যে ছবিগুলো দিয়ে অমর হয়ে থাকবেন তিনি

ছুটির ঘণ্টা। ফাইল ছবি
ছুটির ঘণ্টা। ফাইল ছবি

নায়করাজের সুদীর্ঘ ক্যারিয়ারে তাঁর অসংখ্য চলচ্চিত্র থেকে সেরা দশ চলচ্চিত্র বাছাই করা কঠিন কাজ। তবে এই ছবিগুলোর জন্য তিনি অমর হয়ে থাকবেন বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে—

ছুটির ঘণ্টা
আজিজুর রহমান পরিচালিত সত্য ঘটনা অবলম্বনে আলোচিত ছবি। ১৯৮০ সালে নির্মিত। স্কুল ছুটির পরে স্কুলছাত্রের বাথরুমে আটকে পড়ার পর বেঁচে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা নিয়ে নির্মিত মর্মান্তিক গল্পের ছবি। ছবিতে রাজ্জাক ছিলেন স্কুলের দপ্তরি। তাঁর ভুলেই স্কুলছাত্র আটকে পড়ে। ছুটি শেষে সেই ছাত্রের লাশ পাওয়া যায়। মৃত্যুর আগে বাথরুমের দেয়ালে মর্মস্পর্শী সব কথা লিখে যায় সেই ছাত্র। সেগুলো দেখে রাজ্জাক স্বাভাবিকতা হারিয়ে হাসতে হাসতে পরে পাগল হয়ে যায়। রাজ্জাকের অভিনয়জীবনের অন্যতম সেরা ছবি।

সৎভাই
রাজ্জাক পরিচালিত ও অভিনীত ১৯৮৫ সালে নির্মিত অসাধারণ ছবি। এ ছবি থেকে পরবর্তীকালে ১৯৯৯ সালে ‘সন্তান যখন শত্রু’ ছবিটি রিমেক করা হয়। সে ছবিতে রাজ্জাকের ভূমিকায় ছিল তাঁর ছেলে নায়ক বাপ্পারাজ। বাবার মৃত্যুর পর দুই ভাইয়ের সাংসারিক দ্বন্দ্ব এবং সম্পত্তিবিষয়ক জটিলতা নিয়ে মর্মস্পর্শী গল্পের ছবি।

জীবন থেকে নেয়া। ফাইল ছবি
জীবন থেকে নেয়া। ফাইল ছবি

অশিক্ষিত
‘অশিক্ষিত’ মুক্তি পায় ১৯৭৮ সালে। পরিচালক আজিজুর রহমান। গ্রামের চৌকিদার রহমত (রাজ্জাক) লেখাপড়া জানে না। অশিক্ষিত রাজ্জাককে লেখাপড়া শেখায় গ্রামের দরিদ্র অনাথ বালক মাস্টার সুমন। রাজ্জাক নাম দস্তখত করা শেখে তার কাছে। শেষে দুর্নীতিবাজ আড়তদারের অপরাধ দেখে ফেলায় খুন হয় সুমন। তার খুনের সাক্ষী হয় রাজ্জাক এবং তাঁর সাক্ষ্যে শাস্তি হয় অপরাধীর। সাক্ষীর দরখাস্তে নিজ হাতে নাম সই করে রাজ্জাক। অশিক্ষিতের সামাজিক মর্যাদা দেখানোই ছিল সিনেমাটির লক্ষ্য। বহুল প্রশংসিত এ ছবির ‘মাস্টার সাব আমি নাম দস্তখত শিখতে চাই’ গানটি এখনো গেঁথে রয়েছে সিনেমাপ্রেমীদের মনে। এ ছবিতে অভিনয়ের সুবাদে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (সেরা অভিনেতা) জিতেছিলেন রাজ্জাক।

চন্দ্রনাথ
চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত এ ছবি মুক্তি পায় ১৯৮৪ সালে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত। কাশীতে গিয়ে দরিদ্র তরুণী সরযূর (দোয়েল) সঙ্গে পরিচয় হয় তরুণ জমিদার চন্দ্রনাথের (রাজ্জাক)। সরযূকে ভালোবেসে তাঁকে বিয়ে করে গ্রামে নিয়ে আসেন চন্দ্রনাথ। একসময় শোনা যায়, সরযূর মায়ের চরিত্র নিয়ে বদনাম রয়েছে। সমাজের কারণে সরযূকে ত্যাগ করে কাশী পাঠিয়ে দেন চন্দ্রনাথ। নিজেও বাড়ি ছাড়েন। বেশ কয়েক বছর পর অনেক ঘটনার মধ্য দিয়ে আবার তাদের মিলন হয়। সমালোচক মহলে প্রশংসিত এ ছবি চারটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয় করে। সেরা অভিনেতার পুরস্কার জিতেছিলেন রাজ্জাক।

