৪০-এ মাইলস: এবার দেশের মাটিতে উদ্যাপন
>বাংলাদেশের ব্যান্ডসংগীতের অঙ্গনে এখন যে দলগুলো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, মাইলস তাদের অনুপ্রেরণা। ৪০ বছর হয়েছে এই দলের। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে গেছে মাইলসের গান। এখন এই গানগুলো আর এই দলের লম্বা পথচলা উদ্যাপনের সময় এসেছে। তাই ২৪ ডিসেম্বর বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টারের হল ৩–এ হতে যাচ্ছে মাইলসের ৪০ বছর পূর্তি উত্সব। উৎসবের আয়োজন নিয়ে কথা বললেন দলের অন্যতম দুই সদস্য হামিন আহমেদ ও শাফিন আহমেদ। লিখেছেন শফিক আল মামুন
শুরু হয়েছিল গত ২১ জুন। সেদিন যুক্তরাষ্ট্রের পথে রওনা করে গানের দল মাইলস। উদ্দেশ্য—দলটির ৪০ বছর উদ্যাপনের কনসার্টে অংশ নেওয়া। একে একে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় ২৭টি কনসার্ট করে দলটি। প্রতিটি কনসার্টে মাইলসের সঙ্গে গলা ছেড়ে গান করেন প্রবাসী বাঙালি শ্রোতারা। ঝুলিভরা নতুন অভিজ্ঞতা ও শ্রোতাদের ভালোবাসা নিয়ে দলটি দেশে ফেরে ৬ নভেম্বর। ফিরেই ঘোষণা দেয় দলটি—৪০ বছর বয়সী মাইলস ক্লান্ত হয়নি। ঢাকায় বিশাল এক কনসার্টের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এই আনন্দ উৎসব। সেই ঘোষণা অনুযায়ী এখন চলছে প্রস্তুতি আর মহড়ার ব্যস্ততা। মাইলস তৈরি তার বাংলাদেশের শ্রোতাদের জন্য এই দলের সবচেয়ে বড় আয়োজন নিয়ে।
ভিনদেশ থেকে নিজ দেশে
দলটির গিটারিস্ট ও ভোকাল হামিন আহমেদ জানান, একটি দল ৪০ বছর জনপ্রিয়তা নিয়ে টিকে থাকা কম কথা নয়। তাই ৪০ বছর উদ্যাপনের এই উৎসবকে স্মরণীয় করে রাখতে চেয়েছেন তাঁরা। তাই উদ্যাপনের শুরুটা করেছেন দেশের বাইরে গিয়ে। হামিন বলেন, ‘দেশের সীমানা পেরিয়ে বিভিন্ন দেশে মাইলসের অগণিত ভক্ত আছেন। ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ কোনো ব্যান্ড হিসেবে মাইলস প্রথম যুক্তরাষ্ট্রে সফর করে। তখন থেকেই ২০১২ সাল পর্যন্ত দুই বছর পরপর দেশের বাইরে আমরা নিয়মিত শো করেছি। সেই কারণে দেশের বাইরে আমাদের বিশাল এক ভক্তমহল আছে। ৪০ বছর উদ্যাপনের শুরুটা তাঁদের ভাগাভাগি করতে চেয়েছি। অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছি।’
ঝুলিভরা অভিজ্ঞতা
দেশের বাইরে শো করতে গিয়ে নাটকীয় সব অভিজ্ঞতার কথা জানালেন দলের এই সদস্য। জানান প্রথমে নিজ উদ্যোগেই তিন দেশে সফরের পরিকল্পনা ছিল মাইলসের। কিন্তু পরে তিন দেশেই কনসার্টের পৃষ্ঠপোষক পেয়ে যান তাঁরা। হামিন বলেন, ‘ভক্তদের চাহিদার কারণে তিন দেশেই
নির্ধারিত শোর চেয়ে বেশিসংখ্যক শো করতে হয়েছে। পুরো সফরই সফল হয়েছে।’
একটা অভিজ্ঞতার কথা আলাদা করে বললেন হামিন, ‘আমাদের প্রথম শো ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে। সেখানে প্যাটারসন নামের একটি জায়গায় একটি রাস্তার নাম “বাংলাদেশ ব্যুভার্ড”। ওখানকার কাউন্সিলর বাঙালি। আমাদের শো দিয়ে সেই রাস্তার উদ্বোধন করতে চান। দেখলাম, বিষয়টি সারা জীবন থেকে যাবে। আমরা রাজি হয়ে গেলাম। শো দেখতে প্রায় ১৫ হাজার দর্শক জড়ো হয়েছিল। এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, একটা পর্যায়ে স্থানীয় পুলিশ পুরো মঞ্চ ঘিরে রাখে। সে এক অমূল্য অভিজ্ঞতা।’
কঠিনতম সময়ে মাইলস
