরিশাল

সকাল সোয়া ছয়টা। পুরো শ্রীনগর তখনো কুয়াশাচ্ছন্ন, আবার রাস্তায় নামলাম আমরা। আক্ষরিক অর্থেই দশ ফুট দূরের জিনিস দেখা যাচ্ছে না। বাজারের ভেতরের রাস্তাটা হয়ে বাইপাস। সেখান থেকে উঠে পড়লাম মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে। চেষ্টা যত তাড়াতাড়ি ফেরিঘাট গিয়ে পদ্মার ওপারে যাওয়া যায়।

সাতটা নাগাদ ফেরিঘাটে পৌঁছেই ফেরির দিকে না গিয়ে লঞ্চঘাটের দিকে ছুটলাম। একটা লঞ্চ ছাড়বে ছাড়বে করছে। ‘কাঁঠালবাড়ি, কাঁঠালবাড়ি’ বলে হাঁক ছাড়ছে লঞ্চের লোকজন। সাইকেলসমেত উঠে পড়লাম। যাত্রী ভর্তি করার পর লঞ্চের লোকজন জানাল, কুয়াশা না কাটলে লঞ্চ ছাড়বে না। যাত্রীদের অনেকে খেপে গেলেন। লঞ্চ ছাড়বে না তো ঘাট থেকে দূরে আনলে কেন! বিরক্ত হয়ে কিছু মানুষ স্পিডবোটে উঠে গেলেন। সাইকেল নিয়ে স্পিডবোটে ওঠা সম্ভব নয় বলে উদাস দৃষ্টিতে লোকজনের কর্মচাঞ্চল্য দেখছিলাম। এরই মধ্যে একজন উদ্যোগী হলেন লঞ্চের সারেংকে বোঝাতে। তার মোটিভেশনেই সম্ভবত লঞ্চ ছাড়ল।

এর পরের গল্প হতাশার। পদ্মার ওই ঘাটেই পরের ঘণ্টা তিনেক সময় ঘুরপাক খেলাম। কুয়াশার কারণে পথ ভুল করে ঘুরেফিরে ঘাট কিংবা তীরের কাছেই চলে আসছিল লঞ্চ। তরুণ কয়েকজন উদ্যোগী হয়ে গুগল ম্যাপ চালু করে সারেংয়ের পাশে বসে নেভিগেট করা শুরু করলেন। তাঁরাও দিক ভুল করলেন বার কয়েক। এর মধ্যে কয়েকজন এতক্ষণেও পদ্মা সেতু দেখা না যাওয়ায় ভারী উদ্বেগ প্রকাশ করলেন।

শেষমেশ ওপারের কাঁঠালবাড়ি ঘাটে যখন পৌঁছেছি, তখন প্রায় ১১টা। ঘণ্টাখানেকের জলপথ পাড়ি দিতে লেগে গেল পাক্কা চার ঘণ্টা। পদ্মা সেতুর গুরুত্ব হাড়ে হাড়ে বুঝলাম। তাড়াতাড়ি সাইকেল নামিয়ে প্যাডেল ঘোরালাম।

পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের ফটক

একটা খাল ধরে এগিয়ে শিবচরে পৌঁছানো গেল। শিবচর উপজেলা হলেও অনেক জেলা সদরের তুলনায় ব্যস্ত। পাওয়ার হাউসের রোড ধরে এগোচ্ছি। এ রাস্তায় একটু পরপরই জামে মসজিদ। বেশির ভাগ মসজিদের নামের সঙ্গেই বাড়ির নাম লাগানো আছে। কয়েক বাড়ি মিলেই মসজিদ দেওয়ার বেশ প্রচলন এ অঞ্চলে। আরও কিছু দূর এগিয়ে পাওয়া গেল একটা নদী। নাম ‘বিল পদ্মা’। খানিক এগিয়ে আবারও একই নদীকেই অতিক্রম করতে হলো।

