মাহফুজ যদি আমাকে ফোন করে
>দশবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত গুণী চিত্রগ্রাহক মাহফুজুর রহমান খান ৬ ডিসেম্বর মারা যান। তাঁর মৃত্যুতে শোক নেমে আসে চলচ্চিত্রাঙ্গনে। এই গুণী চিত্রগ্রাহকের দীর্ঘদিনের বন্ধু চিত্রনায়িকা ও নির্মাতা কবরী। প্রয়াত মাহফুজুর রহমান খানকে স্মরণ করেছেন এই লেখার মধ্য দিয়ে—
আমার বন্ধু মাহফুজ। দশবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত চিত্রগ্রাহক, দীর্ঘদিনের চলচ্চিত্রের কর্মসঙ্গী, হাসি–খুশি ও কর্মঠ। সময় নিয়ে তার সঙ্গে গল্প করা ছিল আনন্দের। কাজের সময় ভারি সিরিয়াস। স্বপ্নের মধ্যেও সে কাজ খুঁজতে চাইত। একটি কথা প্রায়ই বলত, ‘দিদি, আমার একটা কাজ এখনো অসম্পূর্ণ। বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধু কেমন করে দেখতে চাইতেন—এই প্রেক্ষাপটে আধুনিক একটি চলচ্চিত্র বানাতে চাই।’
রোজ সকালে তার সঙ্গে আমার নাশতার টেবিলে গল্প হতো। রাজনীতি থেকে শুরু হতো, অবশ্যই সিনেমা তো এক পর্বে থাকবেই। হলিউড থেকে শুরু হয়ে এফডিসি পর্যন্ত। জ্যেষ্ঠ চিত্রগ্রাহক আবদুল লতিফ বাচ্চু ছিলেন মাহফুজের ওস্তাদ। বাচ্চু ভাই মাহফুজকে ‘চেলু’ বলে ডাকতেন। অবশ্য অচেনা কারও সামনে ভদ্রতার খাতিরে আসল নাম ধরেই ডাকতেন। আমার খুব মজা লাগত চেলু ডাকটি, (চেলু হচ্ছে চেলা, মানে ছাত্র) মাহফুজও হি হি করে হাসত। গ্ল্যামার ফটোগ্রাফার হিসেবে বাচ্চু ভাই খুবই দক্ষ। মাহফুজ তাঁর কাছ থেকে এই কাজটি খুব ভালো করে দীক্ষা নিয়েছিল। একাল–সেকাল সব নায়িকার প্রিয় এই দুজন। মাহফুজ বাচ্চু ভাইকে ডাকত ‘ওস্তাদ’ বলে। কী যে ঢং ছিল ওদের! ঢং বলে কথা? মায়া, আদর, স্নেহ, ভালোবাসা—সব মিলিয়ে ছিল শ্রদ্ধা। আমিও ছিলাম ছোটখাটো এক চামচিকা! ওদের সঙ্গে তো বন্ধুত্ব ছিলই, উপরি ছিল আমার সিনেমায় যেন লাইটিং সুন্দর করে, আমাকে যেন আরও সুন্দরী দেখায়। তখন চলচ্চিত্রে ছিল প্রচণ্ড এক প্রতিযোগিতা। কার চেয়ে কে ভালো করতে পারে। কার চেয়ে কাকে গ্ল্যামারাস লাগবে। অবশ্যই ক্যামেরা হলো এসবের প্রধান উপপাদ্য। লাইটিং, মেকআপ, গেটআপ—সবকিছু মিলে ক্যামেরাম্যান হলো আসল জাদুকর।
একবার আমি, মাহফুজ, আলমগীর (অভিনেতা) কুমিল্লায় আমার জন্মভূমি ছবির শুটিং করতে গেলাম। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট তখনো বিধ্বস্ত। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসাবশেষের চিহ্ন তখনো দেখা গেল—দরজার ছিটকিনি নেই, কোনোটার পাল্লা নেই, দেয়ালে শুকনো রক্তের দাগ...