বোকারা যেমন দুঃসাহস দেখায় চাকরি ছেড়ে, আমিও তা-ই করলাম - শ্রীকান্ত আচার্য
শ্রীকান্ত আচার্য, ওপার বাংলার জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী। ছিলেন পুরোদস্তুর চাকরিজীবী। সেখান থেকে পেশাদার কণ্ঠশিল্পী হিসেবে কাজ শুরু। শুরুতেই সাফল্য তাঁকে আর পিছপা হতে দেয়নি। এখন গান নিয়ে ব্যস্ত। নব্বইয়ের দশকে পেশাগতভাবে সংগীতে ক্যারিয়ার শুরু করা এই শিল্পী ইতিমধ্যে অসংখ্য জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন। ধরে রেখেছেন সমান জনপ্রিয়তা। বাংলাদেশের মানুষের কাছেও শ্রীকান্ত জনপ্রিয়। সম্প্রতি দেশ টিভির আমন্ত্রণে ‘কলের গান’ অনুষ্ঠানে গান গাইতে ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। দুই দিনের সফরে তিনি উঠেছিলেন ঢাকা ক্লাবের অতিথিশালায়। সেখানেই প্রথম আলোর সঙ্গে কথা হয় শ্রীকান্তের। আলাপচারিতার কিছু অংশ প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য তুলে ধরেছেন মনজুর কাদের।
বাংলাদেশে আপনি এর আগেও অনেকবার এসেছেন।এবার এসে কেমন লাগছে?
বাংলাদেশকে আমার নিজের দেশই মনে করি। মায়ের বাড়ি বিক্রমপুরে। তাই বাংলাদেশের প্রতি অন্যরকম একটা টান ছোটবেলা থেকেই রয়েছে। প্রতিবারের মতো এবার এসেও অনেক ভালো লাগছে।
ছিলেন চাকরিজীবী।এখন গান নিয়েই আছেন...
আমার কিন্তু কোনো কিছুই পরিকল্পনা করে করা হয়নি। একটা সময় চাকরি করতাম। কাজটি করতে গিয়ে মনে হচ্ছিল গান থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। আসলে চাকরির ধরনটাই ওই রকম। কলকাতার ছেলে হলেও আমাকে বেশির ভাগ সময় শহরের বাইরে থাকতে হতো। এ কাজটি করতে গিয়ে আমার একটা সময় মনে হলো, যে কাজটি করতে আমি সবচেয়ে ভালোবাসি, সেই গানটাই ঠিকমতো করা হচ্ছে না। হঠাত্ করেই ভাবনায় আসার পর একদিন চাকরিটা ছেড়ে দিই। এটার মধ্যে কোনো বাহাদুরি ছিল না কিন্তু। বোকারা যেমন দুঃসাহস দেখায়, আমিও সে রকম করলাম। আমার চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর কয়েক মাসের মধ্যে পরপর এমন কতগুলো ঘটনা ঘটল, যা ঘটবে বলে আমি কোনো দিন প্রত্যাশা করিনি। ক্যাসেট কোম্পানি সাগরিকা আমাকে একসঙ্গে দুটি অ্যালবাম করার প্রস্তাব দিল; যা ছিল আমার কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত। আমিও প্রস্তাবটি লুফে নিলাম। তৈরি হলো ‘মনের জানালা’ এবং ‘হে বন্ধু হে প্রিয়’। ক্যাসেট দুটি যখন রেকর্ডিং হচ্ছে, সেই সময় খবরটা কেউ জানত না, শুধু আমার স্ত্রী ও মা ছাড়া।
তারপর...
