শরীর, মন ও জীবনের জন্য নাচ
কার নাচ বেশি চোখ জুড়িয়েছিল, ঐশ্বরিয়া রাই নাকি মাধুরী দীক্ষিতের? বলিউডের ছবি ‘দেবদাস’-এর এ দুই নায়িকার মধ্যে কে বেশি নম্বর পাবেন, সেটা নির্ধারণ করা কিন্তু ভীষণ কঠিন। সিনেমার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই কলা, নাচ এখন আরও আভিজাত্যের সঙ্গে বলিউডে জায়গা করে নিয়েছে। এমনকি শাস্ত্রীয় নাচের মুদ্রাগুলো ভেঙে তৈরি হয়েছে নানা আধুনিক নাচ। ‘স্ট্রিট ড্যান্সার’ বা ‘স্টুডেন্ট অব দ্য ইয়ার’ সিনেমাগুলোতে সমসাময়িক নাচের সেই উত্তাপ টের পাওয়া যায়। তবে নাচ এখন আর কেবল বিনোদন নয়, জীবনেরও অনুষঙ্গ, আনন্দ প্রকাশের ভাষা।
শাস্ত্রীয় নাচ এখন বিপুল সম্মানের জায়গায় পৌঁছে গেছে। এ ঘরানা নিয়ে পড়াশোনা, গবেষণা ও সুধীমহলে মঞ্চ পরিবেশনার আয়োজন হয়ে থাকে। বিপুল ব্যবস্থাপনার সুযোগ থাকায় বলিউডে ‘বাজিরাও মাস্তানি’ বা ‘পদ্মাবত’-এর মতো ছবিতে এ নাচকে জমকালো রূপে দেখাও যায়। একসময় ভারতের শাস্ত্রীয় নাচের পণ্ডিতদের কাছে শিখে এসে বাংলাদেশে নৃত্যশিক্ষার হাল ধরেছিলেন অনেক শিল্পী। সেই ধারা এখনো অব্যাহত। এ ছাড়া যুক্ত হয়েছে বলিউড ড্যান্স ও সমসাময়িক নাচের চর্চা। ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত নৃত্যশিল্পী আকরাম খান থেকে শুরু করে বলিউডের হৃতিক রোশন ও টাইগার শ্রফরা ভীষণভাবে টানছে তরুণদের। ঢাকা থেকে বৃত্তি নিয়ে শিখতে অনেকে যেমন যাচ্ছেন আকরাম খান ড্যান্স কোম্পানিতে, তেমনি বলিউডের তেরেন্স লুইস ড্যান্স কোম্পানিতেও।
বলিউডের তুলনায় ঢালিউডে নাচের জায়গা নেই বললেই চলে। গুরুমুখী শিক্ষা নিয়েছেন এমন নৃত্যপরিচালকেরা এখনো সেখানে ঠাঁই পাননি। আর টাকার অভাবে নাচের যথেষ্ট আয়োজন আমাদের সিনেমায় এখন আর নেই। শিল্পী শিবলী মহম্মদ বলেন, ‘ঢালিউডে নৃত্যশিল্পীদের সম্মানী দেওয়ার মতো বাজেটই রাখা হয় না। তারপর সেট, পোশাক—এগুলোর জন্য খরচ থাকে। ভালো বাজেট ছাড়া সেটা সম্ভব নয়।’ যদিও আমাদের নৃত্যশিল্পীরা অনেক সক্রিয়। ভরতনাট্যম, কত্থক, মণিপুরি, গৌড়িয়র মতো শাস্ত্রীয় নাচের অনেক মেধাবী শিল্পী রয়েছে আমাদের। সমসাময়িক নাচের ক্ষেত্রেও তা–ই। এমনকি পুরাণের গল্পকে নৃত্যনাট্যের মাধ্যমে মঞ্চে আনার প্রবণতাও এখানে প্রশংসা কুড়িয়েছে। বিভিন্ন সময় এসব প্রযোজনা এনেছে সাধনা, নৃত্যাঞ্চল, সৃষ্টি, ধৃতি নর্তনালয়, ভাবনা, তুরঙ্গমীর মতো দলগুলো।
বাংলাদেশের নানা আন্দোলন-সংগ্রাম ও স্মরণ-শ্রদ্ধায় নাচের ভাষাকে কাজে লাগিয়েছেন শিল্পীরা। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে আকরাম খান ড্যান্স কোম্পানির তত্ত্বাবধানে জাতির জনকের জীবনীভিত্তিক নৃত্য প্রযোজনা সেটা মনে করিয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া জার্মান নৃত্যশিল্পী টমাস বুঙ্গারের হাত ধরে একঝাঁক তরুণকে মঞ্চে দেখা গিয়েছে সমাজের নানা অসংগতিকে নাচের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। আমাদের দেশের গান বা গণসংগীতের সঙ্গে করা নাচগুলো বছরের পর বছর মানুষকে উদ্দীপ্ত করে আসছে। স্বদেশি আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলন, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, মন্বন্তর, মুক্তিযুদ্ধ, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান স্মরণে ‘মায়ের দেয়া মোটা কাপড়’, ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে’ বা ‘ও আলোর পথযাত্রী’, ‘কারার ওই লৌহ কপাট’, ‘আর দেব না রক্তে বোনা ধা’ গানগুলো তারই স্বাক্ষর বহন করে।
শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যসচেতনতায় নাচকে আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। শরীরচর্চা বা ব্যায়ামের মতো কর্মকাণ্ডকে আরও অর্থবহ করার জন্য সেটাকে সুরের সঙ্গে নাচের ভঙ্গিতে করার কথা বলেছেন অনেকে। আকরাম খান মনে করেন, শরীরের নিজস্ব ভাষা আছে, সেটা আরও শক্তিশালী। যুগ যুগ ধরে এ চর্চা ভিন্ন ভিন্ন সভ্যতার জন্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ। দেহভঙ্গি বিশ্বের কাছে বার্তা পাঠানোর এক শক্তিশালী মাধ্যম।
শারীরিক নানা প্রতিবন্ধকতার রোগীদের ড্যান্স থেরাপি দেওয়ার প্রচলন শুরু হয়েছে বেশ আগে থেকেই। আমেরিকান ড্যান্স থেরাপি অ্যাসোসিয়েশন বলছে, শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও জ্ঞানভিত্তিক এই থেরাপি মানুষকে সব দিক থেকেই সুস্থ ও সক্রিয় করে তোলে। সবচেয়ে বড় বার্তাটি দিয়ে গেছেন স্বয়ং কবিগুরু। নাচকে জীবনের অনুষঙ্গ হিসেবে যাপন করার দর্শন তো তাঁরই।