কী ভয়াবহ! মাহফুজ, আমি, আমরা সবাই রীতিমতো আতঙ্কিত। একই ছবিতে আমরা অভিনয় করছি। একটা সময় কাজের চাপে আমরা তিনজন কখন যে ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলাম? এখন বুঝি, তা না হলে কাজই করতে পারতাম না। বেলা শেষে একটা রিকশা নিয়ে তিনজন ঘুরে বেড়াতাম। আমি ও আলমগীর বসতাম রিকশার সিটে, মাহফুজ রিকশা চালাত। আবার আমার সঙ্গে বসত মাহফুজ, আলমগীর চালাত। মনে হতো, তিনজনই আমরা খেলার সাথি। রাতে শুটিং থাকলে একসঙ্গে খাওয়া, মজা করা—কত কি? পরিচালক আলমগীর কুমকুমও আমাদের দলে ভিড়ে যেতেন। শুটিংয়ের ফাঁকে লুডু খেলা, দুষ্টুমি, হইচই—এলাহি কারবার। ‘আজ শুটিং বাদ। আমিও খেলব’ বলে কুমকুম আমাদের সঙ্গে বসে যেত। সাপ–লুডুতে ফাঁকি দেওয়া খুব সহজ। গুটি একটা সাপের ঘর থেকে পেটে পোঁছাতে গেলেই একটানে লেজ পর্যন্ত চুরি করা যায়। তখনই শুরু হয় ঝগড়া। আমি যখন দেখি হারব, একটানে লুডু ফেলে দিয়ে দৌড়। মাহফুজরা আমাকে ধরতে ধাওয়া করে, কত যে মজা করেছি। ছোটবেলায় নিজ বাড়িতে যা করতে পারিনি, এই বয়সে এসে ছেলেমানুষের মতো আনন্দ করেছি। মানুষের বয়স বাড়ে, কিন্তু মনের বয়স তো বাড়ে না।
কত দিন মাহফুজের সঙ্গে কাজ করি না। তাই বলে কি সব ভুলে গেছি? সেই ‘নুরু, পুশি, আয়েশা, শফি সবাই এসেছে।/ আমবাগিচার তলায় যেন আমরা হেসেছে’। আর এখন কোথায় যেন সব হারিয়ে যাচ্ছে। হাসতে ভুলে যাচ্ছি, হাতড়ে ফিরছি। এফডিসিতে কেউ নেই, কেন জানি না। রেডি, লাইট, অ্যাকশন, এই চুপ, শট হচ্ছে, ১ নম্বর ফ্লোর থেকে ২ নম্বর, এরপর ৪, ৫, প্যাচ ওয়ার্ক, মহাব্যস্ত এফডিসি...এখন এমন কেন? মিনাপাল থেকে কবরী হয়ে ওঠার পেছনে যাদের অবদান, সেই কোটি মানুষের জন্য আমরা আবার আলোঝলমলে এফডিসিকে জাগিয়ে তুলতে পারি না? কত ছবি তৈরি হতো। বছরে ৭০-৮০টি ছবি হতো, ভালো ছবি। অথচ আজ কোনো ছবি হয় না। একেক করে এই শিল্পমাধ্যমটি হারিয়ে যাচ্ছে। আমি খুঁজে বেড়াই আমার সাথিদের। ফিরে যাই আমার কাজের জায়গা এফডিসিতে। হঠাৎ লোকজনের ভিড় দেখে এগিয়ে গেলাম। হায় হায়! আমার প্রাণের বন্ধু মাহফুজ কাফনের কাপড় পরে শুয়ে আছে? ও কি অভিমান করেছে? আমার ভেতরে একধরনের প্রচণ্ড কষ্ট কাজ করে, এটা তো কোনো শুটিংয়ের দৃশ্য নয়? মাহফুজ সত্যি কাফনের ভেতরে লুকিয়ে আছে? ও যদি আমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে চায়? আমি যাব না। কিছুতেই যাব না। কখনো সখনো হলেও এফডিসিতে আসব। জোরে জোরে হাঁটতে থাকি, মাহফুজ যদি আমাকে ফোন করে! কারণ, মোবাইলটা গাড়িতে ফেলে এসছি। আমার বন্ধু মাহফুজ আমাকে ফোন করবে।