বাংলা একাডেমিতে জমজমাট পৌষ মেলা
এমনিতে এবার শীতের ভালোই দাপট। তার ওপর দুই দিন ধরে হিম বাতাসের সঙ্গে বৃষ্টির দারুণ সখ্য। ভরা পৌষের সকালে সূর্যের আলো তখনো ফোটেনি। রাজপথ প্রায় জনশূন্য। দু-একটি যানবাহন মুহূর্তেই কুয়াশায় মিলিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টি-কুয়াশার সমবেত আয়োজনে বাংলা একাডেমির সবুজ মাটি ভিজে একাকার। কোথাও কোথাও পানিও জমেছে। এমন পরিবেশে আজ শনিবার সকালে এখানে শুরু হয়েছে জমজমাট পৌষ মেলা। আজ থেকে সোমবার পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত মেলা চলবে। থাকবে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক পরিবেশনাও।
শীতের জড়তা কাটিয়ে যাঁরা সাতসকালে হাজির হয়েছিলেন, বাংলা একাডেমি চত্বরে আনন্দের উষ্ণতায় সময় কাটিয়েছেন তাঁরা। শিল্পীদের গানে, কবিতার উচ্চারণে, পিঠা-পুলির মন মাতাল করা ঘ্রাণ মনে করিয়ে দিয়েছিল গ্রামের সেই ফেলে আসা দিনগুলোর কথা।
নলেন গুড়ের পায়েস আর বিচিত্র পিঠাপুলির ম-ম গন্ধ পাওয়া যায় বাংলা একাডেমির চত্বরে প্রবেশ করতেই। সকালে যন্ত্রসংগীতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় মেলার কার্যক্রম। মেলার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় সকাল সাড়ে ৮টায়। সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘প্রার্থী’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন রফিকুল ইসলাম। এ সময় আইলা (মাটির সানকির মধ্যে তুষ দিয়ে জ্বালানো আগুন) জ্বালিয়ে উৎসবের উদ্বোধন ঘোষণা করেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। তিনি বলেন, ‘গ্রামীণ আবহে পিঠাপুলি তৈরি ও আয়োজনের উৎসব পৌষ মেলা। নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে কৃষকেরা ঘরে যে ফসল তোলে, পরবর্তী সময়ে তা দিয়ে বিভিন্ন স্বাদ, গন্ধ ও বৈচিত্র্যের পিঠাপুলি তৈরির মধ্য দিয়ে এ মেলা তথা উৎসব উদ্যাপিত হয়। মূলত গ্রামীণ কৃষিনির্ভর জীবনের প্রতিচ্ছবি এ পৌষ মেলা।
সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, নগরায়ণ ও আধুনিকতার নামে কৃত্রিমতা গ্রাস করেছে আমাদের, যার প্রভাব পড়েছে আমাদের বিভিন্ন মেলা ও উৎসবে। কৃত্রিমতা ও বাহুল্য পরিহার করে সবাইকে লোকসংস্কৃতির প্রকৃত উপাদান ও অনুষঙ্গ অনুসরণ ও চর্চার আহ্বান জানান প্রতিমন্ত্রী। তিনি এ সময় ২১ বছর ধরে পৌষ মেলা উদযাপনের মাধ্যমে গ্রামবাংলার চিরায়ত লোকজ সংস্কৃতিকে নগরবাসীর সামনে তুলে ধরার জন্য পৌষ মেলা উদ্যাপন পরিষদকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।
পৌষ মেলা উদযাপন পরিষদের সভাপতি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব গোলাম কুদ্দুছের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে সম্মানিত আলোচক ছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী, গণসংগীত সমন্বয় পরিষদের সভাপতি ফকির আলমগীর, বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আহকাম উল্লাহ ও পৌষ মেলা উদযাপন পরিষদের সহসভাপতি নাট্যজন ঝুনা চৌধুরী। স্বাগত বক্তব্য দেন পৌষ মেলা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বিশ্বজিৎ রায়। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন পরিষদের অনুষ্ঠান সমন্বয়ক মানজার চৌধুরী।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে গোলাম কুদ্দুছ বলেন, ‘হাজার বছরের এ ঐতিহ্যকে তুলে ধরতে আমাদের এর পরিচর্যা করতে হবে। ঋতুভিত্তিক বিভিন্ন আয়োজন ও উৎসব সারা দেশে ছড়িয়ে দিলে সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের সঙ্গে আরও বেশি করে পরিচিত হবে এ প্রজন্ম।’ তিনি বাঙালির প্রকৃত মূল্যবোধ, চেতনা, জীবনবোধ নগরজীবনে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক আয়োজনের মাধ্যমে তুলে ধরতে এমন পৌষ মেলার গুরুত্ব অনেক বেশি বলে মন্তব্য করেন।
গ্রাম এবং শহরের প্রভেদ না করার আহ্বান জানান বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবিবুল্লাহ সিরাজী। তিনি বলেন, ‘আমাদের সন্তানেরা আজ যে পিৎজা, স্যান্ডুইচ, বার্গারের ভিড়ে আমাদের পিঠা-পুলিগুলো ভুলতে বসেছে, এটা আমাদেরই দোষ। আমাদের উচিত তাদের সেগুলোর সঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া।’
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর শুরু হয় সাংস্কৃতিক পর্ব। নজরুল মঞ্চে ‘ঢেঁকি নাচে দাপুর-ধুপুর’ গানের সঙ্গে দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে কত্থক নৃত্য সম্প্রদায়। ফেরদৌসী কাকলি গেয়ে শোনান ‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে, আয় আয় আয়’ গানটি। এ সময় আরও নৃত্য পরিবেশন করে নৃত্যম, স্পন্দন ও নৃত্যজন। দলীয় সংগীত পরিবেশনে ছিল উদীচী, নিবেদন, বহ্নিশিখা এবং সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী। সকালের পর্বে একক সংগীত পরিবেশন করেন বিশ্বজিৎ রায়, আবু বকর সিদ্দিক, শারমিন সাথী ময়না, আবিদা রহমান, নবনীতা জাইদ চৌধুরী প্রমুখ। আবৃত্তি করেন লায়লা আফরোজ এবং মুক্তধারা আবৃত্তি চর্চা কেন্দ্র।
আজ একদিকে চলছিল সাংস্কৃতিক আয়োজন, অন্যদিকে পিঠা ভোজ। বাংলা একাডেমির উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে ছিল দেশীয় পিঠা-পুলির স্টল। এসব স্টলে দেখা মেলে বাংলার ঐতিহ্যবাহী পাটিসাপটা, তালবড়া, বিবিখানা, মুন্ডা, মোরা, ঝিনুক, দুধ চিতই, জামাই পিঠা, বউ পিঠা, ভাপা পিঠা, সিদ্ধ পুলি, পাকন, খেজুর পিঠা, মালপোয়াসহ নানা স্বাদের পিঠা। শীতের জড়তা কাটিয়ে যাঁরা সাতসকালে হাজির হয়েছিলেন বাংলা একাডেমিতে, আনন্দে-উষ্ণতায় সময় কাটিয়েছেন তাঁরা।