সস্তা মোড়কে ভালো বই
‘আপানার সেফটিপিন নেই’— বারবার শাড়ির আঁচল খুলে পড়লে এমন একটা ছোট্ট হাস্যরসাত্মক সংলাপ দর্শককে বিনোদন দিতে সক্ষম হয়েছে। সংলাপটি আবার বসন্ত ছবির। এই লাইন শুনে দর্শকের হাসির শব্দ পেয়েছি। পাশাপাশি সেই দর্শকের মুখ থেকে ‘এটা সিনেমা না, টেলিফিল্ম’ এমন সমালোচনাও শোনা গেছে। ছবি দেখে বলতে পারি, কারিগরি দিকের দুর্বলতার কারণে হয়তো দর্শকের মনে ‘সিনেমা না, টেলিফিল্ম’ এমন ধারণার উদ্রেক করেছে। কাজেই বলব, সিনেমা হলের দর্শকই এখন অনেক বড় সমালোচক। তাঁরা নির্ণয় করতে জেনে গেছেন নাটক, টেলিফিল্ম, সিনেমা, মঞ্চ কিংবা রিয়েলিটি শোয়ের ফারাক।
আবার বসন্ত ছবিটিকে বলা যায় সস্তা মোড়কে ভালো বই। অনেক সময় প্রচ্ছদটা ভালো না হলেও কিছু বই আছে যে পড়লে কিছু জানা যায়। আবার বসন্ত ছবির বিষয়বস্তু একটা সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। পরিবারের বাবাও যে একজন মানুষ, তারও স্বপ্ন আছে, চাওয়া–পাওয়া আছে—এই বার্তাটি ভালো। পরিবারের প্রতিটি মানুষ যে গুরুত্বপূর্ণ আমরা এমন গল্প থেকে অনেক দিন ধরে দূরে আছি। বাবা কেন চাকর?, বাড়ি থেকে পালিয়ে, গল্প হলেও সত্যি, জীবন থেকে নেয়া, ছুটির ঘণ্টা— এসব চলচ্চিত্র মূলচরিত্র–নির্ভর সিনেমার গল্প। তৎকালীন বাংলাদেশি ও ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্রে আমরা হরেক রকমের গল্প পেতাম, যা সত্যি একটি বই পড়ার মতো জ্ঞান দিত; আজকাল আমাদের বেশির ভাগ দেশি চলচ্চিত্রই মনের কিংবা জ্ঞানের ভান্ডার জোগাতে অন্তঃসারশূন্য।
যদিও আবার বসন্ত চলচ্চিত্রটির বিষয়বস্তু নিয়ে বিশ্বের নানা দেশ অনেক ভালো চলচ্চিত্র বানিয়ে সফল ও নন্দিত। অস্কারপ্রাপ্ত ছবি আমেরিকান বিউটিতে আমরা পেয়েছি একজন ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিকে প্রেমময় নব যৌবনে। জগার্স পার্ক–এ ছবিতে ভিক্টর ব্যানার্জি রোজ সকালে পার্কে হাঁটতে গিয়ে খুঁজে পেয়েছিলেন জীবনশক্তি। সবকিছুর মূলেই ছিল একজন অল্পবয়সী নারীর সান্নিধ্যলাভে প্রাণশক্তি ফিরে পাওয়ার গল্প। পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ছবি বেলা শেষে চলচ্চিত্রে ষাটোর্ধ্ব সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও হঠাৎ পরিবারে ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি বিবাহবিচ্ছেদ চান। এই নিয়ে শুরু হয় পারিবারিক বিপর্যয়, মানসিক অশান্তি, সামাজিক টানাপোড়েন অনেক অজানা গল্প। আবার বসন্ত ছবিতেও পরিচালক এই সমাজের একজন বয়োজ্যোষ্ঠ ধনী শিল্পপতির জীবনের চাওয়াকে তুলে ধরে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন বলে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু চলচ্চিত্রের ক্যানভাস গল্পটিকে আঁকতে তিনি নানাভাবে ব্যর্থ, যেমন— খাপছাড়া চরিত্রায়নে, শিল্পনির্দেশনায়, কারিগরি কৌশলে, আবহসংগীতে