প্রামাণ্যচিত্রে বাংলাদেশের প্রথম ডাকটিকিট
১৯৭১ সালের ৮ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে বিশ্ব জনমত তৈরির জন্য আটটি ডাকটিকিট প্রকাশের খবর প্রকাশিত হয়। জানা যায়, তৎকালীন মুজিবনগর সরকারের আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী, যুক্তরাজ্যের সাবেক পোস্টমাস্টার জেনারেল ও লেবার পার্টির এমপি জন স্টোনহাউজ এবং লন্ডনের অধিবাসী প্রখ্যাত ডাকটিকিট নকশাবিদ বিমান মল্লিকের সম্মিলিত উদ্যোগে ১৯৭১ সালের ২৯ জুলাই মুজিবনগর সরকার কলকাতা ও যুক্তরাজ্যের লন্ডন শহর থেকে বাংলাদেশের প্রথম আটটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশ করা হয়। এবার সেই ডাকটিকিট প্রকাশ আর প্রচারের ইতিহাস নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেছেন নাসরিন ইসলাম। নাম ‘স্বাধীনতার ডাক’ বা ‘দ্য পোস্টেজ স্ট্যাম্প ফর ইনডিপেনডেন্টস’। বাংলাদেশ ডাক বিভাগ আর নাসরিন ইসলামের যৌথ উদ্যোগে তৈরি হয়েছে ৪০ মিনিট দৈর্ঘ্যের প্রামাণ্যচিত্রটি।
১২ এপ্রিল আগারগাঁওয়ের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে ‘স্বাধীনতার ডাক’ প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের প্রিভিউ অনুষ্ঠিত হয়। সেই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এ এইচ মাহমুদ আলী, বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ডাক বিভাগের মহাপরিচালক সুধাংশু শেখর ভদ্র ও ফিলাটেলিস্ট অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক এ টি এম আনোয়ারুল কাদীর। সভাপতিত্ব করেন প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ আজাদ রহমান।
নাসরিন ইসলাম জানান, ‘স্বাধীনতার ডাক’ প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের জন্য তিনি এই আটটি ডাকটিকিট প্রকাশের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ডাকটিকিট নকশাবিদ বিমান মল্লিক ও আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সাক্ষাৎকার ধারণ করেন। এখানে বিমান মল্লিক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সময়ের কিছু অজানা অধ্যায়ের কথা উল্লেখ করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ–পূর্ববর্তী পরিস্থিতি বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার জন্য এই আটটি ডাকটিকিটের নকশা ও বিষয় নির্বাচনে তাঁর ভাবনার কথা তুলে ধরেছেন।
আবুল হাসান মাহমুদ আলী ১৯৬৬ সালে পাকিস্তানের কূটনৈতিক সার্ভিসে যোগ দেন। ১৯৬৮ সালের আগস্ট মাসে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পাকিস্তান কনস্যুলেটে ভাইস কনসাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৭১ সালে ২৬ এপ্রিল পাকিস্তান সরাকরের পক্ষ ত্যাগ করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। মুজিবনগর সরকার তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেয়। এরপর মে মাসে মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আটটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশের বিষয়টি তাকে জানানো হয়। এ সময় তাঁকে এই খবরটি বিশ্বব্যাপী প্রচারের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়। তিনি বাংলাদেশের প্রথম আটটি স্মারক ডাকটিকিট প্রকাশের সংবাদ নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার ১৯৭১ সালের ৮ আগস্ট সংখ্যার স্ট্যাম্প সেকশনে প্রকাশ করতে সক্ষম হন। এই প্রামাণ্য চলচ্চিত্রে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি তা তুলে ধরেছেন। এই ডাকটিকিটগুলো নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশের ক্ষেত্রে তাঁকে সহযোগিতা করেছিলেন নিউইয়র্ক টাইমস ও তার জাতিসংঘ প্রতিনিধি ক্যাথলিন টেল্টস, নিউইয়র্ক টাইমসের স্ট্যাম্প বিভাগের সম্পাদক ডেভিড লিডম্যান, নিউইয়র্ক টাইমসের দক্ষিণ এশিয়া প্রতিনিধি সিডনি শনবার্গ প্রমুখ।
‘স্বাধীনতার ডাক’ প্রামাণ্য চলচ্চিত্রের প্রদর্শনীর ব্যাপারে নাসরিন ইসলাম জানান, এরই মধ্যে ঢাকা ডক ল্যাব আয়োজিত ‘সপ্তম আন্তর্জাতিক মুক্তি ও মানবাধিকার প্রামাণ্যচিত্র উৎসব ২০১৯’-এ ২০ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে ‘স্বাধীনতার ডাক’ প্রদর্শিত হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের খানসামা উপজেলা স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন ও ইউনাইটেড খানসামার যৌথ উদ্যোগে ১৯ জুলাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রামাণ্যচিত্রটি প্রদর্শিত হবে। ২৯ জুলাই বাংলাদেশ ডাক বিভাগের আয়োজনে এই প্রামাণ্যচিত্রটি প্রদর্শিত হবে ঢাকা জিপিও মিলনায়তনে। এ উপলক্ষে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ সেদিন এই চলচ্চিত্রবিষয়ক একটি উদ্বোধনী খাম প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে। এ ছাড়া ঢাকার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতার নন্দন আর লন্ডনের নেহরু হলে প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটি প্রদর্শন করা হবে।
নাসরিন ইসলাম জানান, ২০১৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রথম আলোর বিশেষ সংখ্যায় এ এইচ মাহমুদ আলীর ‘বিজয়ের যুদ্ধের দিকে’ শীর্ষক লেখা প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের প্রথম ডাকটিকিট প্রকাশ ও প্রচারের সেই লেখা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি এই প্রামাণ্যচিত্র তৈরির ব্যাপারে আগ্রহী হন। এরপর তা নিয়ে চার বছর গবেষণা করেছেন। তাঁর মতে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের সপক্ষে বিশ্বজনমত তৈরিতে এই আটটি স্মারক ডাকটিকিট যে ভূমিকা রেখেছে, তা ইতিহাসে বিরল। ডাকটিকিটের বৈশ্বিক ইতিহাসে এটি অনন্য ঘটনা।