নারীর জীবন যেখানে যেমন

জর্জিয়ার নারী মানানা। বয়স ৫০। একটা স্কুলে পড়ান। স্বামী, এক ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে থাকেন মা–বাবার সঙ্গে। বাইরে থেকে দেখে সবাই বলেন, আহ! কী সুখী পরিবার। কী ভাগ্য মানানার।

কিন্তু মানানার তা মনে হয় না। বিয়ের পর স্বামী সোসোকে নিয়ে নিজেদের মতো থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কাজকর্মের প্রতি উদাসীন আর দায়িত্ব নিতে অপারগ স্বামী সেই পথে হাঁটেননি। বরং শ্বশুরবাড়িতে নিশ্চিন্তে থাকার পথটাই তিনি বেছে নিয়েছিলেন। সেই যে শুরু, এরপর মধ্যবিত্ত সমাজের চোখে একটা সুখী পরিবার হতে শুধু ছাড়ই দিয়ে গেছেন মানানা।

সুখের অভিনয় করতে করতে ক্লান্ত মানানা। এর মধ্যে হাইস্কুলপড়ুয়া তার এক ছাত্রীর সিদ্ধান্ত তাঁর চোখ খুলে দেয়। মেয়েটি ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। চেষ্টা করেছিল সুখী পরিবারের জন্য। ব্যাটে-বলে মেলেনি। কিশোরী সিদ্ধান্ত নিল, এখনই যখন দুজনের মিল হচ্ছে না, দিনে দিনে তো সেটা কেবলই বাড়বে। সামনে অনেক সময় পড়ে আছে, নিজেদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য বিবাহবিচ্ছেদটাই ভালো।

বিষয়টা মানানার মনে দাগ কাটে। তিনি সবাইকে ছেড়ে আলাদা বাসায় ওঠেন। স্বজনদের মধ্যে ছি ছি পড়ে যায়। সবাই মিলে বৈঠকে বসেন মানানাকে বোঝাতে। মানানার শুধু মনে হয়, তিনি তো কারও জীবনে হস্তক্ষেপ করেননি। তাহলে সবাই কেন তার জীবনে নাক গলান? নারী বলেই কি তার নিজের মতো বাঁচার অধিকার নেই? তার বাবা, ভাই, এমনকি তার স্বামী যে পরকীয়ায় জড়িয়ে ১৩ বছরের ছেলের জনক; তাদের প্রতি সমাজ-পরিবার কখনো আঙুল তোলেনি, প্রশ্নবাণে জর্জড়িত করেনি! যুগের পর যুগ চলতে থাকা নারী-পুরুষের বৈষম্যের এমন একগাদা প্রশ্ন ছুড়ে দেয় মাই হ্যাপি ফ্যামিলি।

ভারতের উচ্চবিত্ত তরুণ দম্পতি অমৃতা ও বিক্রমের সংসারের কথাই ধরা যাক। পদোন্নতি না পেয়ে মেজাজ হারিয়ে ভরা মজলিশে স্ত্রীকে দেওয়া এক থাপ্পড় সবকিছুর হিসাব বদলে দেয়। দাম্পত্য মানে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা। কোনো অজুহাতেই শারীরিক নিপীড়ন এখানে গ্রহণযোগ্য নয়, চড়-থাপ্পড় তো নয়ই।

এই ঘটনায় বিক্রম একটিবারের জন্যও অমৃতার কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন না। কারণ, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাকে এই শিখিয়ে বড় করেছে যে এটা কোনো ঘটনাই না। স্বামী তো একটা চড় স্ত্রীকে দিতেই পারেন! অমৃতা বিক্রমকে ছেড়ে বাবার বাড়ি চলে যান। সেখানেও সবাই তাকে বলতে থাকেন, এটা অমৃতার বাড়াবাড়ি। সংসারে থাকতে গেলে এমন একটু-আধটু হয়ই। মেনে নিলেই হয়!

আত্মসম্মানে আঘাত লাগা থাপ্পড়টা ভুলতে পারেন না অমৃতা। তার মনে হয়, একটা থাপ্পড় মামুলি কোনো বিষয় নয়। এই ইস্যুতে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করতে গেলে নারী আইনজীবী পর্যন্ত তার প্রতি বিরক্ত হন। তাকে বুঝিয়ে সংসারে ফেরত যেতে বলেন। কিন্তু অমৃতার একটাই কথা, সম্পর্কে ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা থাকলে গায়ে হাত তোলার ঘটনা ঘটে না। যখন এগুলোই নেই, তখন মিছিমিছি কেন সংসার সংসার খেলা! দাম্পত্যে চড়-থাপ্পড়কে স্বাভাবিক হিসেবে দেখা সমাজের গালে কষে থাপ্পড় দেয় অনুভব সিনহার ছবিটি।

বৈষম্যের এই দুনিয়ায় নিম্নবিত্ত নারীর লড়াইয়ের গল্প শোনায় পাকিস্তানের চলচ্চিত্র পিংকি মেমসাব। সন্তান হয় না বলে প্রত্যন্ত গ্রামের পিংকিকে তালাক দেন তার স্বামী। পরিবারের চাপে ভাগ্য বদলাতে গৃহকর্মী হিসেবে তাকে যেতে হয় সংযুক্ত আরব আমিরাতে। পড়াশোনা না জানা গ্রামের একটা সহজ-সরল মেয়ে ধীরে ধীরে বুঝতে পারেন জটিল পৃথিবীর কুটিল হিসাবগুলো।

পরিবারের কাছে পিংকি কেবলই টাকা উপার্জনের যন্ত্র। তার টাকাতেই গরিব পরিবারটির ভাগ্যের চাকা ঘুরতে থাকে। সুদিনের দেখা পায় তারা। তাই পিংকি যখন সব ছেড়ে-ছুড়ে পরিবারের কাছে ফিরে আসতে চান, পরিবার তাকে নিরুৎসাহিত করে। তাদের একের পর এক চাহিদার নিচে চাপা পড়ে যায় তার দেশে ফেরার আকুতি।

করোনাকালে ছবিগুলো নারীর জীবন আর চাওয়া-পাওয়াকে ভালোভাবে উপলব্ধি করার সুযোগ করে দেয়। করোনা জয় করে নতুন পৃথিবীতে নারীর সুন্দর জীবনের জন্য এমন উপলব্ধির আর কোনো বিকল্প নেই যে!