এবং চিত্রনাট্যের সুনিপুণ সবিস্তারে। অযাচিত শব্দবিন্যাসে বোনা চলচ্চিত্রের সংলাপকে বারবার হেয় করছিল বাঁশির শব্দ প্রয়োগ। তবে ‘ইমরান চৌধুরী’ (তারিক আনাম খানের চরিত্র) প্রতিটি সংলাপে দৃঢ়তা, বক্তব্যে স্পষ্ট করেছিলেন এই সিনেমায় বলতে চাওয়া একজন ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তির জীবনের সামাজিক আস্বাদ। সিনেমাতে সংলাপ প্রক্ষেপণে সাফল্যের সঙ্গে দর্শককে মনোযোগী করতে পেরেছেন পরিচালক।
আবার বসন্ত
অভিনয়: তারিক আনাম খান, স্পর্শিয়া, আনন্দ খালিদ, মুক্তি জাকারিয়া, ইন্তু, রাতিশ প্রমুখ।
কাহিনি, চিত্রনাট্য ও পরিচালনা: অনন্য মামুন
ইমরান চৌধুরীর প্রাসাদোপম বাড়িটির অন্দর ও বাইরের গৃহসজ্জায় রুচির বিস্তর ফারাক বারবার সিনেমার ফ্রেমে অস্বস্তি এনে দিয়েছে। একজন পাটশিল্পের শিল্পপতি মনে হয় আরও রুচিশীল হতে পারতেন। ইমরান চৌধুরীকে ডিপ্লোম্যাটিক জোনের কোনো একটি সিকিউর অ্যাপার্টমেন্টের বাসিন্দা হিসেবে দেখালেও সমস্যার কিছু ছিল না, তাতে চরিত্রটিকে আরও জীবনঘনিষ্ঠ ও বাস্তবসম্মত মনে হতো। পরিবারের অন্যদের জীবনেও বিস্তৃতির অভাব চোখে পড়েছে। হুট করে বাবার বিবাহের সিদ্ধান্তে সামাজিক লজ্জা, দ্বিধা–দ্বন্দ্ব, মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েনে মনের ভেতর ক্ষোভের সৃষ্টি করে এবং সেই থেকে অসহিষ্ণু হয়ে পরিবারের একজন একটি খুন করে ফেলে— এমন ঘটনাকে পরিচালক পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে অপারগ হয়েছেন। সন্তানদের চরিত্রায়নের ক্ষেত্রে শিল্পী নির্বাচন ছিল খেলো। টেলিভিশনের ডেইলি সোপের মতো সোফায় সারিবদ্ধ হয়ে বসে সন্তানেরা পারিবারিক এত বড় একটা ঘটনাকে শুধু ক্লোজশট অভিব্যক্তিতেই শেষ করে দিয়েছেন, যা সিনেমার আবহ তৈরির অন্তরায়। বাবার সঙ্গে সন্তানদের রূপরেখা, গঠন, কাঠামোর কোনো সামঞ্জস্যই ছিল না। কাজেই সিনেমার ফ্রেমে বিশ্বাসযোগ্যতার কিছুটা অভাব ফুটে ওঠে। তারিক আনাম খান ‘ইমরান চৌধুরী’র চরিত্রে সেঞ্চুরি করেছেন, সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয়ে দারুণ করেছেন স্পর্শিয়াও। অনেক রান নিয়েছেন ‘শিল্পপতির পিএস’ চরিত্রে আনন্দ খালিদ। করভী মিজানের চরিত্রটা দারুণভাবে মানিয়ে গেলেও তার পরিসর ছিল সংক্ষিপ্ত। মা–মেয়ের সম্পর্কের জায়গা আরও ফোকাস হলে মেয়েটির মানসিক দুর্বলতার বিষয়টি দর্শক বুঝে উঠতে সক্ষম হতো। বিদেশের মনোরম লোকেশনে দৃশ্যায়িত অংশ কমিয়ে বরং আমাদের সামাজিক চিন্তার অবক্ষয়ের দিকে আরও নজর দিলে আবার বসন্ত একটি পূর্ণাঙ্গ সফল চলচ্চিত্র হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারত। তবে তরুণ পরিচালকেরা গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে এই যে নতুন কিছু ভাবছে, যা চলচ্চিত্রের সুদিনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।