নায়িকা হারিয়ে গেছেন, হারায়নি গান
চিত্রনায়িকা জবা চৌধুরীকে ভুলে গিয়েছিলেন সবাই। ৩ মে তাঁর মৃত্যুর খবরে সবার স্মৃতিতে তাজা হয়ে উঠলেন সত্তরের দশকের জনপ্রিয় মুখ। ইবনে মিজান পরিচালিত সুপারহিট ছবি জিঘাংসাতে অভিনয় করেছিলেন জবা। এ দেশের দর্শকেরা এর আগে লেডি অ্যাকশন ছবি দেখেননি। সে কারণেই জিঘাংসা (১৯৭৪) ব্যবসাসফল হয়েছিল। জবা সিনেমার ঝলমলে দুনিয়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। বেছে নিয়েছিলেন সাধারণ জীবন। মৃত্যুর আগেই তিনি হারিয়ে গিয়েছিলেন।
তবে জবা বেঁচেছিলেন জিঘাংসার গান ‘পাখির বাসার মতো দুটি চোখ তোমার’-এর ভেতর দিয়ে। এ গানের জন্য তাঁকে মনে রাখা হয়েছিল। খুরশিদ আলম ও রুনা লায়লার গাওয়া গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়। এ গানে ঠোঁট মিলিয়েছিলেন ওয়াসীম ও জবা। গানটির সঙ্গে নাম জড়িয়ে থাকায় জবাকে ভোলা সহজ ছিল না।
‘পাখির বাসার মতো দুটি চোখ’-এর মতো এমন অনেক জনপ্রিয় গান আছে, যার সঙ্গে বিস্মৃত অনেক নায়িকার নাম জড়িত। এই নায়িকাদের কেউ সুপারস্টার হতে পারেননি। কেউ কেউ মাত্র একটি-দুটি ছবিতে অভিনয় করে বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের নাম, যশ, খ্যাতি পেছনে পড়ে রইলেও অভিনীত গান আজও বেজে চলেছে।
গানের জনপ্রিয়তার সূত্রে উচ্চারিত হয় এই নায়িকাদের নাম। তাঁদের ছবি সাড়া জাগাক বা না জাগাক, ছবির গান শ্রোতাপ্রিয়তায় ধন্য। গানের জন্য তাঁরাও দর্শকদের স্মৃতিতে জ্যান্ত। নায়িকার নাম, চেহারা, অভিনীত ছবির কথা ভুললেও গানের কথা ভোলেননি কেউ। এমনই কয়েকজন নায়িকা ও তাঁদের জনপ্রিয় গানের গল্প দিয়ে সাজানো হলো প্রতিবেদন।
পাথরের পৃথিবীতে কাচের হৃদয়
‘পাথরের পৃথিবীতে কাচের হৃদয়’ গানটি শোনেননি, এমন শ্রোতার কথা আমরা শুনিনি। ঢাকা ৮৬ (১৯৮৮) ছবির গানটি গেয়েছেন তপন চৌধুরী ও শাকিলা জাফর। গানটিতে ঠোঁট মেলান বাপ্পারাজ ও রঞ্জিতা। নায়করাজের হাত ধরে রঞ্জিতা চলচ্চিত্রে পা রাখেন। এ জন্য তাঁর নামের ভেতর আছে ‘র’ ও ‘জ’ বর্ণ দুটো। রঞ্জিতা চলচ্চিত্রে খুব নাম কামাতে পারেননি। জ্বীনের বাদশা, মরণের পরে, ক্যারাটি মাষ্টার, কুংফু কন্যার মতো কিছু ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি।
আমার বুকের মধ্যখানে
‘আমার বুকের মধ্যখানে’ গানটি শ্রুতিমধুর গানের জন্য বিখ্যাত নয়নের আলো (১৯৮৪) ছবির। গানটি গেয়েছেন এ্যান্ড্রু কিশোর ও সামিনা চৌধুরী। গানে ঠোঁট মিলিয়ে অমর হয়েছেন জাফর ইকবাল ও কাজরী। নায়ক রাজ্জাকের আবিষ্কার কাজরীর প্রথম ছবি জোকার। এরপর রেশমী চুড়ি, মৌ চোর, সুখ দুঃখের সাথী, রাজা সাহেব, ফুলেশ্বরী, মীমাংসা, ঈদ মোবারক, মহানায়ক ছবিতে অভিনয় করেন কাজরী। নয়নের আলো তাঁর শেষ ছবি। বিয়ের পর রাজধানী ছেড়ে চট্টগ্রামে চলে যেতে হয় তাঁকে, যে কারণে আর অভিনয়ে ফেরা হয়নি তাঁর।
সাগরের তীর থেকে কে যেন মধুর সুরে