বেড়িবাঁধ বাজার হয়ে ঘটকচরের কাছে উঠে পড়লাম বরিশালের মহাসড়কে। লোয়ার কুমার নদের ওপর নির্মিত সেতু পেরিয়ে মস্তফাপুর বাসস্ট্যান্ড। এখান থেকে হাতের বাঁয়ের রাস্তায় গেলে মাদারীপুর শহর। গন্তব্য বরিশাল বলে আমরা সোজা রাস্তা ধরলাম। টানা চালিয়ে গোপালপুর হয়ে ভূরঘাটা বাসস্ট্যান্ড। বাসস্ট্যান্ড থেকে একটু এগিয়েই প্রবেশ করলাম বরিশাল জেলায়। পেছনে ফেলে চললাম মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলা। বাংলা ভাষার বরেণ্য কথাসাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম এই উপজেলায়। বরিশালে ঢুকেই সাইকেল চালাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। পিচ রাস্তার চলটা উঠে পড়া পিচের আস্তরণ। সাইকেল চালাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল। রাস্তার মসৃণতার ব্যাপারটাই উধাও। মনে শঙ্কা, বরিশাল পর্যন্ত রাস্তা এই রকমই নাকি!

খাঞ্জা হয়ে বার্থীর পর রাস্তা হয়ে গেল আগের মতোই মসৃণ। দুপুরের খাবার খেতে যখন গৌরনদী থামলাম, তখন ঘড়ির কাঁটায় চারটা পার। ভরপেট ভাত খেয়ে মিষ্টি চাখতে গেলাম দিলীপ কুমারের দোকানে। ক্ষীর বড়াটা ছাড়া বাকি কয়েক পদের মিষ্টি আহামরি কিছু মনে হলে না আমার কাছে।

ভরপেট খেয়ে দ্বিগুণ উদ্যমে প্যাডলিং শুরু করলাম। সন্ধ্যা নদীর ওপর নির্মিত ব্রিজ যখন পার হচ্ছি, তখন কাকতালীয়ভাবে পরিবেশেও সন্ধ্যা। সাকিব আজ খানিকটা পিছিয়ে পড়েছে। বার কয়েক সামনে এগিয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। বরিশাল শহরের কাছাকাছি এক জায়গায় থেমে সাকিব জানাল, একটু আগেই বার দুয়েক বমি হয়েছে। মুখও বেশ ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিয়ে পাশের ফার্মেসি থেকে ওষুধ খাইয়ে আবার সাইকেলের সিটে। আরও বেশ খানিকক্ষণ একটানা চালিয়ে নথুল্লাবাদ হয়ে সাগরদীর কাছে কারিতাসের ডরমিটরির সামনে শেষ করলাম আজকের যাত্রা।

কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে সাকিব মাহমুদ (বাঁয়ে) ও লেখক

বরিশাল থেকে কুয়াকাটা

রাতে বেশ ভালো ঘুমের পর বিছানা ছাড়লাম ভোর সাড়ে পাঁচটায়। উঠেই সাকিবের শরীরের অবস্থা জেনে নিলাম। আজ ফিট আছে দেখে রেডি হয়ে ছয়টা নাগাদ রাস্তায় নামলাম। ঘড়ির কাঁটায় ছয়টা হলেও চরাচর অন্ধকার। হেডলাইট জ্বালিয়ে দূরপাল্লার বাস-ট্রাকগুলো পাশ ঘেঁষে চলে যাচ্ছে। রূপাতলী থেকে বাঁয়ে মোড়। ডানের রাস্তাটা চলে গেছে ঝালকাঠি-পিরোজপুরের দিকে। কীর্তনখোলা সেতুর ওপারেই বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সুবিশাল ক্যাম্পাস আধো আধো দেখা যাচ্ছিল। কীর্তনখোলার শাখানদীর ওপরের সেতুটা পেরিয়ে কিছু দূর এগোলেই দপদপিয়া জিরো পয়েন্ট। শিমুলতলা বাজার থেকে প্রবেশ করলাম ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলায়।

মাঝে বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলা পেরিয়ে সাড়ে সাতটা নাগাদ লেবুখালী পৌঁছালাম। লেবুখালীতে দেশের অন্যতম বৃহৎ সেনানিবাস আছে। তার পাশেই পায়রা নদীর ফেরিঘাট। ঘাটের ওপাশে পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলা।

