বিমূর্ত যবে মূর্তমান
মহাকবি কালিদাস। এক বিমূর্ত কবির নাম। কালিদাস নামটি উচ্চারিত হলে আমার চোখের সামনে কেবল উড়ন্ত কালো কালো মেঘ ভেসে যায়। তাই কালিদাসকে আমার মনুষ্যরূপে ভাবা হয়নি কখনো। তিনি এই ভবলোকে জীবিত ছিলেন, বিচরণ করতেন, প্রেম করতেন প্রত্যক্ষ ভাবনায় আসেনি কখনো। তবে বিরহ শব্দটার একটা প্রতিরূপ হিসেবে কবি কালিদাস ভাবনায় আসে নিরন্তর। কালিদাস সম্পর্কে সে রকম বিস্তারিত জানাও যায় না কোনো পুঁথিপুস্তক ঘেঁটে। কেউ কেউ বলেন তিনি জন্মেছিলেন খ্রিষ্টপূর্ব ১৮৫ সালে, আবার কারও কারও মতে তাঁর সময়কাল খ্রিষ্টীয় চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতকের মধ্যে। বিক্রমাদিত্য নামে পরিচিত গুপ্ত সম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সভাকবি হিসেবেই তাঁর খ্যাতি সমধিক। কালিদাসের বহু রচনায় দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজ্য, রাজধানী উজ্জয়িনী ও রাজসভার উল্লেখ পাওয়া যায়।
নাটক: আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে
রচনা: মোহন রাকেশ
অনুবাদ: অংশুমান ভৌমিক
নির্দেশক: অলোক বসু
দল: থিয়েটার ফ্যাক্টরি
যা-ই হোক, এই লেখার অভিপ্রায় কালিদাসের জন্মবৃত্তান্ত নয়, বরং এই বিরহী যজ্ঞ বিমূর্ত কবির মূর্ত হয়ে মঞ্চে আসার প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলতেই লিখতে বসা। যে নাটকে তিনি মূর্ত হয়েছেন তার নাম আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে। এই নামটি একটি আইকনিক শব্দগুচ্ছ। যে দিবসে কবি কালিদাস ভাসমান মেঘরাশিকে তাঁর দূত বানিয়ে বিরহের কথা জানাতে চেয়েছিলেন তাঁর প্রিয়াকে। তাই এই বাক্যটি প্রয়োগে কোনো নাটকের নামকরণ হলে তা যে কালিদাস প্রসঙ্গেই হবে তা সহজেই অনুমেয়। ঘটলও তাই। প্রায় অজানা জীবনের কবি কালিদাসের জীবন ও প্রেম মূর্ত হলো মঞ্চে। এখানে মেঘদূতের উল্টোপাঠ ঘটে। বিরহী কবি কালিদাসের সমস্ত বিরহ জড়িয়ে থাকে তাঁর প্রেয়সী মল্লিকার অন্তর ঘিরে। মেঘদূত কাব্যের উত্তরমেঘ পর্বের একটি শ্লোক ‘স্বপন-মিলনে যদি কভু প্রিয়ে তোমারে হৃদয়ে ধরিতে যায়/শূন্য আকাশে প্রসারিয়া বাহু বৃথাই কেবল দুঃখ পাই/ হেরি অভাগার গভীর যাতনা দেবতারও আঁখি সজল হয়/ তরু কিশলয়ে অশ্রু মুকুতা ঝরি’ ঝরি’ পড়ে বেদনাময়!’ এই শ্লোকটি কালিদাস নয়, সত্য হয়ে ওঠে মল্লিকার একাকী সময়ে। তখন প্রশ্ন জাগে, যিনি নিজ ইচ্ছায় তাঁর প্রেয়সীকে ভুলিলেন, তিনি কীভাবে বিরহ যাপন করেন। খানিক কপটতার আভাস যেন উঁকি দেয় মনে। তবে কালিদাসকে এই অপবাদ থেকে এই মর্মে নিষ্কৃতি দেওয়া যায় যে মল্লিকার পীড়াপীড়িতেই তিনি উজ্জয়িনীর রাজদরবারে সভাকবি হিসেবে যোগ দিতে যান। কারণ, মল্লিকা চেয়েছিল কালিদাস বড় কবি হিসেবে আবির্ভূত হোন, চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ুক তাঁর নাম। এই নাটকে কালিদাসের প্রতি প্রেম মল্লিকাকে দ্বিখণ্ডিত করে দেয়। এক মল্লিকা কালিদাসকে ভালোবেসে ঘর-সংসার করতে চায়। যেটা তার মা অম্বিকাও চান। আরেক মল্লিকা কালিদাসের কবিপ্রতিভাকে ভালোবেসে তাঁকে দূরে ঠেলে দিতে চায়, যেন কালিদাস কবি হিসেবে সুনাম অর্জন করেন। ফলে কালিদাসের গল্প যেন এক প্রেমের গল্পেরই রূপ নেয়। অন্যদিকে কালিদাস রাজকন্যা প্রিয়ঙ্গমঞ্জুরীকে বিবাহ করে মাত্রগুপ্ত নাম ধারণ করে শাসনকর্তা বনে যান। গল্প সেখানেও হোঁচট খেয়ে বাঁক নেয় অজানা দিকে।
মোহন রাকেশ রচিত হিন্দি ভাষার এই নাটকটা বাংলায় রূপান্তর করেছেন অংশুমান ভৌমিক। অনূদিত হওয়ার পরে একটি নাটক যদি মৌলিক রচনার রূপ, রস, সুবাস ছড়াতে পারে, যদি মনে হয় এই ভাষাতেই নাটকটি প্রথম রচিত হয়েছে তবে সেই অনুবাদকে এক শতে এক শ দিতে হবে। অংশুমানের অনুবাদ সেই উচ্চতায় পৌঁছেছে। সংলাপের মাধুর্য, শব্দের প্রয়োগ, অর্থময় বাক্যবিন্যাস সবকিছুই বাংলা ভাষার অন্তর থেকে আহরণ করেছেন তিনি। আষাঢ়স্য প্রথম দিবসের নির্দেশনা দিয়েছেন অলোক বসু। ঢাকার মঞ্চে তাঁর নির্দেশনায় বেশ কটি নাটক এর আগেও আমরা উপভোগ করেছি। তাঁর নির্দেশনার সবচেয়ে বড় গুণ তিনি নাটকের আবহ, আবেদন ও আহ্বানকে সম্যক অনুধাবন করে এর নির্মাণে হাত দেন। ফলে নাটকটি বিকশিত হয়ে ওঠে তাঁর কাঙ্ক্ষিত বিকাশের মাত্রায়। আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে নির্দেশনার পাশাপাশি নাটকটিতে অলোক বসু বিলোমের চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয়ও করেছেন। মল্লিকারূপী সঞ্জিতা শারমীন প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন তাঁর চরিত্রটির সফল রূপায়ণের জন্য। আমি বলব এ রকম দ্বিধাবিভক্ত চরিত্র চিত্রণ একেবারেই সহজ নয়। নতুন শিল্পী হিসেবে তাঁর এই চেষ্টাকে সফলতা বলে মেনে নিতে হবে। রামিজ রাজুর কথা নতুন করে বলব না। তিনি ঢাকার মঞ্চে এখন সেরা অভিনেতাদের একজন। তবে এই নাটকে তাঁর নিজের অভিনয়ধারায় কালিদাসের অন্তরটাকে মেশাতে পারলে আরও অনবদ্য হতো। মাতুলের ভূমিকায় আর কে এম মোহসেন চুটিয়ে অভিনয় করেছেন। অম্বিকারূপী শামসুন নাহার বা প্রিয়ঙ্গমঞ্জুরী রূপে সুরভী রায় চরিত্রের প্রয়োজন মিটিয়েছেন উত্তমরূপে। ঠান্ডু রায়হানের আলোক পরিকল্পনা নাটকের আবহকে সমুন্নত রেখেছে। নতুন দল ‘থিয়েটার ফ্যাক্টরি’র এই মঞ্চ আয়োজন এ বছরে মঞ্চে আসা নাটকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। দলের সবাইকে, আষাঢ়স্য প্রথম দিবসের সবাইকে অভিনন্দন।
লেখক: নাট্যকার