সেন্ট অব আ ওম্যান ছবিটিতে আল পাচিনো নাচছেন একজন মেয়ের সঙ্গে। বাজছে একটি গান, ‘ডান্স মি টু দ্য এন্ড অব লাভ’। ভরাট কণ্ঠের এক পুরুষ গাইছেন গানটি। গানের কথা ও গায়কিতে আবিষ্ট হয়ে যেতে হলো। খোঁজ পড়ল গায়কের। পাওয়া গেল—লিওনার্দ কোহেন। কিন্তু তাঁর ছবির দিকে তাকিয়ে মনে হলো গুগল ভুল করেছে। কোহেনের ছবি দিতে গিয়ে দিয়েছে আল পাচিনোর ছবি। কিন্তু অবাক হয়ে আবিষ্কার করা গেল কোহেন আর আল পাচিনোর চেহারায় অদ্ভুত মিল। যেন যমজ দুই ভাই।
ওই গানই আমাদের অনেককে কোহেন সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলে। আমরা খুঁজতে থাকি কোহেনকে গানের মধ্যে। আবিষ্কার করি, এ গান যেন অন্য এক জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে আমাদের। ‘হাল্লেলুইয়া’, ‘সো লং ম্যারিয়েন’, ‘টেক দিস ভালজ’—একের পর এক নতুন গান শুনি আর মুগ্ধ হই। একসময় বুঝতে পারি, কোহেনের গান বিভিন্ন দশকে পরিবর্তিত হয়েছে। গলার স্বরেও এসেছে পরিবর্তন।
১৯৩৪ সালে যে ভদ্রলোকের জন্ম কানাডার কুবেকের ওয়েস্ট মাউন্টেন্টে, তিনি শুধু গায়ক ছিলেন না। তাঁকে অনায়াসে কবি, লেখক, গায়ক ও গীতিকার বলা চলে। তাঁর বাবা এসেছিলেন পোল্যান্ড থেকে, মা লিথুয়ানিয়া থেকে আসা অভিবাসী।
কোহেন পড়াশোনা করেছেন ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্প্যানিশ কবি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার সংস্পর্শে এসে ভালোবেসে ফেলেন কবিতা। চুটিয়ে পড়েন উইলিয়াম ইয়েটস, ওয়াল্ট হুইটম্যান আর হেনরি মিলারের কবিতা। তাই তিনি যে কবিতার বই লিখবেন, তাতে কোনো সন্দেহ ছিল না। তাঁর প্রথম কবিতার বই লেট আস কমপেয়ার মিথোলজিস ছাপা হয়েছে ১৯৫৬ সালে, ১৯৬১ সালে বের হলো দ্বিতীয় কবিতার বই দ্য স্পাইস-বক্স অব আর্থ। প্রথম উপন্যাস দ্য ফেভারিট গেম ছাপা হয় ১৯৬৩ সালে। সাহিত্য আলোচনায় তাঁর নাম আসতে থাকে তখন থেকেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে তিনি যান বাবার গ্রিক দ্বীপ হাইড্রায়। ১৯৬৭ সালে চলে আসেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে। সেখানেই দেখা হয় লোকগানের অমর শিল্পী জুডি কলিন্সের সঙ্গে। কোহেনের ‘সুজানে’ গানটি প্রথম পরিবেশন করেন এই জুডি কলিন্সই।
লোকগান দিয়েই তিনি শুরু করেছিলেন সংগীতের ক্যারিয়ার। সত্তরের দশকে তিনিই চলে এলেন পপ গানের জগতে। আশির দশকে কণ্ঠস্বর নেমে এল খাদে, মঞ্চে তিনজন বা তার অধিক মেয়ে সিনথেসাইজারের আবহে তাঁর গানের সঙ্গে ধরলেন সংগত। যাঁরা তাঁর গান শোনেন, তাঁরা ভালো করেই জানেন তাঁর গানে ধর্ম, একাকিত্ব, যৌনতা, মানুষে মানুষে জটিল সম্পর্ক উঠে এসেছে বারবার।
বিভিন্ন লোকসংগীত উৎসবে কোহেন অংশ নিতে থাকেন। সে সময়েই তিনি প্রযোজক জন হ্যামন্ডের সঙ্গে পরিচিত হন। সংস অব লিওনার্দ কোহেন নামে যে অ্যালবামটি বের হয়, তাতে এবার কোহেন নিজেই পরিবেশন করেন ‘সুজােন’ গানটি। অ্যালবামটি সাড়া ফেলে সংগীত মহলে।
১৯৭৭ সালে ডেথ অব আ লেডি’স ম্যান, ১৯৭৯ সালে রিসেন্ট সংস নামে দুটি অ্যালবাম বের হয়। এরপর দীর্ঘ পাঁচ বছর মৌন থাকেন তিনি। ১৯৮৫ সালে ভ্যারিয়াস পজিশনস অ্যালবামটি বের হয়। এই অ্যালবামেই ছিল তাঁর বিখ্যাত গান ‘হাল্লেলুইয়া’, ‘দ্য ল’, ‘ইফ এট বি ইয়োর উইল’ গানগুলো। আই অ্যাম ইয়োর ম্যান অ্যালবামটি বের হওয়ার পর দেখা গেল তাঁর গান গাওয়ার ধরন বদলে গেছে। গান হয়ে উঠেছে বাস্তব জীবন নিয়ে সমালোচনামুখর। এই অ্যালবামের ‘ফার্স্ট উই টেক ম্যানহাটন’, ‘এভরিবডি নোউজ’ গানদুটিও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এরপর বের হয় তাঁর ফিউচার অ্যালবামটি। এ অ্যালবামের তিনটি গান অলিভার স্টোনের একটি চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত হয়। তাঁর বহুখ্যাত গান ‘ডেমোক্রেসি’তে তিনি আমেরিকার প্রতি তাঁর ভালোবাসার কথা যেমন বলেছেন, তেমনই রাজনীতিতে মার্কিনদের অনীহার তীব্র কটাক্ষ করেছেন।
এভাবে বলতে থাকলে এ লেখা শেষ হবে না। শুধু বলে রাখি, ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন লস অ্যাঞ্জেলেসের মাউন্ট বালডি জেন সেন্টারে। সেখানে তিনি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। ২০০১ সালে তিনি মৌনতা ভাঙেন। টেন নিউ সংস অ্যালবামটি বের হয় এরপর। ম্যানেজার কেলি লিঞ্চ এ সময় তাঁর সঙ্গে প্রতারণা করে ৫০ লাখ ডলার হাতিয়ে নেয়। এই ক্ষতিপূরণের জন্য ২০০৮ সাল থেকে ২০১৩ পর্যন্ত তিনি ৩৮৭টি শো করেছেন। ওল্ড আইডিয়াস নামে আরেকটি অ্যালবাম বের হয় ২০১২ সালে। পপুলার প্রবলেমস বের হয় গায়কের আশিতম জন্মদিনে।
২০১৩ সালের শেষ মাসে তিনি একটি গ্র্যান্ড ট্যুর শেষে আর জনসমক্ষে আসেননি। ৮২ বছর বয়সে ৭ নভেম্বর তিনি মারা যান, ১০ নভেম্বর তা ঘোষণা করা হয়।
কোহেনের সব বিখ্যাত গানই ইউটিউবে পাওয়া যায়।