পটুয়াখালী বাসস্ট্যান্ডের পর থেকে পিচের রাস্তার ওপর অসমান পিচের ঢালাইয়ের জন্য চালাতে খুবই কষ্ট হচ্ছিল। এবড়োখেবড়ো রাস্তায় চালাতে শরীরের কলকবজা সব নড়ে যাচ্ছিল। রাস্তার ধারের দোকান, সাইনবোর্ড, পোস্টার ইত্যাদি দেখে মনে হলো এ অঞ্চলে ‘আকন’ নামটা বেশ প্রচলিত। ‘আকন্দ’র কথ্যরূপ কি না কে জানে! বসাক বাজার হয়ে ফতুল্লা বাজার। সাঘরিয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে একটা রাস্তা এগিয়েছে গলাচিপা অভিমুখে। বেশ ভালো গতিতে চালাচ্ছিলাম। উদ্দেশ্য আমতলী বাজারে ছোট একটা চা ব্রেক নেওয়া। হঠাৎ সামনের চাকা পাংচার। সাইকেল নিয়ে বিপরীত দিক থেকে আসা দুই পিচ্চির কাছে জানতে পারলাম, সামনের বাজারে সাইকেল মেকানিকের দোকান আছে। পরের এক কিলোমিটার চালালাম ফ্ল্যাট টায়ার নিয়েই।

সাহেববাড়ি বাজারে গিয়ে বসে আছি তো আছিই। সাকিবের দেখা নেই। ফোনে জানাল খানিকটা পেছনে আছে। আমার কাছে এক্সট্রা টিউব আর প্যাঁচ কিট থাকলেও সাইকেল সারাইয়ের সরঞ্জাম ওর কাছে। সাকিবের বেশি দেরি হওয়াতে আমি সাইকেল মেকারের খোঁজ করলাম। ভদ্রলোক দোকান খোলা রেখে কোথায় হাওয়া হয়ে গেছেন। অনেকেই এসে খুঁজে যাচ্ছেন। দীর্ঘ ৪৫ মিনিট পরে সাকিব এলে দুজনে মিলে লিক সারাইয়ে মনোযোগ দিলাম। টিউব পানিতে চুবানোর পর আবিষ্কৃত হলো নজলে সমস্যা। টিউব পাল্টাতে হবে। কিন্তু আমাদের সঙ্গের টিউবটা সাইকেলের রিমের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট হলো না। এক চাকাতেই সাইকেল ঠেলে পাশের বাজারের মেকারের কাছে গেলাম। মেকার নানান কারিকুরি করে রিমের ফুটো বড় করে দিতেই সমস্যার সমাধান।

টিয়াখালী, বান্দ্রা বাজার হয়ে রজপাড়া থেকে প্রবেশ করলাম পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায়। এই জায়গার অন্য একটা নামও আছে—খেপুপাড়া। দেশের তৃতীয় সামুদ্রিক বন্দরের অবস্থান এই কলাপাড়াতেই। এদিকেও রাস্তার দুই পাশে প্রচুর বাবলাগাছ। কলাপাড়া বাজারের শেষ মাথায় হোটেল নীলগঞ্জে দুপুরের খাবার খেয়ে আন্ধারমানিক নদী পার হলাম শেখ কামাল সেতুর ওপর দিয়ে। আরেকটু এগিয়ে পড়ল শেখ জামাল সেতু। নিচের নদীর নাম সোনাতলা নদী। সেতুর তলার দিকে তাকিয়ে সোনার বদলে ঘোলা পানি আর অল্পবিস্তর কচুরিপানা চোখে পড়ল! মহীপুর বাজারের পরের নদীর নাম খাপরাডাঙ্গা নদী। কত নদী, শত নদী এই বাংলার বুকজুড়ে। এই নদীর ওপর নির্মিত সেতুর নাম শেখ রাসেল সেতু। আলীপুর হয়ে বিকেল চারটা নাগাদ পৌঁছে গেলাম কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে।

যাওয়ার আর পথ নেই। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট থেকে যাত্রা শুরু করে চার দিনের সাইকেল রাইডের ইতি টানলাম দেশের অন্য প্রান্তের কুয়াকাটা এসে। এটা সাকিব আর আমার তৃতীয় ক্রস কান্ট্রি রাইড। সমুদ্রসৈকতে দাঁড়িয়ে একে অপরকে আলিঙ্গন করে চার দিনের সাইকেল রাইডের সমাপ্তি হলো।