বাংলাদেশ বলতেই রুনা লায়লাকে চিনি: দালের মেহেদি
‘কিং অব ভাংড়া’ নামেও তাঁকে অনেকে চেনেন। নানা ভাষায় গান করেছেন তিনি। বলিউডের সিনেমাতেও রয়েছে তাঁর জনপ্রিয় অনেক গান। কিন্তু নিজের শিকড়ের গান ছেড়ে কখনো বেরিয়ে আসেননি দালের মেহেদি; বরং সুফিগান আর লোকগানকে সময়োপযোগী করার জন্য কোনো কসরত বাকি রাখেননি। নিজের বেশভূষা, গায়কির ধরন—সবকিছুতেই নিজস্বতার ছাপ রেখে দালের মেহেদি উপমহাদেশের গানের ভুবনে হয়ে উঠেছেন পরিচিত নাম।
নামের প্রসঙ্গ আসতেই বলে রাখি। এই শিল্পীর আসল নাম দালের সিং। নামের শেষে তাহলে ‘মেহেদি’ জুড়ল কী করে? এ প্রশ্ন নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাই। তিনি আমার জবাবটা দেন সহজ কথায়। এখন ‘কিং অব ভাংড়া’ হলেও তাঁর গানের চর্চা শুরু হয় গজল দিয়ে। পাকিস্তানের কিংবদন্তি গজলশিল্পী মেহেদি হাসান ছিলেন দালেরের অনুপ্রেরণা। সেই মেহেদি হাসানেরই এক শিষ্য পারভেজ মেহেদির গজল নিয়মিত গাইতেন দালের। একসময় ভারতে দালেরের কণ্ঠে পারভেজ মেহেদির গান জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করল, তখনই দালেরের বড় ভাই তাঁর নাম ‘দালের সিং’-এর বদলে ‘দালের মেহেদি’ রাখতে পরামর্শ দেন।
১৩ নভেম্বর রাতে ঢাকায় নেমেই দালের মেহেদি চলে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের পাশে ‘গুরুদুয়ারা নানকশাহি’তে, শিখধর্মের উপাসনালয়ে। দালের বলেন, ‘এ বছর গুরু নানকশাহির জন্মের ৫৫০ বছর উদ্যাপন করা হচ্ছে, এমন সময়ে আমি ঢাকায় এসেছি। আর এই শহরে গুরু নানকশাহি যেখানে কিছু সময়ের অবস্থান করেছিলেন, সেখানে যাব না, তা কী করে হয়। তাই সবার আগে আমি সেখানে ছুটে গেছি। আমার সঙ্গে আমার স্ত্রী, মেয়ে সবাই ছিল। এমন একটা সময়ে এই শহরে আসতে পেরে, গান করতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে।’
বাংলাদেশে এর আগে ২০০৫ সালেও এসেছিলেন দালের মেহেদি। সেটা একটা ঘরোয়া অনুষ্ঠানে অংশ নিতে। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে দালেরের যোগাযোগ আরও আগে থেকে, সেটাও গানের কারণেই। এই শিল্পী বলেন, ‘দুজন মানুষকে দিয়ে আমি বাংলাদেশকে চিনি। একজন হলেন জেনারেল এম এ জি ওসমানী (মহান মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক)। তাঁর ছবি দেখে আমি মুগ্ধ হই। তাঁর ব্যক্তিত্ব আমাকে আকর্ষণ করে, এরপরই আমি তাঁর ব্যাপারে জানতে শুরু করি। আরেকজন হলেন রুনা লায়লা। তিনি তো বাংলাদেশের কণ্ঠ। বাংলাদেশ বলতেই রুনা লায়লাকে মনে করি। তাঁর গান “মেরা বাবু ছ্যায়েল ছাবিলা”, “দামা দাম মাস্ত ক্যালান্দার”—এসব তো রুনা লায়লাকে ছাড়া ভাবা যায় না। আমি তাঁর ভীষণ ভক্ত।’ বাংলাদেশের আরও কিছু বিষয়ের ভক্ত হয়ে গেছেন দালের। একে একে সব কটির নামই বললেন এ শিল্পী, ‘সাদা ভাত, ডাল, মাছের ঝোল, চিংড়ি মাছ আমার খুব ভালো লেগেছে। ঢাকার বিরিয়ানির সঙ্গে তো আর কোনো জায়গার বিরিয়ানির তুলনা হয় না। আমি তো এখানে এসেই চিকেন বিরিয়ানি খেয়ে মুগ্ধ হয়ে গেছি। অসাধারণ! এত স্বাদের বিরিয়ানি আমি আগে খাইনি।’
দালের মেহেদির সঙ্গে কথা হয় তাঁর লম্বা সংগীতজীবন নিয়ে। এই সংগীতজীবনে অনেক গুণী ব্যক্তির সান্নিধ্য পেয়েছেন তিনি। তাঁদের মধ্যে আলাদা করে দালের বললেন পণ্ডিত রবিশঙ্করের কথা। দালের মেহেদি নিজের তৈরি একটি সুরযন্ত্র আছে, নাম ‘স্বর্ণমন্দির’। আর আছে গানের নিজস্ব একটি ঘরানা, নাম ‘রুবাবি’। রুবাবি গানের ধরন হলো, এই গানে শিল্পী নিজের বুলি দিয়ে কথা বললেন সরাসরি নিজের স্রষ্টার সঙ্গে। আর এই আলাপ চলাকালে যে সুরযন্ত্র দিয়ে সুর তোলা হয়, সেটার নামই হলো স্বর্ণমন্দির। তো এই স্বর্ণমন্দির সুরযন্ত্র উদ্বোধন করেছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। দালেরের মাত্র একটি নিমন্ত্রণেই নাকি এই সেতারসম্রাট ছুটে এসেছিলেন স্বর্ণমন্দির উদ্বোধনে। দালের বলেন, ‘আমার জীবনের অনেক বড় অর্জন ছিল এটা। পণ্ডিত রবিশঙ্কর আমার সংগীতজীবনের অনুপ্রেরণা। তিনি যখন আমার আমন্ত্রণে সাড়া দিলেন, আমি সেটা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।’ শুরুর দিকে গজলচর্চার সময় থেকেই রবিশঙ্করের সুর পথ দেখিয়েছে দালেরকে।
আরও এক সংগীতজ্ঞকে নিজের জীবনের অন্যতম অনুপ্রেরণা বলে আমাদের জানালেন দালের। তিনি হলেন এ আর রাহমান। আমরা জানতে চেয়েছিলাম এ আর রাহমানের সঙ্গে তাঁর কাজ করার অভিজ্ঞতার কথা। দালের বলেন, ‘এ আর রাহমান আর আমার বন্ধুত্ব বেশ পুরোনো। তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা আর ১০ জনের সঙ্গে সম্পর্কের মতো নয়। গাড়ি চালাতে চালাতে ওর সঙ্গে কথা বলে রং দে বাসন্তী ছবির টাইটেল গানটা আমরা ঠিক করি। এরপর স্টুডিওতে গিয়ে মাত্র ২০ মিনিটে এই গানে কণ্ঠ দিই। রাহমান সব সময় আমার বিবেচনা গুরুত্ব দেয়। শিল্পীর মতামত সে গ্রহণ করতে জানে, সম্মান করতে জানে। “রং দে বাসন্তী” গানেও সে আমার নিজস্ব মতামতকে গুরুত্ব দিয়েছে আর আমি যে অংশগুলো ইম্প্রোভাইজ করেছি, সে ওসব নিয়েছে।’
দালের মেহেদির সঙ্গে আমাদের কথা চলতেই থাকে। নানান বিষয় নিয়ে, নানান মেজাজের আলাপ। আর পেছন থেকে আমরা শুনতে থাকি, রান্না হচ্ছে দালেরের পছন্দের বিরিয়ানি আর চিংড়ি মাছ।