‘সাগরের তীর থেকে কে যেন মধুর সুরে’ শাহনাজ রহমতুল্লাহর গাওয়া অন্যতম জনপ্রিয় গান। সমরেশ বসুর উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত, শহিদুল হক খান পরিচালিত ছুটির ফাঁদে (১৯৯০) ছবির গান এটি। এ গানে ঠোঁট মিলিয়েছেন ভারতের অভিনেত্রী ঝুমুর গাঙ্গুলি। তিনি বাংলা ও হিন্দি ছবিতে অভিনয় করতেন। বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী কিশোর কুমারের ভাইয়ের মেয়ে ঝুমুর। ছুটির ফাঁদে ছাড়া বাংলাদেশের আর কোনো ছবিতে তিনি অভিনয় করেননি। এতে তাঁর নায়ক ছিলেন উজ্জ্বল। অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে ছিলেন গোলাম মুস্তাফা।
ডাকে পাখি খোলো আঁখি
‘ডাকে পাখি খোলো আঁখি দেখো সোনালি আকাশ’ আশির দশকের জনপ্রিয় গানগুলোর একটি। হৈমন্তী শুক্লার গাওয়া গানটিতে ঠোঁট মিলিয়েছেন আল্পনা গোস্বামী। এ গানের ছবি প্রতিরোধ-এ (১৯৮৭) তিনি অভিনয় করেন জাফর ইকবালের বিপরীতে। আল্পনা আশির দশকের টালিগঞ্জে ঝড় তোলেন। তিনি অভিনয় করেছেন বিদ্রোহী, রাশিফল, বৈদূর্য রহস্য ইত্যাদি ছবিতে। ঢাকায় তিনি ফজলে আহমেদ বেনজীর পরিচালিত প্রতিরোধ ছাড়াও একই নির্মাতার হুঁশিয়ার ছবিতে অভিনয় করেছেন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী।
আমি যে আঁধারে বন্দিনী
‘আমি যে আঁধারে বন্দিনী’ প্লেব্যাকের ইতিহাসে অন্যতম সেরা গান। গানটি গেয়েছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। আলমগীর কবিরের ক্ল্যাসিক সূর্যকন্যার (১৯৭৬) গান এটি। এতে পর্দায় যাঁকে ঠোঁট মেলাতে দেখা যায়, তাঁর সঙ্গে দর্শকদের পরিচয় সামান্য। রাজশ্রী কলকাতার নায়িকা। ওখানে তাঁর প্রথম ছবি প্রান্তরেখা। সত্তরের দশকে যৌথ প্রযোজনার ছবি সূর্যকন্যায় অভিনয়ের জন্য তিনি ঢাকায় আসেন। কলকাতায় প্রতিষ্ঠা পেলেও রাজশ্রীর জন্ম ফরিদপুরে।
পড়ে না চোখের পলক
‘পড়ে না চোখের পলক’ গানটি প্রাণের চেয়ে প্রিয় (১৯৯৭) ছবির। গানটি এ্যান্ড্রু কিশোরের গাওয়া অগণিত গানের মধ্যে জনপ্রিয়তায় প্রথম দিকে। গানটিতে ঠোঁট মেলান রিয়াজ। আর এ গানের নায়িকা রাবিনা। তাঁকে মুম্বাই থেকে ছবির পরিচালক মুহম্মদ হাননান ঢাকায় নিয়ে আসেন। প্রাণের চেয়ে প্রিয়র গানগুলো দর্শক-শ্রোতারা সাদরে গ্রহণ করেন। ছবিটিও গানের ওপর ভর করে সুপারহিট হয়ে যায়। নায়িকার সৌন্দর্য দর্শকদের মনে ধরেনি। পরে রাবিনাকে নিয়ে আরও একটি ছবি নির্মাণ করেন হাননান। সাবধান নামের অ্যাকশন ছবিটি বেশি সাড়া জাগায়নি। রাবিনা যেভাবে হুট করে এসেছিলেন, সেভাবেই হুট করে মিলিয়ে গেছেন।
তুমি চাঁদের জোছনা নও
‘তুমি চাঁদের জোছনা নও’ গানটি নব্বইয়ের দশকের সুপারহিট ছবি হৃদয়ের আয়নার (১৯৯৭)। গানটি গেয়েছেন এ্যান্ড্রু কিশোর ও সাবিনা ইয়াসমিন। গানটিতে ঠোঁট মেলান রিয়াজ ও আয়না। ছবির নামের সঙ্গে নায়িকার নামের এমন মিল বিরল নয়। হৃদয়ের আয়না আয়নার প্রথম ছবি। গানবহুল ছবিটি পায় দর্শকপ্রিয়তা। কিন্তু আয়না ছবিটির সাফল্য পুঁজি করে বহুদূর যেতে পারেননি। বলতে গেলে প্রথম ছবির পরই তিনি হারিয়ে যান। অথচ একই ছবি হৃদয়ের আয়না থেকে জয়যাত্রা সূচিত হয় রিয়াজের। হৃদয়ের আয়নার গানগুলো শ্রোতাদের হৃদয়ে রয়ে গেলেও আয়নার মুখটি পুরোপুরি হারিয়ে গেছে।
ঢাকায় যারা চাকরি গো করে