আমাদের পরিবার বরাবরই মামার বাড়ি ঘেঁষা। তারা থাকতেন ঢাকার বিক্রমপুরে। আমাদের পুরো পরিবারের আদর্শ ছিলেন মামারা। সবাই লেখাপড়া জানা। সবাই ভালো ভালো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। তাঁরা যদি বিষয়টি আঁচও করতে পারতেন, তাহলে হয়তো আমার গান করা হতো না। যা-ই হোক, পূজার সময় অ্যালবামটি প্রকাশের পর প্রচুর জনপ্রিয়তা পেল। আমি মনে করেছি পূজা শেষ হলেই হয়তো হইচই থেমে যাবে। কিন্তু তার পরও ক্যাসেট বিক্রি বেড়ে গেল। আমার আনন্দ হওয়ার পাশাপাশি টেনশনও হতে লাগল।
কিন্তু কেন?
১৯৯৬ সালের কথা। তখনো ভাবিনি যে গানবাজনাই পেশা হবে। ভেবেছিলাম ব্যবসা করব। পুঁজি আমার ছিল না এক পয়সাও। তবুও সাহস করে বন্ধুদের সঙ্গে পরিকল্পনা করেছি গার্মেন্টসের ব্যবসার। সেটা কেন করেছিলাম এখন বলতে পারব না। বিষয়টা এখন মাথায় এলেই হাসি পায়। যা-ই হোক, অ্যালবাম দুটির জনপ্রিয়তার কারণে লোকজন আমাকে চিনতে শুরু করল। এমনকি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গাইতেও ডাক আসতে থাকে। আমি দেখলাম আমাকে ফুলটাইমের জন্য গান করতে হবে। আমি তা-ই করলাম। এখনো চলছে। আজ এখনো আপনাদের জন্য গান গাইতেই ঢাকায় আসা। আমার ভাগ্যে এটাই ছিল। তাই হয়েছে।
গানের ক্ষেত্রে অনেকেই আপনাকে আদর্শ মনে করেন।কিন্তু আপনার আদর্শ কারা?
যাঁদের গান শুনে বড় হয়েছি, তাঁরাই আমার আদর্শ। এখন যাঁরা গান করছেন, তাঁদের গান শুনেও প্রতিদিনই কিছু না কিছু শিখি। একজন শিল্পীর মধ্যে আমি কখনো আটকে থাকিনি। সবাই কোনো না-কোনোভাবে আমাকে প্রভাবিত করেছেন। ছোটবেলা থেকেই বলিউডের সিনেমার গান খুব শুনতাম। ওখানকার শিল্পীদের মধ্যে কিশোর কুমার, মোহাম্মদ রফি, লতা মুঙ্গেশকর, আশা ভোঁশলে। আছেন শ্যামল মিত্র। গজলও আমার ভীষণ পছন্দের। এ ক্ষেত্রে মেহেদী হাসান ও জগজিত্ সিংয়ের ভক্ত আমি। অজয় চক্রবর্তীকেও ভালো লাগে। এই সময়ে কবির সুমন আমার প্রিয়। হরিহরণজিকেও ভালো লাগে।
সমকালীন আধুনিক বাংলা গান ও কবির সুমন...
সমকালীন আধুনিক বাংলা গানের কথা বলতে গেলে সুমনের কথা আসবেই। সুমনের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৮৯-৯০ সালে। আমার বন্ধুদের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। ওই সময়েই সুমনদার একক অ্যালবাম ‘তোমাকে চাই’ প্রকাশিত হয়। অ্যালবামটি প্রকাশের পরে তিনি বাংলা গানের জগতে বোমার মতো ফেটে পড়লেন। তিনি সেই সব বিরল মানুষের মধ্যে একজন, যিনি প্রায় একা একটা প্রজন্মকে সমকালীন বাংলা গানের দিকে ফিরিয়ে এনেছেন। এই সময়ে দাঁড়িয়ে সুমনদার পরে আমি নচিকেতার কথা বলতে পারি। সুমনদার শক্তিটা ছিল ক্যারিশমেটিক। তাঁর অ্যালবাম, স্টেজ শো—এসবের কারণেই বাংলা গান ঘুরে দাঁড়িয়েছে। লোপা, রূপঙ্কর আমরা তাঁকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়েই গান করছি।
‘কাঁটাতার’ও আপনার ভাবনা...
