শামীম কীভাবে মোশাররফ করিম হলো
>বাড়ির লোকেরা হতাশ ছিলেন মোশাররফ করিমের ভবিষ্যৎ নিয়ে। কিন্তু তিনিই হয়ে উঠলেন সংস্কৃতিজগতের গুরুত্বপূর্ণ একজন। এখন টিভি নাটকে দারুণ জনপ্রিয় তিনি। ১৫ ডিসেম্বর প্রথম আলোকে শোনালেন নাটকের দলে প্রবেশ, সম্মানীসহ শামীম থেকে মোশাররফ করিম হয়ে ওঠার গল্প
উত্তরার বাসায় পা দিতেই বোঝা গেল মানুষে গমগম করছে। সবাইকে নিয়ে খেতে বসেছেন মোশাররফ করিম। খাবারের মেনু: লাউশাক ভাজি, বাঁধাকপি ও শিম ভাজি। বোয়াল মাছের ঝোল, মুরগির তরকারি এবং গরুর ঝুরি মাংস। মোশাররফ করিম অল্প পরিমাণে সবই খেলেন। পাশে তাঁর ছেলেকে খাইয়ে দিচ্ছেন দাদি। সেদিকেও খেয়াল রাখলেন। খেতে খেতে চলল পারিবারিক আলাপ।
মোশাররফ করিমের বাসার ওপরের তলায় তাঁর অফিস। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান এম প্রোডাকশন। কথা হলো, সেখানে বসেই আলাপ করবেন।
অগোছালো অফিস, গোছানো আলাপ
অফিসটা এখনো গোছানো শেষ হয়নি। অন্দরসজ্জা চলছে। এরই মধ্যে এডিটিং প্যানেলসহ অনেক কিছুই বসে গেছে। আমরা বসতে বসতে ওপরে চলে এলেন মোশাররফ। বললেন, ‘এই প্রোডাকশন হাউসের লোগো আমার নিজের হাতে ডিজাইন করা।’
সেটা দেখতে দেখতে জানতে চাই, আপনার তো হরদম শুটিং লেগেই আছে। লোগো ডিজাইন করার মতো সময় পান? উত্তর প্রস্তুত ছিল তাঁর কাছে। ‘কিছুদিন ধরে চেষ্টা করছি কাজ কম করার। করলেও সেটা অবশ্যই চিত্রনাট্য পড়ে, জেনে এবং বুঝে। পছন্দ হলে তবেই শুটিংয়ে যাচ্ছি।’
গত এক বছরে এই বদলটা চোখে পড়েছে। কাজ কমিয়েছেন। দেশে–বিদেশে নিয়মিত ঘুরে বেড়িয়েছেন। পরিবারকে সময় দিয়েছেন। তিনি মনে করিয়ে দিলেন, ‘এক বছর আগে প্রথম আলোকে বলেছিলাম, আমার পরিকল্পনা নিয়ে। সেটা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করেছি। সামনে আরও সচেতন হব।’
তারকা হওয়ার পর সবাই মোশাররফের খোঁজখবর জানেন। আমরা ওই সময়ের গল্প শুনতে চাই, যখন তিনি তারকা ছিলেন না। একজন মোশাররফ করিম হয়ে ওঠার জন্য আপনার প্রস্তুতি কেমন ছিল?
কিছুক্ষণ ভাবেন মোশাররফ করিম। ‘প্রায়ই আমাকে অনেকে একটা কথা বলতে চায়, আমি অনেক স্ট্রাগল করে বড় হয়েছি। এটা ঠিক নয়। আমি আসলে স্ট্রাগল করা ছেলে নই। আমার যা ভালো লাগে আমি তা–ই করি। যেমন আমাকে ছোটবেলায় কখনো বাজারে পাঠাতে পারত না কেউ। আমার দর-কষাকষি ভালো লাগে না। এখনো যে এসির মধ্যে বাজার, সেখানেও ভালো লাগে না। কিন্তু আমি যখন নাটকের দলে যোগ দিই, তখন থাকতাম খিলগাঁওয়ে। দলের মহড়া হতো নীলক্ষেতে। অনেক দিন আমি হেঁটে হেঁটে গিয়েছি সেখানে। যদি কেউ বলে এই হেঁটে যাওয়া স্ট্রাগল, তাহলে সেটা আমি মানব না। হেঁটে যেতেই আমার আনন্দ লাগত। তো যেটা করে আনন্দ পেতাম বা পাই, সেটা কী করে স্ট্রাগল হয়?’ একটানা বলে থামেন তিনি।
মোশাররফ করিম ছোটবেলায় থেকেছেন ঢাকায়। তারপর পঞ্চম শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন গ্রামের স্কুলে। এসএসসির পর এসে উঠেছেন ঢাকার খিলগাঁওয়ের বড় ভাইয়ের বাসায়। এইচএসসিতে ভর্তি হয়েছিলেন তেজগাঁও কলেজে। পাশাপাশি নাট্যকেন্দ্রের দলে। তারপর পড়েছেন ঢাকা কলেজে।