বাবা কেন চাকর। ফাইল ছবি
বাবা কেন চাকর। ফাইল ছবি

বড় ভালো লোক ছিল
ব্যতিক্রমী কাহিনির চলচ্চিত্র ‘বড় ভালো লোক ছিল’। ১৯৮২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত। পরিচালক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন। গ্রামের দরবেশ আনোয়ার হোসেনের ছেলে রাজ্জাক আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। ট্রাক দুর্ঘটনায় বাবার অকালমৃত্যুতে গ্রামে আসেন রাজ্জাক। আধ্যাত্মিক শক্তিকে স্বীকার না করলেও তার মধ্যে সেটির প্রকাশ দেখা যায়। গ্রামের মেয়ে অঞ্জু ঘোষ ভালোবাসে ট্রাকচালক প্রবীর মিত্রকে। অঞ্জুকে দেখে তার প্রতি প্রলুব্ধ হন রাজ্জাক। কিন্তু এ ঘটনার পর তার আধ্যাত্মিক ক্ষমতা চলে যায়। পরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে সুপথে ফিরে আসেন তিনি এবং মানবসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। ছবিটির ‘হায় রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘আমি চক্ষু দিয়া দেখতাছিলাম জগৎ রঙিলা’ গানগুলো লোকের মুখে মুখে ফেরে। ছবিটি ছয়টি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জয় করে।

কি যে করি
১৯৭৬ সালে মুক্তি পায় ‘কি যে করি’। রাজ্জাক-ববিতা জুটি অভিনীত ছবিটির পরিচালক ছিলেন জহিরুল হক। অত্যাচারী বাবার হাতে মাকে জীবন দিতে দেখে শৈশব থেকেই পুরুষকে ঘৃণা করেন ববিতা। কিন্তু তাঁর দাদার উইল অনুসারে সম্পত্তি পেতে হলে বিয়ে করতে হবে। অগত্যা ফাঁসির আসামি রাজ্জাককে বিয়ে করেন ববিতা। ঘটনাক্রমে আদালতে খালাস পান রাজ্জাক। পরে রাজ্জাককে গ্রহণ করেন ববিতা। এ ছবিতে অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেতার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান রাজ্জাক।

জীবন থেকে নেয়া
১৯৭০ সালে জহির রায়হান নির্মিত রাজনৈতিক ছবি। রাজ্জাক ছিল তৎকালীন পরাধীন দেশের সচেতন পুরুষ। পরিবারে বোন রওশন জামিলের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে মানসিক প্রতিবাদ জানায় বিভিন্নভাবে। রাজ্জাক প্রেম ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে উদীয়মান চরিত্রে অভিনয় করেন। একদিকে জাতীয় সংগীতে যেমন শামিল হন, সুচন্দার সঙ্গে প্রেম এবং পরিবারে চাবির গোছা ধারণ করা বোনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ইমেজে বহুমুখী হয়ে ওঠেন।

বাদী থেকে বেগম
১৯৭৫ সালে পরিচালক মহসিন নির্মিত ছবি। রাজ্জাক তাঁর একাধিক সাক্ষাৎকারে এ ছবির কথা উল্লেখ করেছেন বিশেষভাবে। সামন্ততান্ত্রিক সমাজে একজন বাদীর দাসপ্রথার বিপরীতে বেগম বা নিচু থেকে উঁচু মহলে আসার একটি নমুনা দেখানো হয়েছে। ছবিটি ছিল সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা।

ময়নামতি
কাজী জহির পরিচালিত রাজ্জাক-কবরী জুটির অন্যতম সেরা ছবি। ‘অনেক সাধের ময়না আমার’ গানটি এ ছবির মধ্য দিয়ে জনপ্রিয়তা পায়। একজন ব্যর্থ প্রেমিকের গল্পে ছবিটি নির্মিত হয়েছে। প্রেমের ছবির মধ্যে দেশের অন্যতম সেরা ছবি।

বাবা কেন চাকর
১৯৯৭ সালে রাজ্জাক পরিচালিত জীবনমুখী ছবি। ছবিটি টলিউডে রিমেক হয়েছিল বাংলাদেশে সফল হওয়ার পর। একজন বাবার শেষ বয়সের সাংসারিক বাস্তবতা ছবিটিতে দেখানো হয়েছে। বড় ছেলে, বড় বউ, তাদের তাচ্ছিল্য, ছোট ছেলের দায়িত্বশীলতা, স্ত্রীর মৃত্যু এভাবে বাস্তবসম্মত দিকগুলো ছবিতে স্থান পেয়েছে। খালিদ হাসান মিলুর গাওয়া ‘আমার মতো এত সুখী নয়তো কারও জীবন’—এ গানটি রাজ্জাকের ক্যারিয়ারে অন্যতম সেরা গান।