হীরালাল সেনকে নিয়ে একটি অসমাপ্ত চলচ্চিত্র!
বছর ছয়েক আগে একটি চলচ্চিত্রের কাজ শুরু করি। এটি সোয়া শ বছরের বেশি আগেকার ব্রিটিশ আমলের প্রেক্ষাপট। সেটা আবার বিশ্ব চলচ্চিত্র ইতিহাসের সূচনালগ্ন। সে সময় এ দেশের মানিকগঞ্জে জন্ম নেওয়া এক তরুণ উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতা—এই চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ শুরু করার ক্ষেত্রে এ তথ্যটি ছিল আমার একমাত্র উত্সাহের কারণ। কিন্তু পরে কাজ করতে গিয়ে জানলাম, এ তথ্য সর্বজনস্বীকৃত নয়। আমার নির্মাতা–মন বিষয়টিতে আরও কৌতূহলী হয়ে ওঠে!
জানলাম, আমাদের কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘হীরালাল সেন’ ঊনবিংশ শতকের শেষ প্রান্ত থেকে বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশক অব্দি যে অর্ধশতাধিক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, তার কোনো নিদর্শন কোথাও কারও কাছে নেই। ১৯১৭ সালে কলকাতায় এক অগ্নিকাণ্ডে তাঁর সব চলচ্চিত্র পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। যেহেতু তাঁর কোনো চলচ্চিত্র কেউ কোনো দিন দেখেনি, শুনেছি সত্যজিৎ রায়ের মতো মানুষ পর্যন্ত এ ব্যাপারটিতে তাই গুরুত্ব দেননি। এরপর শুরু করি সিরিয়াস খোঁজাখুঁজি।
মানিকগঞ্জের বগজড়ি গ্রামে যাই, দেখি বসতবাড়ির সামান্যতম চিহ্নটুকু আর অবশিষ্ট নেই। সময় সব গিলে খেয়েছে। থাকার মধ্যে শুধু কয়েকটি পুকুর রয়েছে। বড় পুকুরের শেষ প্রান্তে একটা পুরোনো মন্দিরের মতো স্থাপনা। মন্দিরটা ঘিরে কিছু ছাপরাঘর। গ্রামের কিছু ভূমিহীন কৃষক-পরিবার সেখানে বসবাস করছে। জানতে পারলাম এটা আসলে মন্দির নয়, হীরালাল সেনের পিতামহ গোকুল মুন্সি সেনের সমাধিসৌধ। একইভাবে তাঁর কর্মস্থল কলকাতায় যাই। সেখানে মসজিদবাড়ি স্ট্রিট, হরীতকী বাগান স্ট্রিট, ব্ল্যাকওয়ার স্ট্রিট, রায়বাগান লেন খুঁজে তেমন কিছুর সন্ধান পাইনি।
শত বছর আগে মৃত্যুবরণ করা একজন মানুষকে খুঁজতে গিয়ে সমস্যায় পড়াটা অস্বাভাবিক নয় হয়তো। এর মধ্যে হীরালাল সেনের জ্যেষ্ঠ কন্যা সুরবালা সেনের পুত্র বীরেন্দ্রপ্রসাদ নিয়োগীর দেশপ্রিয় পার্ক রোডের বাড়ির ঠিকানা ও টেলিফোন নম্বর পাই। ওই নম্বরে ডায়াল করার পর যে ভদ্রলোক ফোন তুললেন—তাঁকে হীরালাল সেনের কথা জিজ্ঞেস করার পর তিনি আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন— ‘হু ইজ হীরালাল সেন?’ হীরালাল সেনের নাতি আজ আর জানে না— হীরালাল সেন কে!
হীরালাল সেনের ছোট কন্যা প্রতিভা দেবীর বিয়ে হয়েছিল ঢাকার গেন্ডারিয়ার বাসিন্দা বিখ্যাত আদিনাথ সেনের পুত্রের সঙ্গে। প্রতিভা দেবীর ভাসুর পুত্রের বউ হচ্ছেন বাংলা চলচ্চিত্রের বিখ্যাত অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন। সুচিত্রা সেনের পরবর্তী প্রজন্ম মুনমুন সেন হীরালালের বর্তমান প্রজন্মের কারও খোঁজ দিতে পারেননি। এমনকি লোকসাহিত্য বিশারদ দীনেশচন্দ্র সেন, বামপন্থী নেতা সত্যেন সেন এবং নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন—একই জ্ঞাতি হওয়া সত্ত্বেও কোনো দিক থেকে হীরালাল সেনকে খুঁজে পাওয়া গেল না। আসলে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে।
হীরালাল সেনের অস্তিত্ব কি গল্পের চেয়ে প্রকট? অনেকটা রূপকথার মতো! কিন্তু হীরালাল সেন তো রূপকথা নয়, বিস্মৃত—কিন্তু সত্য ইতিহাস। আবার পুরোপুরি বিস্মৃতিও নয়, অনেক অনেক তথ্য তো রয়েছে এবং ছিল। তবে অবহেলা একটা ছিল, এখনো আছে। এই অযত্ন-অবহেলাই তবে হীরালাল সেনকে রূপকথার বিচ্ছেদময় রাজপুত্রের গল্পে পরিণত করেছে।
বিস্মৃতপ্রায় মানুষটিকে খুঁজে পেতে এ সময়ের একজন নবীন নির্মাতার যাপিত চলচ্চিত্রযাত্রা মনখারাপের একশো বছর। এ যাত্রার ভেতর দিয়ে হারিয়ে যাওয়া এই মানুষটির এক ধরনের পূর্ণ অবয়ব নির্মিত হবে হয়তো। শুধু চলচ্চিত্র নয়—এটি বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির অভিযাত্রা। আগামীকাল ২ আগস্ট হীরালাল সেনের জন্মদিন। প্রতিবছরই ভাবি, আগামী বছর তাঁর জন্মদিনের আগে এ চলচ্চিত্রের চূড়ান্ত শুটিং শুরু করতে পারব! তাই আপাতত শুধু শ্রদ্ধা জানাই তাঁকে। তাঁর জন্য ভালোবাসা। একদিন আমাদের শুটিং শুরু হবে নিশ্চয়ই।
লেখক: চলচ্চিত্র নির্মাতা