নিজের আরও একটা তথ্য দিলেন মোশাররফ, ‘আমাকে নিয়ে আমার পরিবার বা আত্মীয়স্বজন কারও কোনো আশা–ভরসা ছিল না। আমাকে দিয়ে কিছু হবে বা জীবনে কিছু একটা করতে পারব, এটা কেউ ভাবতেই পারত না। তারাও অনেকটা হতাশা থেকেই আমাকে ছেড়ে দিয়ে রাখত। আমিও চলতাম আমার মতো। আমি যেটা ভালোবাসি না বা পছন্দ করি না, সেটা আমি করতে পারি না। আমার লাভের চেয়ে ভালো লাগাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’
শামীম থেকে মোশাররফ করিম
ডাক নাম ছিল শামীম। এই নামেই চিনতেন পরিবার, বন্ধু এবং কাছের মানুষেরা। এখনো চেনে। তবে সেটা ছাপিয়ে সারা দেশের মানুষের কাছে তিনি মোশাররফ করিম। শামীম থেকে কীভাবে হয়ে গেলেন মোশাররফ করিম?
বললেন, ‘আমার ডাক নাম শামীম। আর সার্টিফিকেট নাম মোশাররফ হোসেন। আমার বাবার নাম আব্দুল করিম। বাবা মঞ্চে অভিনয় করতেন। কিন্তু তাঁর অভিনয় দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তাঁর আবৃত্তি শুনেছি। দারুণ দরাজ গলা ছিল বাবার। আমি যখন পুরোপুরি অভিনয় শুরু করি, তখন মনে হয় বাবার কিছু একটা আমার সঙ্গে থাকুক। এই ভাবনা থেকেই তাঁর নামের একটা অংশ নিজের নামের সঙ্গে লাগিয়ে নিই। পুরো নাম হয়ে যায় মোশাররফ করিম। তারপর থেকে এই নামেই পরিচিত হয়ে যাই।’
জানালেন, ২০০৩–০৪ সালের দিকে পুরোদমে টেলিভিশন নাটকে অভিনয় শুরু করেন তিনি। ক্যারাম নাটকটি জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। ওই সময়টাতেই বদলে ফেলেন নাম। তার আগে থিয়েটারের মানুষও তাঁকে চিনত মোশাররফ হোসেন নামে। কেউ কেউ ডাকতেন শামীমও। এখনো পরিবারের সবাই তাঁকে শামীম নামেই ডাকেন।
অভিনয় থেকে অভিনয়
মোশাররফ করিমের ভাষায়, আক্ষরিক অর্থেই ছোটবেলা থেকে অভিনয়ই তাঁর জীবন। তখন যাত্রায় অভিনয় করতেন। একদম পেশাদার যাত্রাপালা। লোকে টিকিট কেটে সেই যাত্রাপালা দেখত। তারপর এলেন থিয়েটারে। এখন টেলিভিশনে। বলেন, ‘আমার কাছে থিয়েটার হচ্ছে এমন জায়গা, যেখানে অভিনয় করতে, এমনকি যেকোনো কাজ করতেই ভালো লাগত। আমার মনে হতো, আমি একটা দারুণ কাজ করছি। একজন কবি বা লেখক একটা লাইন বা কবিতা লেখার পর যে আনন্দটা পান, মঞ্চ তো আমাকে প্রতিদিন সে আনন্দ দিত। ১৯৯০ সালে থেকে সেই অনুভূতি নিয়ে আমি বড় হয়েছি।’
নাট্যকেন্দ্রের নাম তখনো ঠিক করা হয়নি। শুরু হয়েছে ফরম বিতরণ। প্রায় চৌদ্দ–পনেরো শ ছেলেমেয়ে ফরম সংগ্রহ করেছিলেন সেবার। সবাইকে ধাপে ধাপে ডাকা হলো। তাঁদের মধ্যে এখনকার জনপ্রিয় অভিনেতা জাহিদ হাসান ও মোশাররফ করিমও ছিলেন। সাক্ষাৎকারের স্মৃতি মনে করে মোশাররফ বললেন, ‘আমাদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন হুমায়ুন ফরীদি ও তারিক আনাম খান ভাই। ফরীদি ভাই জানতে চাইলেন, ঢাকায় আমি কী কী নাটক দেখেছি। প্রিয় লেখক কে? যত দূর মনে পড়ে প্রিয় লেখকের নামের জায়গায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম বলেছিলাম।’ তারপর মঞ্চে প্রথম অভিনয় করেছেন বিচ্ছু নাটকে। একে একে নাট্যকেন্দ্রের অনেক নাটক নিয়েই মঞ্চে উঠেছেন আজকের জনপ্রিয় অভিনেতা মোশাররফ করিম।