আমার মা এ দেশের। বিক্রমপুরে তাঁর বাড়ি। দেশভাগের আগে মামারা চলে যান বিক্রমপুর থেকে। আমার মায়ের কাছে বিক্রমপুরের অনেক গল্পই শুনেছি। এখনো মা আমাকে সেসব গল্প শোনান। আমার মায়ের মতো অনেকের শেকড় এখানে। সেই টানটা কিন্তু তাঁদের থেকেই গেছে। তাঁদের আবেগটা আমিও অনুভব করেছি। আমার মনে হয়, আমার কোনো গান যদি তাঁদের দুঃখবোধের সঙ্গে মিলে যায় বা তাঁদের যদি কিছুটা স্বস্তি দিতে পারে, তাহলে আমি শিল্পী হিসেবে সার্থক। এটা আমি সত্যি অনুভব করি।
‘আমার সারাটা দিন মেঘলা আকাশ বৃষ্টি তোমাকে দিলাম’...
এ গানটির কথা লিখেছেন লীলাময় পাত্র। সুর করেছেন জয় সরকার। জয় এখন কলকাতার সংগীতে একটি বিশিষ্ট নাম। ১৯৯৯-২০০০ সালের কথা। লীলাময় পাত্র আমাকে ও জয়কে আলাদা আলাদা খাতায় গানের কথা লিখে দিয়ে যেত। একপর্যায়ে ‘শ্রাবণ সন্ধ্যা’ গানটির দুটি লাইনের সুর করে জয় আমাকে শোনায়। কিন্তু দুই লাইনের পর প্রায় আট-নয় মাস পার হয়ে গেলেও গানটি শেষ করছিল না জয় সরকার। একদিন আমার বাসায় এলে আমি জয়কে বলি, তোমার এখন তাত্ক্ষণিক সুর করতে হবে গানটিতে। এরপর সে আমার সামনেই এর সুর করে। তার দুই মাসের মধ্যেই গানটির রেকর্ডিং হয়। ২০০০ সালে ‘বৃষ্টি তোমাকে দিলাম’ অ্যালবামের শীর্ষ সংগীত হিসেবে এটি প্রকাশ করি। এরপর গানটি দুই বাংলাতেই দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। তবে এই গীতিকারের লেখা আর কোনো গীতিকবিতা থেকে আমরা গান করতে পারিনি।
আগেকার দিনের গানগুলোর স্থায়িত্ব অনেক।কিন্তু ইদানীংকালের গানগুলো কোথাও গিয়ে একই রকম হয়ে যাচ্ছে...
আমার উপলব্ধিটাও একই রকম। আমরা যেন গানের জন্য একটা গণ্ডির মধ্যে আটকে আছি। আমরা অনেকটা হোমোজেনাইজড ফর্মে চলে যাচ্ছি। এই পরিস্থিতি যে শুধু বাংলা গানের ক্ষেত্রে, তা কিন্তু নয়। হিন্দি গানের ক্ষেত্রেও হচ্ছে। অন্য ভাষার গানগুলোরও একই দশা। গানের ক্ষেত্রে এখন আর শিল্পীর গুরুত্ব পাচ্ছে না। গায়কিটাই প্রধান হয়ে গেছে। কম্পোজিশনের ক্ষেত্রে সবাই ভাবছে একটু অ্যাংলোসাইজড হলেই বুঝি সেটা ভালো শোনাবে। অবশ্যই পাশ্চাত্যের প্রেরণা থাকতেই পারে। এটা নজরুলের ভেতরে যেমন ছিল, রবীন্দ্রনাথও নিয়েছেন। তাঁদের বিশালতা হলো তাঁরা সেটাকে নতুন করে গড়েছেন।
আপনাদের ওখানকার শিল্পীরা হরহামেশাই বাংলাদেশে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান করছেন।কিন্তু বাংলাদেশের শিল্পীদের উপস্থিতি আপনাদের ওখানকার অনুষ্ঠানে খুব একটা চোখে পড়ে না।গান নিয়ে দুই বাংলা মিলিয়ে একসঙ্গে কাজের কোনো পরিকল্পনা আছে?
