ভুল ইতিহাস প্রজন্মকে ধ্বংস করে
এখনকার তরুণ-তরুণীরা ইতিহাস পড়ে না। যেভাবে তারা গল্প-উপন্যাস পড়ে, সেভাবে যদি অন্তত ইতিহাসনির্ভর গল্প-উপন্যাস পড়ত, তাতেও তারা উপকৃত হতো। হুমায়ূন আহমেদ তাঁর নাটকে তোতাপাখির মুখে প্রতিবাদের সংলাপ ‘তুই রাজাকার’ তুলে দিয়েছিলেন। সাহিত্যে এভাবে ইতিহাসের নানা অনুষঙ্গ তুলে রাখা থাকে। তবে ভুল ইতিহাস একটা প্রজন্মকে ধ্বংস করে দেয়। ইতিহাসভিত্তিক সাহিত্য চর্চা: ‘লেখক-পাঠক সংলাপ’ নামের এক আড্ডায় এ কথাগুলো উঠে আসে।
গত শুক্রবার ঢাকার বিশ্ব সাহিত্যকেন্দ্র ভবনের বই বিপণি বাতিঘর মিলনায়তনে আয়োজন করা হয় আলোচনা অনুষ্ঠান ‘লেখক-পাঠক সংলাপ’। প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বিশেষ অতিথি কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক মোস্তফা কামাল। উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন বয়সের লেখক-পাঠক ও সংস্কৃতিকর্মী। আড্ডায় দুই বিশিষ্টজন শোনালেন ইতিহাসভিত্তিক সাহিত্যচর্চার কথা, ইতিহাসের আশ্রয়ে সাহিত্য রচনার গুরুত্ব। পাশাপাশি ছিল প্রশ্নোত্তর পর্ব। তাঁরা বলেন, ইতিহাস ও সাহিত্য আলাদা হলেও তাদের মধ্যে গভীর সম্পর্ক আছে। ইতিহাসের ঘটনা লিপিবদ্ধ করেন ঐতিহাসিক। আর সাহিত্যিক ইতিহাস ও সময়ের বাঁকে বাঁকে আলো ফেলে তাকে জীবন্ত করেন।
আবদুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, ‘কবিতা লিখতে চেয়েছিলাম। বহু চেষ্টা করেও জীবনে একটা কবিতাও লিখতে পারিনি। একসময় বুঝলাম আমার কাজ আসলে গবেষণা করা। বেশ কিছু মননশীল প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছি। দীর্ঘ সময় ভয়ংকর ব্যস্ত জীবন পার করেছি। তার মধ্যে যে প্রবন্ধগুলো লিখেছি, সেটাও কম নয়। প্রতিটি লেখাই অনেক কষ্ট ও গবেষণার ফসল। ইতিহাসের আলোয় লেখা আমার প্রবন্ধ-নিবন্ধগুলো গুরুত্ব পাবে আশা করি।’
মুহিত বলেন, ‘আমি লেখালেখি শুরু করি যখন আমার বয়স ১০ বছর। দৈনিক যুগভেরী পত্রিকার সম্পাদক আমাকে পত্রিকাটির অর্ধেক দিয়ে দেন লেখালেখির জন্য। আমি তখন পত্রিকাটির কিশোর মজলিশ পাতায় লিখতাম। অর্ধেক পত্রিকায় লেখার জন্য কার কাছে যাব, কী করব? নিজেই ভিন্ন ভিন্ন নামে নানা কিছু লিখতাম। শুধু কবিতা লিখতে পারতাম না।’
বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক, দৈনিক কালের কণ্ঠের নির্বাহী সম্পাদক মোস্তফা কামাল বলেন, ‘১৯৯১ সাল থেকে আমি নিয়মিত লিখি। কেননা, লেখালেখি আমার কাছে প্রার্থনার মতো। আমি সব সময় চেয়েছি, দীর্ঘ ক্যানভাসে উপন্যাস লিখব। আমার অধিকাংশ বই ইতিহাসভিত্তিক ও মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্প-উপন্যাস। ইতিহাসের বই থেকে ইতিহাস জানা যায়। তবে তরুণ প্রজন্মের কাছে এটা কাঠখোট্টা বিষয় মনে হতে পারে। আমি মনে করি, ইতিহাস যদি স্ট্রাকচার হয়, আর তাতে যদি রক্ত-মাংস, জীবন দেওয়া যায়, তাহলে এটি কথা বলতে পারে। ইতিহাসবিদ ইতিহাস রচনা করেন, কিন্তু একজন সাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক ইতিহাসকে প্রাণ দেন। তখন ইতিহাস কথা বলে, হাঁটতে শেখে। ইতিহাস তখন সত্যের জায়গায় চলে যায়।’
লেখক-পাঠক এই আড্ডার আয়োজন করে ঢাকা ইনিশিয়েটিভ, সহযোগিতা করে অয়ন প্রকাশন। ঢাকা ইনিশিয়েটিভের সমন্বয়ক, সাংবাদিক পার্থ সারথি দাস বলেন, ‘সামনের পথে এগিয়ে যেতে অতীতের কাছ থেকে উত্সাহ দরকার। দীর্ঘ আপসহীন লড়াইয়ের ইতিহাস আছে বাঙালির। কিন্তু আমরা আমাদের ইতিহাসভিত্তিক সাহিত্য রচনায় ফেলে আসা আন্দোলন, বীর যোদ্ধা কিংবা দেশনায়ক কিংবা উন্মাতাল দিনগুলো পাঠকের কাছে উপস্থাপন করতে কতটা সফল হয়েছি? এমন প্রশ্ন রেখেই ইতিহাসভিত্তিক সাহিত্যচর্চা বিষয়ে লেখক-পাঠক সংলাপ আয়োজন করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এ বিষয়ে আরও কাজ করবে ঢাকা-ইনিশিয়েটিভ।’
লেখক-পাঠক সংলাপে আরও অংশ নেন সাহিত্যিক ও অধ্যাপক হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও ঔপন্যাসিক ইসমাইল হোসেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কলামিস্ট মিল্টন বিশ্বাস, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও লেখক মামুন উর রশিদ, সাংবাদিক মুস্তফা মনোয়ার, বাতিঘরের কর্ণধার দীপঙ্কার দাশ, প্রকাশক মিঠু কবীর প্রমুখ।