উড়ে বেড়ানো জীবন
পুরোদস্তুর অভিনেতা হওয়ার আগে শিক্ষকতা করেছেন মোশাররফ করিম। তবে সেটা টিউশনি ও কোচিং সেন্টারের শিক্ষক। এর আগে খণ্ডকালীন জরিপের কাজ করেছেন। হয়েছিলেন এইডসবিষয়ক ক্যাম্পেইনের একজন সমন্বয়কারী। করেছেন চেয়ারম্যান প্রার্থীর নির্বাচনী পোস্টার ডিজাইন।
মজা করে জুতা দেখে ভাগ৵ বলে দিতে পারতেন মোশাররফ করিম। একটা মজার জীবন পার করে এসেছেন উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি মাঝেমধ্যে ভাবি, তখন কি আমি খুব কষ্টে ছিলাম, খারাপ সময় যেত আমার? আমি সেটা খুঁজে পাই না। আমার কাছে তো মনে হয় ওটা একটা দুর্দান্ত জীবন ছিল আমার। অনেক বেশি মুক্ত ও স্বাধীন জীবনযাপন ছিল। অর্থ মানুষের জীবনে জরুরি, কিন্তু খুব যে জরুরি, এটা বলব না। বেঁচে থাকার জন্য যতটা জরুরি, সেটা হলেই তো যথেষ্ট। টাকা এলে খরচ করবে, এটাই স্বাভাবিক, টাকার জন্য জোরজবরদস্তির কিছু নেই।’
টাকার প্রশ্ন আসতেই জানতে চাই, কিন্তু আপনাকে নিয়ে একটা অভিযোগ আছে, নাটকে সবচেয়ে বেশি সম্মানী আপনি পান। নাটকের অর্ধেক বাজেট আপনাকে সম্মানী হিসেবে দিতে হয়। ‘আমার সম্মানী কিন্তু আমি বাড়াইনি। আমি কোনো দিনই বলিনি আমাকে এত টাকা দাও। আমার সম্মানী বাড়িয়েছেন প্রযোজক ও পরিচালকেরা। এটাও তো সত্য, আমার অভিনীত নাটক বেশি দামে বিক্রিও হয়। সবকিছুরই একটা ব্যালেন্স করতে হবে।’ বলেন মোশাররফ করিম।
কেন এত জনপ্রিয় মোশাররফ?
টেলিভিশন নাটকের এ সময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা মোশাররফ করিম। এটা নতুন তথ্য নয়। কয়েক বছর ধরেই এই জায়গাটা পাকাপোক্ত করে ধরে রেখেছেন তিনি। কোথাও হাঁটলে, দাঁড়ালে বোঝা যায় তাঁর জনপ্রিয়তা কতটা। জানতে চাই, মোশাররফ করিম এত জনপ্রিয় কেন? সেই উত্তর তিনিও দিতে পারলেন না। ‘আমি ঠিক জানি না কেন মানুষ আমাকে পছন্দ করেন। সৃষ্টিকর্তা ভালো বলতে পারবেন। অনেক সময় কাজ করে নিজের তৃপ্তি আসে না। মনে হয়, আরও ভালো করা যেত হয়তো। সেই জায়গা থেকে এত জনপ্রিয়তার জন্য সৃষ্টিকর্তা ও ভক্তদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।’
শেষ প্রশ্ন হিসেবে জানতে চাই, অনেকেই মোশাররফ করিমের মতো হতে চায়। তাদের জন্য আপনার বক্তব্য কী?
‘আমার প্রথম কথা হলো, মোশাররফ করিম হওয়ার চেষ্টা না করা। কারণ এই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ আলাদা। সবার মধ্যেই সূক্ষ্ম কোনো গুণ নিশ্চয়ই রয়েছে। সেটা বের করে প্রকাশ করা জরুরি। মাথায় রাখতে হবে, কাঁঠাল কিন্তু চৈত্র মাসে বলে না, আমি কেন পাকি না। প্রকৃতির নিয়মে সে জ্যৈষ্ঠ মাসেই পাকবে। একমাত্র মানুষই চৈত্র মাস অর্থাৎ অসময়ে চিৎকার করে। আমি পাকি না কেন? তাই সময়মতো ভালোবাসা দিয়ে অপেক্ষা করতে হবে। নিশ্চয়ই তুমি জ্বলে উঠবে।’