‘ঢাকায় যারা চাকরি গো করে, তারা কেন প্রেমে পড়ে প্রাণ সখী গো’ গানটি উজানভাটি (১৯৮২) ছবির। গানটি গেয়েছেন মীনা বড়ুয়া। আশির দশকে গানটি এবং ছবিটিও খুব হিট হয়েছিল। এই গানে ঠোঁট মেলান উজানভাটির নায়িকা নবীনা। নতুন শিল্পীদের নিয়ে তৈরি ছবিটি হিট হলে খুব আলোচনা হয় চলচ্চিত্রপাড়ায়। তবে নবীনা তারকার খ্যাতি পাননি। তাঁর আসল নাম সাথী দাসগুপ্তা। তিনি ময়মনসিংহের মেয়ে। শিশুশিল্পী হিসেবে প্রথম অভিনয় করেন মানুষের মন ছবিতে। নায়িকা হিসেবে প্রথম ছবি উজানভাটি। মান অভিমান ছবিতেও তিনি অভিনয় করেছেন।
তুমি আমার এমনই একজন
‘তুমি আমার এমনই একজন’ গানটি আনন্দ অশ্রু (১৯৯৭) ছবির। কনকচাঁপার গাওয়া জনপ্রিয় গানটিতে ঠোঁট মেলান কাঞ্চি। এ গানের কারণে দর্শক কাঞ্চিকে খুঁজে ফেরেন। গানটি শ্রোতাদের কাছে ২০ বছরের বেশি সময় ধরে প্রিয়। গানটির নায়িকা কাঞ্চি খুব বেশি ছবিতে অভিনয় করেননি। প্রথম সারিতেও আসেননি তিনি। পৃথিবী আমারে চায় না, অচল পয়সা, তুমি শুধু তুমি, মৃত্যু কত ভয়ংকর, দেমাগ ইত্যাদি ছবিতে অভিনয় করেন কাঞ্চি। তিনি চিত্রনায়ক ইমরানকে বিয়ে করে আলোচিত হোন। দীর্ঘদিন ধরে তিনি পর্দা থেকে দূরে। এখন তিনি প্রবাসে।
একদিন স্বপ্নের দিন
‘একদিন স্বপ্নের দিন বেদনার বর্ণবিহীন’ গানটি যত দিন দর্শক মনে রাখবেন, তত দিন তাঁদের মনে ভাসবে প্রিয়াংকা ত্রিবেদীর মুখ। হঠাৎ বৃষ্টি (১৯৯৯) ছবিতে নচিকেতা ও শিখা বসুর গাওয়া গানটি জনপ্রিয়। গানের সঙ্গে পর্দায় ঠোঁট মেলান ফেরদৌস ও প্রিয়াংকা। তিনি চুপিচুপি ও সবুজ কোট কালো চশমা ছবিতেও অভিনয় করেন। প্রথমটি যৌথ প্রযোজনার ছবি, দ্বিতীয়টি বাংলাদেশের ছবি। প্রিয়াংকা গত দশকে কলকাতার সিনেমায় অভিনয় করেছেন। দীর্ঘদিন ধরে অভিনয়ে নেই তিনি। দক্ষিণ ভারতের এক অভিনেতাকে বিয়ে করে পর্দার অন্তরালে চলে যান প্রিয়াংকা।
তুমি আমার চাঁদ আমি চাঁদেরই আলো
‘তুমি আমার চাঁদ আমি চাঁদেরই আলো’ গানটি চাঁদের আলো (১৯৯২) ছবির। এ্যান্ড্রু কিশোর ও রিজিয়া পারভীনের গাওয়া গানটিতে ঠোঁট মেলান ওমর সানী ও মুক্তি। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে নতুনদের জোয়ারে আসেন অভিনেত্রী আনোয়ারার মেয়ে মুক্তি। চাঁদের আলো ও ছবির গান সুপারহিট হলেও মুক্তি সরে যান সিনেমা থেকে। নতুন প্রজন্মের দর্শক তাঁকে ভুলতে বসেছেন। কিন্তু তাঁর অভিনীত গানটি রয়ে গেছে তরতাজা। মুক্তি পর অবশ্য শ্রাবণ মেঘের দিন ও হাসন রাজা ছবিতে অভিনয় করেছেন। কাজ করেছেন নাটকেও।
লুকোচুরি লুকোচুরি গল্প
‘লুকোচুরি লুকোচুরি গল্প’ গানটি গত দশকের জনপ্রিয় গানগুলোর একটি। ফাহমিদা নবীর গাওয়া আর কোনো গান এতটা জনপ্রিয় হয়নি। গানটি এনামুল করিম নির্ঝর পরিচালিত আহা (২০০৭) ছবির। গানটিতে পর্দায় যাঁকে দেখা যায়, তাঁকে দর্শক খুব কম ছবিতে দেখেছেন। সুন্দরী প্রতিযোগিতা থেকে উঠে আসা সাথী ইয়াসমিন এহতেশামের আবিষ্কার। যৌথ প্রযোজনায় তৈরি পরদেশী বাবু তাঁর প্রথম ছবি। তিনি আরও অভিনয় করেছেন আব্বাজান, অন্যায়ের প্রতিশোধ, বড় মালিক, বীর সৈনিক ছবিতে। শেষের ছবিটির জন্য সাথী পার্শ্ব-অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।