লোকে একে ভাঁড়ামো ভাবত
পথের ওপর ধর্ষণ! না। ধর্ষণের অভিনয়। অপমানের যে যন্ত্রণা, তার অভিনয়। মুখমণ্ডলে সাদা রংমাখা কয়েকজন তরুণ সেই অভিনয় করছিলেন। সেই মূকাভিনয় সেটা দেখে পথচারী দর্শকেরা ফিরে গেছেন ধর্ষকের প্রতি ঘৃণা নিয়ে।
মাইম বা মূকাভিনয় বাংলাদেশে নতুন নয়। তবে সম্প্রতি শিল্পটি বিকশিত হতে শুরু করেছে। এর পেছনে রয়েছেন বেশ কয়েকজন তরুণ। মীর লোকমান তাঁদের একজন। একদল শিল্পী যখন বিনোদিত করার উদ্দেশ্যে মূকাভিনয়কে ব্যবহার করছেন, লোকমান তখন একে একটা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে—যে অস্ত্রে রক্তপাত হয় না।
কেবল বিবেকের মর্মমূলে গিয়ে আঘাত করবে। দেশে এ পর্যন্ত যতগুলো অনিয়ম, অন্যায়, অপরাধের ঘটনা ঘটেছে, তার প্রায় সব ঘটনা নিয়ে প্রযোজনা নির্মাণ করেছেন লোকমান ও তাঁর দল ঢাকা ইউনিভার্সিটি মাইম অ্যাকশন। ধর্ষণ, হত্যা, আত্মহত্যা, নারীর প্রতি সহিংসতা, বৌদ্ধমঠে হামলা, ফিলিস্তিন ও মিয়ানমারে ঘটে যাওয়া অমানবিক হত্যাযজ্ঞ—এসব ঘটনা নিয়ে কাজ করেছেন লোকমান ও তাঁর দল। বিনোদনের বদলে কেন সচেতন করার দায় নিলেন তিনি?
মীর লোকমান জানালেন, মাইম যতটা শক্তিশালী শিল্প, তাতে একে বিনোদনের জন্য ব্যবহার করলে তার পূর্ণ ব্যবহার করা হয় না। সে জন্য মানুষকে সচেতন করতে তাঁরা একে ধারণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা কেবল টেলিভিশন বা মঞ্চে একে আটকে রাখিনি। বরং ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জায়গায় পথপ্রদর্শনী করেছি। সাধারণ মানুষ ঘিরে দাঁড়িয়ে আমাদের পরিবেশনা দেখেছে। তাদের মধ্যে এতটুকু সচেতনতা যদি তৈরি হয়, সেটা আমাদের সার্থক করেছে।’ কিন্তু মানুষ কি সচেতন হয়? লোকমান বললেন, ‘মানুষের অভিব্যক্তি বলে দেয় যে সে আমাদের শরীরের ভাষা ও অঙ্গভঙ্গি বুঝতে পারছে।’
কিন্তু লোকমান কেন এলেন মূকাভিনয়ে? লোকমান জানালেন, অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন নরসিংদীতে নিজের এলাকার এক অনুষ্ঠানে এক শিল্পীকে পরিবেশন করতে দেখে তাঁর ভালো লেগে যায় ব্যাপারটা। বয়স বাড়ার পর ২০১১ সালে শিল্পকলা একাডেমিতে একটি কর্মশালা করে তিনি এর চর্চা শুরু করে দেন। তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে আমি অনেক কিছু করতাম। কিন্তু কেন যেন এটাই আমার ভালো লেগে গেল। এই ৮ বছর একটি দিনের জন্য মাইমের বাইরে আমি থাকিনি। শিগগির ফিজিক্যাল অ্যাকটিং নিয়ে পড়তে পোল্যান্ড যাচ্ছি। আশা করি ফিরে এসে এই চর্চা করব এবং এর সঙ্গেই থাকব।’
২০১১ সালে লোকমান প্রতিষ্ঠা করেন ঢাকা ইউনিভার্সিটি মাইম অ্যাকশন। শুরুতে ৬ জন নিয়ে যাত্রা করলেও এখন এর সদস্য সংখ্যা ৬০ জন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে সংগঠনটি বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় তথা দেশ-বিদেশের বহু মঞ্চে ৫০০টির অধিক প্রদর্শনী করেছে।
মূকাভিনয়ের চর্চা করতে গিয়ে মানুষের বাঁকা হাসি উপেক্ষা করতে হয়েছিল? জানতে চাইলে লোকমান বলেন, শুরুতে হয়েছিল। লোকে একে ভাঁড়ামো ভাবত। এখন আর ভাবে না। কিন্তু এ অবস্থায় আসার জন্য আমাদের অনেক ধৈর্য ধরতে হয়েছে।
আগামীকাল বুধবার রয়েছে মীর লোকমানের ১০ম পূর্ণাঙ্গ একক মূকাভিনয় প্রদর্শনী ‘অ্যানাদার ওয়ার্ল্ড’। নানা অনিয়ম ও অসংগতির বিপরীতে পরিবর্তনের বার্তা নিয়ে ৮টি স্কেচ মাইমের সমন্বয়ে ১ ঘণ্টার এই প্রযোজনাটি শুরু হবে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় আলিয়ঁস ফঁসেজের লা গ্যালারিতে।
মীর লোকমান ইতিমধ্যে নিজের ৯টি পূর্ণাঙ্গ একক প্রদর্শনী করেছেন। তাঁর সর্বশেষ প্রযোজনাটি প্রদর্শিত হয়েছিল পূর্ব ইউরোপের দেশ আর্মেনিয়ায়। ভারত এবং দক্ষিণ কোরিয়াতেও মূকাভিনয় প্রদর্শনীতে অংশ নেন তিনি।