নাটকের পাণ্ডুলিপি থেকে চলচ্চিত্র
১৯৯৭ সাল। নাটকের জন্য একটি পাণ্ডুলিপি লিখলেন গিয়াস উদ্দিন সেলিম। নায়িকা হিসেবে পছন্দ আফসানা মিমিকে। একদিন তাঁকে শোনান গল্পটি। মিমি শুনে গিয়াস উদ্দিন সেলিমকে বললেন, ‘এটা নাটক না। এটা দিয়ে সিনেমা বানাও। ভালো হবে।’ তখন পাণ্ডুলিপিটা রেখে দিলেন সেলিম। আর সেটা নিয়ে সিনেমা বানানোর প্রথম পরিকল্পনা করলেন ২০০৩ সালে। সেলিম বলেন, ‘২০০৩ সালে প্রথমবার চেষ্টা করি সিনেমা বানানোর জন্য। তখন এটা করা যায়নি। তারপর ২০০৭ সালে দ্বিতীয়বার বানানোর পরিকল্পনা করি। কিন্তু একটা দুর্ঘটনার কারণে আমাদের ছবির প্রযোজক প্রকল্পটা থেকে পিছিয়ে যান। এত দিনে আমরা প্রি–প্রোডাকশন শুরু করেছি। এগিয়েছি খানিকটা। আমার কিছু জমানো টাকা ছিল। বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে কিছু টাকাও নিই। এগুলো মিলিয়ে কাজ শুরু করি। যখন আর টাকায় কুলাচ্ছিল না, আমি অঞ্জন চৌধুরী পিন্টুর কাছে যাই। তিনি পাশে দাঁড়ান। এভাবেই ছবিটা নির্মাণ করা হয়। ২০০৭ সালে শুরু, ২০০৮ সালের দিকে শেষ, ২০০৯ সালে মুক্তি দিই।’
শাড়ি পরা মেয়েটি হয়ে যায় নায়িকা
এই সিনেমাতে সোনাই আর পরি চরিত্র দিয়ে চঞ্চল চৌধুরী আর ফারহানা মিলি জায়গা করে নেন ভক্তদের হৃদয়ে। গ্রামের ছেলের চরিত্রের জন্য দরকার ছিল একজনকে। চঞ্চল চৌধুরীকে দেখে অভিনয়গুণ ও সবকিছু মিলে পছন্দ হয়ে যায় পরিচালকের। চঞ্চল তখন গিয়াস উদ্দিন সেলিমের সঙ্গেই একটি ধারাবাহিকে সবে কাজ শেষ করেছেন। সোনাই চরিত্রে চঞ্চলকেই বেছে নিলেন তিনি। কিন্তু নায়িকা নিয়ে হলো ঝামেলা। যাঁকে ঠিক করে ছবির শুটিং শুরু করলেন, মধ্যপথে ওই অভিনেত্রী জানান, তিনি আর কাজ করছেন না। পরিবারের অসম্মতি আছে। কী করা যায়? একদিন গিয়াস উদ্দিন সেলিম তাঁর অফিসের সামনে দেখলেন শাড়ি পরা একটি মেয়েকে। তাঁর মধ্যেই যেন খুঁজে পেলেন মনপুরার পরিকে। সেলিম বলেন, ‘তখন নতুন কাস্টিং করতে শুরু করলাম। একদিন মিলিকে আমার অফিসের নিচে দেখলাম শাড়ি পরা। মনে হলো তাকে তো পরির জন্য কাস্টিং করা যায়। সে থিয়েটার করত। টুকটাক অভিনয়ও। আমি ভালোভাবে চিনতাম না। একজন তার পরিচয় জানাল। আমি ভাবলাম, সে–ই পরির চরিত্রে ভালো হবে। আমি তাকে কাস্ট করলাম। এভাবেই চঞ্চল আর মিলির কাস্টিং হয়।’
গানগুলো ছিল মুখে মুখে
