নামে নয় গানেই পরিচয়
ইউটিউবে কারও গান দর্শক শুনেছেন দুই কোটিবার, কারও আবার ভিনদেশি ভাষায় করা গান পেয়েছে জনপ্রিয়তা। গানে গানে এই সংগীতশিল্পীরা এরই মধ্যে বেশ কিছু মাইলফলক ছাড়িয়েছেন। কিন্তু চেহারায় তাঁরা খুব সাধারণ। বলছি সাজিদ সরকার, নাভেদ পারভেজ ও তাহসীনের কথা। তরুণ এই তিন সংগীত পরিচালকের অনেক গানই ঘোরে শ্রোতাদের মুখে মুখে, কিন্তু আড়ালের এই মানুষগুলো আড়ালেই থেকে যান। খ্যাতির আলোয় এখনো ঝলসে ওঠা বাকি। তাঁদের নিয়েই লিখেছেন শফিক আল মামুন।
সাজিদ সরকার
তাঁর পরিচয় নিয়ে খ্যাতি পাচ্ছে ‘ভুয়া’ সাজিদ
২০১১ সালে সাজিদ সরকারের সুর ও সংগীতে প্রথম অ্যালবাম শিহরণ বাজারে আসে। অ্যালবামটিতে তাহসান, ন্যান্সি, ইমরান, কনাসহ জনপ্রিয় শিল্পীরা গান করেছেন। ওই অ্যালবামে ন্যান্সির গাওয়া ‘এভাবে স্বভাবে’, তাহসানের ‘কেন হঠাৎ তুমি এলে’ বেশ জনপ্রিয়তা পায়। তবে ছুঁয়ে দিলে মন সিনেমায় সাজিদের সুর–সংগীতে তাহসানের গাওয়া ‘তুমি ছুঁয়ে দিলে মন’ ও ইমরান–কনার গাওয়া ‘শূন্য থেকে আসে প্রেম’ গান দুটি সাজিদকে আরও এগিয়ে নিয়ে যায়। এরপর সাজিদ সরকারের সুর ও সংগীতে বেশ কিছু নাটকের গানও আলোচনায় আসে। বিশেষ করে অ্যাঙ্গরি বার্ড নাটকে ‘প্রেম তুমি’, বড় ছেলে নাটকে ‘তাই তোমার খেয়ালে’, বুকের বাঁ পাশে নাটকে ‘বুকের বাঁ পাশে’—এসব গান সাজিদেরই করা।
সাজিদের কাছে সবচেয়ে বড় অর্জন, তাঁর গান সবাই গ্রহণ করছে। ব্যক্তি সাজিদের আড়ালে থেকে যাওয়া নিয়ে কোনো আপত্তি নেই তাঁর। কিছু অভিজ্ঞতা আমাদের জানিয়ে সাজিদ বলেন, ‘কোনো অনুষ্ঠান বা রেস্তোরাঁয় আমি আছি, পাশেই অপরিচিত দুজন। একজন আরেকজনের কাছে আমার করা গানের প্রশংসা করছেন, এমন অনেকবার হয়েছে আমার সঙ্গে। ভালোই লাগে এই সাধারণ মানুষ হয়ে থাকাটা। একবার এক অনুষ্ঠানে আমি পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। অপরিচিত দুজন বড় ছেলে নাটকের জন্য করা আমার গানটির সুর নিয়ে প্রসংশা করছিলেন।’
বেশ আগেই শোনা গিয়েছিল, একজন সাজিদ সরকার সেজে শ্রোতাদের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছেন। সাজিদ জানালেন, সেই ব্যক্তির প্রতারণা এখনো অব্যাহত আছে। বলেন, ‘আমাকে যাঁরা চেনেন না, তাঁরা তো ভাবেন ওটাই সাজিদ। মাঝেমধ্যে ওই ভুয়া ব্যক্তি আমার গানও নিজের বলে শেয়ার করতেন। বিষয়টি আমার নজরে এলে একবার রিপোর্ট করে ওই অ্যাকাউন্ট বন্ধ করেছি। আবারও ওই প্রতারক অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। এখন গান বা কোনো খবর শেয়ার দেন না। কিন্তু আমাকে ভেবে অনেকেই ওই প্রতারকের সঙ্গে ইনবক্সে যোগাযোগ করে এখনো প্রতারিত হচ্ছেন। দুঃখজনক।’
নাভেদ পারভেজ
লোকে বিশ্বাস করে না গানের সুর আমি করেছি
চলচ্চিত্রের গানের সুর ও সংগীত দিয়ে গানের জগতে কাজ শুরু নাভেদ পারভেজের। তখন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ব্রুকলিন কলেজে ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতক করছিলেন তিনি। ২০১৪ সালে কিস্তিমাত ছবিতে পড়শী, শাহিন ও তাহসীনের গাওয়া ‘শুধু একবার বলো’ গানটি বেশ আলোচনায় আসে। এরপর নাভেদের সুর ও সংগীত করা মুসাফির ছবির ‘ফিরে আয়’, অস্বিত্ব ছবির ‘আয় না বল না’, সুপার হিরো ছবির ‘বুম বুম’, যদি একদিন ছবির ‘পারব না তোমার হতে’ গানগুলো জনপ্রিয়তা পায়। কিন্তু নাভেদকে চেহারায় তখনো চেনেন না কেউ। এরপর নাটকের গানেও সফল হন নাভেদ।
