তাঁর প্রশংসা অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করত

খালিদ হোসেন (৪ ডিসেম্বর ১৯৩৫–২২ মে ২০১৯)
খালিদ হোসেন (৪ ডিসেম্বর ১৯৩৫–২২ মে ২০১৯)

নজরুলের গান যুগ যুগ ধরে আজও একইভাবে মানুষের রক্তে অনুরণন তোলে। এত দিন প্রযুক্তি এত উন্নত ছিল না। শিল্পীরা গান তুলতেন, সেগুলো পরিবেশিত হতো। সেই অবস্থা থেকে আজ অবধি রিলে রেসের মতো করে আমাদের পর্যন্ত এনে দিয়ে গেছেন পূর্ববর্তী প্রজন্মের শিল্পীরা। সেই প্রেক্ষাপটে আমাদের দেশের সবচেয়ে বিখ্যাত, যাঁরা নজরুলসংগীতে আমাদের পথ প্রদর্শন করে গেছেন, আদর্শ বানিয়ে গেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম সুধিন দাশ, সোহরাব হোসেন ও ফিরোজা বেগম। ফিরোজা বেগম নাম করেছেন গানে, স্বরলিপিকার হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন সুধীন দাশ আর কণ্ঠস্বরে অনন্য–অসাধারণ ছিলেন সোহরাব হোসেন। তাঁদের ঠিক পরপরই খালিদ হোসেন একটি অনন্য–অসাধারণ নাম।

অগ্রজদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে নজরুলসংগীতের চর্চাটা তিনি করিয়েছেন, শিক্ষার্থী তৈরি করেছেন। সংগীত চর্চায় বিপুলভাবে জড়িয়ে ছিলেন সব সময়। জ্যেষ্ঠ শিল্পী হিসেবে তিনি আমাদের সহযাত্রী ছিলেন। তিনি অনেক কাজ করে গেছেন। তিনি যে সংগীত সাধনা করে গেছেন, সেখানে তিনি যথেষ্ট সফল। সফলতা আর কাজের স্বীকৃতি পাওয়ার সৌভাগ্য অনেক শিল্পীর হয়, অনেকের হয় না। স্বীকৃতি পাওয়া যে একজন শিল্পীর জন্য কত বড় অনুপ্রেরণা এবং সেটা যদি বেঁচে থাকতে পাওয়া যায়, সেটা হয় আরও বড় কিছু। সেটাই ঘটেছে খালিদ হোসেনের জীবনে। তিনি তাঁর কর্মক্ষেত্রে যেভাবে সম্মানিত হয়েছেন, মূল্যায়িতও হয়েছেন।

অনেক প্রতিষ্ঠানের উনি অধ্যক্ষ ছিলেন। সংগঠন সৃষ্টি করেছেন, প্রতিষ্ঠানও সৃষ্টি করেছেন। সংগঠক হিসেবে, শিক্ষক হিসেবে, শুদ্ধ শিল্পী হিসেবে তিনি তাঁরই তুলনা। সবচেয়ে বড় কথা হলো তাঁর এই সৌভাগ্য। খুব ভালো শিল্পীও অনেকে সময় জীবিত অবস্থায় স্বীকৃতি পান না। কিন্তু তিনি স্বীকৃতিও পেয়েছেন, সমাজ ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে অবদানও রেখে গেছেন। বিশেষ করে যখন নজরুলের ইসলামি গানের কথা বলা হয়, এক বাক্যেই উঠে আসে খালিদ হোসেনের নাম।

একজন শিল্পীর জীবনে মোটামুটি যা কিছু চাহিদা থাকে তাঁর পূর্ণতা তিনি পেয়েছেন। তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন নজরুলের ১২০তম জয়ন্তীর ঠিক আগে। যার ফলে নজরুলকে স্মরণের মুহূর্তেই এখন স্মরণে এসে যাচ্ছে তাঁর নামটিও। মানুষ তো সবাই চলে যাবে, আমরাও চলে যাব, কেউ তো সারাজীবন বেঁচে থাকবেন না। কিন্তু আমাদের কর্ম যদি থেকে যায়, সেটাই সফলতা। সে ক্ষেত্রে আমি বলব খালিদ হোসেন একজন সফল শিল্পী। তাঁর অসংখ্য শিক্ষার্থী আছেন। তাঁদের শিক্ষায় বেঁচে থাকবেন তিনি। এ ছাড়া ব্যক্তি মানুষ হিসেবে তাঁর একটা গুণ ছিল মানুষের প্রশংসা করার। সেটা শুধুই প্রশংসা নয়, শিল্পীদের জন্য সেই প্রশংসা একটি অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করত। তিনি সব সময় আমাকেও সেই অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন। আমার নজরুলসংগীত সমগ্র–এর কয়েকটি খণ্ড বেরিয়েছে, শুদ্ধ বাণী প্রমিত সুরে রেকর্ড করা—তিনি এসবের প্রচুর প্রশংসা করতেন। আমি তাঁর প্রশংসাগুলোকে নিতাম অনুপ্রেরণা হিসেবে। আমি বলব, একজন জ্যেষ্ঠ শিল্পী হিসেবে খালিদ হোসেনকে আমি যেভাবে দেখেছি, তিনি ছিলেন একজন খুবই গুণী মানুষ এবং সমাজ, সংস্কৃতি ও বাংলা গানে তিনি এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। এটা একটা বড় ব্যাপার। আমি তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি। এভাবে মানুষের মধ্যে থেকে যেতে পারাটা একটা বিশাল ব্যাপার।

অনুলিখন
লেখক: নজরুল সংগীতশিল্পী