নগরে গাঁয়ের পালার স্বাদ দিচ্ছে 'বিয়াল্লিশের বিপ্লব'
>
পেশাদার যাত্রার দল না উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। তবু তারা ঐতিহ্যবাহী যাত্রার আদলে এনেছে বিয়াল্লিশের বিপ্লব পালাটি। ইতিমধ্যে সাড়াও ফেলেছে নাগরিক দর্শকের মধ্যে। উদীচীর যাত্রাপালাটির বিস্তারিত জানাচ্ছেন মাসুম আলী
শীত, উৎসব, পার্বণ মানেই যাত্রাপালা। কয়েক দশক আগে পর্যন্ত জেলার গ্রামাঞ্চলে ছবিটা সে রকমই ছিল। সারা শীতেই চলত যাত্রার মৌসুম। গ্রামের লোকেরা নিজেরাই শামিয়ানা টাঙিয়ে যাত্রা আসরের আয়োজন করতেন। তরুণেরা রংচঙে পোশাক পরে যাত্রা মঞ্চস্থ করতেন। আর সেই সব যাত্রার কথা অনেক দিন ধরে লোকের মুখে মুখে ফিরত।
যুগ বদলেছে। বিনোদনের রকমসকম বদলেছে। নিত্যনতুন বিনোদন মাধ্যম শহর পার হয়ে গ্রামেও গিয়ে হাজির হচ্ছে। ভাটা পড়ছে যাত্রার জনপ্রিয়তায়। পরিস্থিতি যখন এমন, তখন সেই যাত্রাপালাকে শহরের মঞ্চে এনেছে দেশের ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। সংগঠনের কেন্দ্রীয় নাটক বিভাগ নিয়মিত পরিবেশন করছে যাত্রাপালা বিয়াল্লিশের বিপ্লব।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নিয়ে পালা লিখেছেন প্রসাদকৃষ্ণ ভট্টাচার্য্য, নির্দেশনা দিয়েছেন ভিক্টর দানিয়েল। দেশপ্রেম ও ব্রিটিশবিরোধী বক্তব্য প্রচার করে চারণকবি মুকুন্দ দাস শুরু করেছিলেন ‘স্বদেশি যাত্রা’। উদীচীরও প্রথম পরিবেশনা সেই ব্রিটিশ ভারতের স্বদেশি আন্দোলনের ওপর ভিত্তি করে।
আর যা–ই হোক, উদীচী যাত্রার পেশাদার দল নয়। তাদের পরিবেশনার স্থানও ভিন্ন, শিল্পকলা একাডেমির শীতাতপনিয়ন্ত্রিত পরীক্ষণ থিয়েটার মিলনায়তনে বিগত দিনগুলোর প্রদর্শনী হয়েছে। তাতে কী, বিয়াল্লিশের বিপ্লব দেখে একেবারেই পাড়াগাঁয়ের সেই যাত্রাপালার কথা মনে পড়ল। শিল্পকলা একাডেমির চেনা মিলনায়তনটির ঠিক মধ্যে চারপাশ খোলা মঞ্চটা অনেকের স্মৃতিতে কড়া নাড়ে। স্মৃতিতে কড়া নাড়ার কারণও আছে। পালার শুরুতে কানে বাজতে থাকে হারমোনিয়াম, তবলা, কর্নেট, ক্ল্যারিওনেট, মন্দিরা বাদন। চোখে পড়ে রকমারি আলো, ঝকমকে সাজপোশাক।
ঐতিহ্যবাহী রীতিতে শুরু হয় গান দিয়ে। প্রথমে বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ। স্লোগান দিতে দিতে মঞ্চে আসেন আট নারী শিল্পী। তাঁরা গান ধরেন, ‘আমি মানুষেরে ভালোবাসি এ কি মোর অপরাধ...’। সত্যেন সেনের লেখা। তারপর শুরু হয় পালা। স্বদেশি আন্দোলনের বিপ্লবীরা মিছিল করতে থাকে স্বাধীনতার দাবি নিয়ে।
ঐতিহ্যবাহী নাট্যরীতিতে করা হয়েছে প্রযোজনাটি। সময়টা ১৯৪২ সাল, রক্তঝরা স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাসের এক রক্তাক্ত অধ্যায়। বাংলার মৃত্যুপাগল যৌবন সেদিন দাবানলের মতো জ্বলে উঠেছিল, জীবন পণ করে যুদ্ধ করেছিল ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য। মূলত তাদের ওপরই আলো ফেলেছেন পালাকার। পালায় উদীচীর নবীন-প্রবীণ শিল্পীরা অভিনয় করেছেন। বাদ্যযন্ত্র, এমনকি প্রমোটারের দায়িত্বটিও পালন করেছেন উদীচীর একজন কর্মী।
দেশজুড়ে যাত্রাশিল্পের যখন ভগ্নদশা, তখন এ রকম একটি কাহিনি নিয়ে উদীচীর শিল্পী-কর্মীরা এগিয়ে এসেছেন এ শিল্পকে পুনরুদ্ধারের চেষ্টায়। উদীচীর নাট্য বিভাগের সম্পাদক মারুফ রহমান বললেন, ‘আমাদের লোকজ সংস্কৃতির মূল্যবান ও মৌলিক শিল্পমাধ্যমের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী সম্পদ যাত্রাপালা। কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে উদ্যোক্তাদের অর্থলোভী মানসিকতা, অশ্লীল নৃত্যের প্রভাবে এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পমাধ্যম কলুষিত হয়েছে। সুস্থ চিন্তার দর্শকেরা এর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেন। উদীচী প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই সমাজের সব অপসংস্কৃতি দূর করে বাঙালির যাবতীয় কল্যাণমুখী সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে লালন, প্রচার ও প্রসারে কাজ করে। তাই যাত্রাশিল্পের এই সংকটকালে এগিয়ে আসা প্রয়োজন মনে করেই আমরা এই উদ্যোগ নিয়েছি।’
যাত্রাশিল্পে ‘অধিকারী’র ভূমিকা কী, মন্দিরা-বাঁশির সঙ্গে কীভাবে ক্ল্যারিওনেট সংগত দিতে পারে—এমনই নানা প্রশ্নের জবাব মিলেছে উদীচীর বিয়াল্লিশের বিপ্লব–এ। পাশাপাশি শহরের দর্শকদের নিয়মিত যাত্রাপালার স্বাদ দিয়ে চলছে সংগঠনটি। মাইকে বা দেয়ালে, গাছে গাছে পোস্টার না; বরং তাদের প্রচার চলছে ফেসবুকে, মোবাইলের বার্তায়। আগামী শনিবার ১৪ সেপ্টেম্বর এ পালার অষ্টম প্রদর্শনী হবে শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার হলে।