ব্রুকলিন কলেজ থেকে স্নাতক শেষ করে এখন বাংলাদেশের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ করছেন। পেশা হিসেবে গানের সুর ও সংগীতকে বেছে নিয়েছেন তিনি। দেশের বাইরে এক বিষয়ে লেখাপড়া করে পেশা হিসেবে সংগীত পরিচালনা বেছে নেওয়া কেন, প্রশ্নের জবাবে নাভেদ বলেন, ‘ভালো লাগা থেকেই গানে আসা। সৃষ্টির একটা আনন্দ আছে। কাজটি দারুণ উপভোগ করি। তাই যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে এটিকে পেশা হিসেবেই নিয়েছি।’
তবে এই সুরকার ও সংগীতকার কাজের এই জায়গাকে মাঝেমধ্যে নেতিবাচক হিসেবেও দেখেন। তিনি বলেন, ‘বিশেষ কয়েকজন ছাড়া ইন্ডাস্ট্রিতে অডিও–ভিডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে সুর ও সংগীতকারদের দাম কম। এমনকি গণমাধ্যমও গানের পেছনের মানুষদের ফোকাস করে না। তারা কণ্ঠশিল্পীদেরই বেশি মূল্যায়ন করে।’
এমন একটি অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে নাভেদ জানান, তাঁর সুর ও সংগীতে তৈরি বলিউডের ‘ইশক’ গানটি দেড় কোটিবার দেখা হয়েছে ইউটিউবে। দুবাইভিত্তিক ফ্লিন্ট জে নামের একজন শিল্পী গানটি গেয়েছেন। নাভেদ বলেন, ‘একদিন এক ভক্ত ফেসবুকে আমার কাছে খুব প্রশংসা করছিলেন গানটির। কিন্তু গানটির সুরকারকে তিনি চেনেন না। যখন জানলেন সেটার সুর আমিই করেছি, তখন বেশ অবাক হয়েছিলেন ওই ভক্ত। বিশ্বাসই করছিলেন না।’
তাহসীন আহমেদ
সুরকার ও সংগীতকার হয়েই থাকতে চান
তাহসীন আহমেদের বিষয়টি অন্য দুজনের চেয়ে একটু আলাদা। সুর ও সংগীতের পাশাপাশি বেশির ভাগ গানে নিজেই কণ্ঠ দেন তাহসীন। ২০১১ সালে নিজের সুর ও সংগীতের একক অ্যালবাম ভালোবাসার রং বাজারে আসে। সব কটি গানে তিনিই কণ্ঠ দিয়েছেন। সে সময় অ্যালবামটির ‘ভালোবাসার রং’ গানটি বেশ আলোচিত হয়েছিল। এরপর ২০১২ ও ২০১৩-তে দুটি মিশ্র অ্যালবাম বের হয়। তবে নাটকের জন্য তাহসীনের তৈরি করা অনেকগুলো গান প্রশংসা কুড়িয়েছে। তার মধ্যে ‘অভিমান হাজারো, ‘একটু বেশি অকারণ’, ‘অনিবার্য কারণ’, ‘মন রঙের আঁচড়’, ‘ঠিকানা’ গানগুলো উল্লেখযোগ্য।
নিজের সুর ও সংগীতে নিজেই গাওয়ার মধ্যে আলাদা একটা সুবিধা আছে বলে জানান তাহসীন। এই সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী বলেন, ‘নিজের মতো করে গানের রূপ দেওয়া যায়, গান নিয়ে নিরীক্ষা করা যায়। নতুন নতুন আঙ্গিক প্রকাশের সুযোগ থাকে।’
গান আলোচিত হলে কণ্ঠশিল্পীই প্রশংসা পান। সুরকার ও সংগীতকার সামনে আসেন না। এমন কোনো অভিজ্ঞতা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে তাহসীন বলেন, ‘আমার জন্য এদিক দিয়ে খানিকটা সুবিধা আছে। কারণ, আমাকে অনেকেই গায়ক হিসেবে জানেন। তাই আমার তৈরি গানে অন্য কেউ কণ্ঠ দিলেও শ্রোতাদের অনেকেই ভাবেন ওটা আমারই গাওয়া।’
উদাহরণ টেনে তাঁর নিজের সুর ও সংগীত করা দুটি নাটকের গানের কথা জানান তাহসীন। বলেন, ‘শেষটা সুন্দর ও লাল রঙা স্বপ্ন নামে দুটি নাটকে ‘আংশিক মেঘলা’ ও ‘দূর আকাশ ছুঁই’ শিরোনামে গান দুটি গেয়েছেন অভিনেতা তামিম মৃধা। দর্শক-শ্রোতাদের কাছে বেশ প্রশংসিত হয়েছে গান দুটি। শোনার পর প্রথমে অনেকেই ভেবেছিলেন দুটি গান আমিই গেয়েছি। বিষয়টা এমন।’
নাভেদ ও সাজিদের মতো গানের সুর-সংগীত পরিচালনা করা উপভোগ করেন তাহসীনও। তিনি বলেন, ‘সুরকার ও সংগীতকার হিসেবেই নিজেকে দেখতে চাই আমি। কাজটি করতে ভালোবাসি। এই কাজের মধ্যে একটা রোমাঞ্চকর ব্যাপার আছে।’