মনপুরা সিনেমা মুক্তি পাওয়ার আগেই গানগুলো চলে আসে সবার মুখে মুখে। এটি যেমন অর্থনৈতিক শক্তি জুগিয়েছে মনপুরা দলের জন্য, তেমনি ছবির প্রচারেও রেখেছে অবদান। ‘নিথুয়া পাথারে’, ‘যাও পাখি বলো তারে’ গানগুলো শোনা যায় সবার মুখে মুখে। আড্ডার মধ্য দিয়েই তৈরি হয়েছিল গানগুলো। পরিচালক স্মৃতিচারণ করেন, ‘তাজুল নামে এক বন্ধু ছিল। এই ছবির প্রচারণার দায়িত্ব ছিল তার। ধানমন্ডিতে তাদের বাসা। ওখানে আমরা পুরোনো বন্ধুরা আড্ডা দিতাম। কৃষ্ণকলিও আড্ডা দিত। সে–ই এই ছবির জন্য গান করল দুইটা। অর্ণব আবার সংগীতায়োজন করল। ফজলুর রহমান বাবু আমাদের অভিনেতা। তাঁকে দিয়ে গান গাওয়ানোর সিদ্ধান্ত হলো। আমরা গান গাওয়াই মমতাজ বেগমকে দিয়েও। এভাবেই সব গান তৈরি হলো।’
দর্শকেরা এটি ‘ওউন’ করেছেন
মনপুরা ২০০৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পেল। এরপর সৃষ্টি হলো নতুন একটি ইতিহাসের। সিনেমাটি দর্শকেরা পছন্দ করলেন। দীর্ঘদিন ধরে চলল সিনেমা হলে। কিন্তু কী ছিল জনপ্রিয়তার পেছনের মন্ত্র? সেলিম উত্তর দেন, ‘আসলে পুরো বাংলাদেশের দর্শকেরা “ওউন” করেছেন যে ছবিটি বাংলাদেশের। আমাদের সিনেমা। এটাই জনপ্রিয় হওয়ার মূল কারণ। এ জন্য আমি দর্শকের কাছেও কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই। কারণ একটা ছবির সফলতার জন্য দর্শকেরাই গুরুত্বপূর্ণ।’
বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন অনেকে
একটি গ্রামীণ নিটোল প্রেমের গল্প ছিল সিনেমাটিতে, যা দর্শকের মনে দাগ কেটে যায়। সে অনুভূতি তাঁরা বলেছেন অভিনয়শিল্পীদের কাছে। এমন অনুভূতি দশ বছর পরেও বেশ ভালো লাগে পরি চরিত্রের অভিনয়শিল্পী ফারহানা মিলির। তিনি বলেন, ‘এর আগে আমার কোনো সিনেমায় অভিনয়ের অভিজ্ঞতা ছিল না। মঞ্চে কাজ করি আর পড়ালেখা করি। অল্পবিস্তর টিভিতে কাজ করি। আমার ধারণা ছিল না যে ছবিটি কত জনপ্রিয় হবে। আমাকে মানুষ মনে রেখেছে, এটা একটা বড় পাওয়া। তখন ঢাকার হলগুলোতে গিয়ে অবাক হতাম। কারণ আমার বয়স খুব কম ছিল। আমি অবাক হয়ে দেখতাম, মানুষ আমাদের সিনেমায় দেখে কেমন করে। দশ বছর পরেও একজন আমাকে বলল, “আপা জানেন, তখন আমি আর আমার স্বামী প্রেম করতাম। আপনার সিনেমা দেখে বের হয়ে বলছি, আমরা এখন বিয়ে করব।” তাঁরা সিনেমা দেখে এটা অনুভব করেছেন। তাঁরা একে অপরকে হারাতে চান না। তাই বিয়ে করবেন। এখন তাঁদের সন্তানকে দেখিয়ে বলেন, “এই যে দেখেন, আমরা বিয়ে করেছি। আমাদের সন্তান।” এটা অনেক ভালো লাগে আমার কাছে।