ব্যান্ডে তখন ভোকাল ও বেজ গিটারে ছিলেন ফরিদ রশিদ, ভোকাল ও গিটারে হামিন আহমেদ, কামাল ড্রামে, মানাম আহমেদ কি–বোর্ড বাজান। সেই সময় মাইলস ইংরেজি গান কভার করত। ১৯৮৭ সালের কথা। হঠাৎ করেই দেশ ছাড়লেন ফরিদ রশিদ ও কামাল। দুজনই তাঁদের পরিবার–পরিজনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান। বিপাকে পড়ে মাইলস। তখন মাইলসে হামিন ও মানাম আহমেদ ছাড়া কেউ নেই। ওদিকে মানাম শ্রুতি স্টুডিওতে কাজ নিয়ে ব্যস্ত। একমাত্র হামিন আছেন মাইলস নিয়ে। ওই সময়ের কথা মনে করে হামিন বললেন, ‘তখন মনে হচ্ছিল, পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। তখন জাতীয় দলে ক্রিকেট খেলতাম। গানের জন্য ক্রিকেট ছেড়ে মাইলসে যোগ দিলাম। সেই দলই ভেঙে যাচ্ছে!’ কিন্তু হাল ছাড়লেন না হামিন। সিদ্ধান্ত নিলেন ব্যবসা করবেন, সেই আয় দিয়ে দল চালাবেন। তিনি বলেন, ‘ডাটা টেক নাম নিয়ে কম্পিউটারের ব্যবসা শুরু করি। পাশাপাশি ব্যান্ডের কার্যক্রম চালানোর চেষ্টা চালিয়ে যাই।’ ওই সময়টাই গান করার ডাক পড়লে মানামকে সঙ্গে নিয়ে বেজে খায়েম ও ড্রামে শামীমকে এনে সপ্তাহে দুটি করত মাইলস। একসময় মিল্টন ড্রামার হিসেবে যোগ দিলেন মাইলসে।
এভাবেই কঠিনতম সময় পার করছিল মাইলস। ১৯৮৯ সালের শেষের দিকে শাফিন আহমেদ লেখাপড়া শেষ করে যুক্তরাজ্য থেকে দেশে ফিরেছেন। এসেই মাইলসের শোয়ে রিদম বাজিয়ে যোগ দেন তিনি। শাফিন যোগ দেওয়ার পরই আবার চাঙা হয়ে ওঠে মাইলস। হামিন বলেন, ‘শুরুতেই শো করে মজা পেয়ে যায় শাফিন। এরপর ঢাকায় থাকবে, নাকি লন্ডনে ফিরে যাবে, সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না সে। শেষ পর্যন্ত ১৯৮৯–এর শেষে বাংলাদেশে চলে আসে শাফিন। ঘুরে দাঁড়ায় মাইলস।’
নতুন গান, নতুন পরিকল্পনা
চার দশকে মাইলস ১১টি অ্যালবাম বের করেছে। ২০১২ সালে প্রতিচ্ছবি ডিলাক্স সবশেষ অ্যালবাম। এরপর আর নতুন অ্যালবাম আসেনি। কেন? দলের সদস্যরা জানালেন, সংগীত ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে তাঁরা ব্যথিত। এখানে নতুন গানের কোনো আধুনিক বিপণনপ্রক্রিয়া নেই। হামিন বলেন, ‘আমরা সাত–আটটি গান তৈরি করে রেখেছি, ভিডিও করার পরিকল্পনা আছে। কিন্তু কোথায় দেব গানগুলো? এখন যে পদ্ধতি আছে, তাতে অনেকটাই ফ্রিতে গান দিতে হবে। মাইলস যদি ফ্রি গান দেয়, তাহলে দেখাদেখি অন্য শিল্পীদেরও গান ফ্রি দিতে হবে। তাহলে শিল্পীদের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?’ তবে মাইলস নতুন পদ্ধতিতে তাদের গান ও ভিডিও প্রকাশ করতে চায়। হামিন জানালেন, এ নিয়ে কাজ করছেন তাঁরা।
বসবে মিলনমেলা
২৪ ডিসেম্বর মাইলসের ৪০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টারে বসবে দেশসেরা সংগীতশিল্পী ও ভক্তদের মিলনমেলা। শুরুর দিকে থাকবে গানের কাটাছেঁড়া কাগজসহ মাইলসের গানসংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ের প্রদর্শনী। থাকবে মাইলস ঘিরে তৈরি করা আট মিনিটের একটি প্রামাণ্য চিত্রের প্রদর্শনী। এরপর ফিডব্যাক, ওয়ারফেজ, সোলস, ভাইকিংস ও দলছুট মাইলসের গান গেয়ে সম্মান জানাবে ৪০ বছর বয়সী মাইলসকে।
দলটির বেজ গিটার ও ভোকাল শাফিন আহমেদ জানিয়েছেন, ওই দিন প্রায় তিন ঘণ্টা গান করবে মাইলস। মাইলসের এই ৪০ বছর উদ্যাপনের কনসার্টের টিকিট পাওয়া যাচ্ছে সহজ ডটকমের ওয়েবসাইট ও টেস্টি টিবেটের আউটলেটে। ২৪ তারিখে সন্ধ্যা ছয়টায় মিলনায়তনের দুয়ার খোলা হবে শ্রোতাদের জন্য। কনসার্ট চলবে রাত ১১টা পর্যন্ত।