দেখুন, সিনেমা খুবই গোছানো জায়গা। কিন্তু গানবাজনার ক্ষেত্রে তা সম্ভব নয়। গানের ক্ষেত্রে ব্যক্তি পর্যায়ে কাজ হয়। এটাকে সমন্বয়ের মধ্যে আনাটা খুবই কঠিন। তবে আমি বলব, আমরা যেমন মাঝেমধ্যে এখানে গান করতে আসি, এখানকার শিল্পীদেরও ওখানে গিয়ে গান করা উচিত। একসময় ফিডব্যাক কিন্তু কলকাতা মাতিয়েছিল। গানটা যদি বিনিময় করা যায়, তবে বাংলা গানের ক্ষেত্রে খুবই ভালো। আমি চাই যেভাবে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ওখানে গান করতে যাচ্ছেন, সেভাবে আনুশেহ, বাপ্পা মজুমদার, অর্ণবসহ আরও অনেকেই যাবেন গান করতে। এঁদের ওখানে গিয়ে অনেক বেশি লাইভ অনুষ্ঠানে গান করা উচিত। যতক্ষণ না লাইভ শো হবে, যতক্ষণ না কয়েক হাজার দর্শক হই-হুল্লোড় করে গান না শুনবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশি শিল্পীদের প্রতিভার প্রতিফলন সেখানকার দর্শকদের কাছে আসবে না।
শিল্পী হিসেবে আপনারা কি এ বিষয়ে উদ্যোগী হয়েছেন কখনো?
আমি আশাবাদী। ব্যক্তিগতভাবে অনেককে বিষয়টি বলতেও পারি। কিন্তু আয়োজন করা তো সম্ভব নয়। আমরা যদি অপেক্ষা করি, তবে ইতিবাচক কিছু দেখতে পাব।
ইদীনং গীতিকারের সংখ্যা কমে যাচ্ছে, এটা কেন?
আগে গীতিকবিরা গান লিখতেন সিনেমার জন্য, শিল্পীর জন্য, নিজেরাও লিখে তা অন্যদের দিয়ে গাইয়ে নিতেন। দিনদিন এই সুযোগ কমে এসেছে। এখন গীতিকারদের কেউ মূল্য দিতে চায় না। সুরকার হয়তো গান করে ১০০ টাকা পান। কিন্তু গীতিকারকে কুড়ি দিতে চায় না। এতে সম্মান ও সম্মানী দুটিই কমে গেছে। ভালো গীতিকবিতার সংকটের কারণ এসবই।
বাংলা গান কোথায় বেশি জনপ্রিয় বলে মনে করেন? ওপার, না এপার বাংলায়?
দুই বাংলাতেই বাংলা গান কিন্তু জনপ্রিয়। তবে একটি কথা বলব, বাংলা গান সত্যিকার অর্থে আবেগ দিয়ে শোনেন বাংলাদেশিরা। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
আপনি আধুনিক ছাড়াও রবীন্দ্রসংগীত করে থাকেন।এর বাইরে নজরুলগীতি কিংবা লালনের গান নিয়ে আপনার ভাবনাটা কী রকম?
আমি আসলে মূলত ন্যাচারালি গান করার চেষ্টা করি। ছোটবেলায় ১০ বছরের মতো গান শিখেছি। কিন্তু তা খুব পর্যাপ্ত ছিল বলব না। তবে সব সময় সব ভাষার সব ধরনের গান শোনার চেষ্টা করতাম, এখনো করি। বলতে গেলে শুনে শুনেও আমি অনেক কিছু শিখি। নজরুলগীতি এবং লালনের গানও মনেপ্রাণে অনেক পছন্দ করি। তবে পেশাগতভাবে করা হয়নি। সামনে পরিকল্পনা রয়েছে, দেখি কী হয়।