ঢাকাই সিনেমার সেকালের সাফল্য একালের ব্যর্থতা
দেশি ছবির দিকে তাকালে সত্যিকার অর্থেই এখন কান্না পায়। একসময় কী জমজমাটই না ছিল এ দেশের সিনেমা হলগুলো! চিরচেনা চরিত্রের ভিড়ে সামাজিক সেন্টিমেন্টের ছবিগুলো ছিল হাসিকান্নার সিকোয়েন্সে ভরপুর।
দর্শক প্রাণভরে উপভোগ করে তৃপ্তি নিয়ে সিনেমা হল থেকে বেরিয়েছেন। এরপর কয়েকটা দিন ছায়াছবির দৃশ্যগুলো দর্শকের স্মৃতিপটে ভাবনাবিলাসের রিল টেনে যেত। আনমনে দর্শক বারবার সুর ভাঁজতেন ছবির হৃদয়ছোঁয়া কোনো গানের। কল্পনায় ছবির নায়ক বা জীবনঘনিষ্ঠ কোনো চরিত্রের মধ্যে আবিষ্কারের চেষ্টা করতেন নিজেকে।
আর এখন? দেশি চলচ্চিত্রের দৈন্য। হাজারো সিনেমা হলের অস্তিত্ব বিলীন হতে হতে এখন শতকের ঘরে বন্দী। হতাশা এখানেই ঝাপটা মেরে ক্ষান্ত নয়। এসব হল বছরজুড়ে সচল রাখার মতো নতুন ছবির আকাল। জবরদস্ত লগ্নি নেই, এক নামে ঘাই মারার মতো পরিচালক নেই, আর নায়ক-নায়িকার আক্রা তো আছেই। এক শাকিব খান বা বুবলীকে নিয়ে আর কদিন?
এখন প্রশ্ন জাগাটা স্বাভাবিক, দেশি চলচ্চিত্রের এমন ১২টা বাজল কেন? এই মহিরুহের পতনবীজ খোঁজার আগে একপাক ঘুরে আসা যাক আদি উৎস সেই সত্তরের দশকে।
জাদুকরি সত্তর
ওই সময় দেশি ছায়াছবির মধ্যে একটা জাদু ছিল। কাহিনি, নির্মাণশৈলী, অভিনয়, গান, এমনকি সিনেমার পোস্টারেও ছিল ছুঁ মন্তর ছুঁ। জেলা বা মফস্বল শহরের জনবহুল মোড়ে নতুন কোনো ছবির পোস্টার লাগালে পথচারীরা গন্তব্যের কথা ভুলে হাঁ করে দাঁড়িয়ে যেতেন।
সত্তরের দশক এ দেশের চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগ। ওই সময় সামাজিক সেন্টিমেন্টের এমন সব দারুণ ছবি নির্মিত হয়েছে, প্রেক্ষাগৃহে ঢুকে সব ধরনের দর্শক ছবিগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখেছেন।
ঢাকাই ছবির যাত্রালগ্ন থেকেই বেশ কিছু ভালো ছবি তৈরি হয়েছিল। এরপর ১৯৭০ সাল বা এর আগে বেশ কিছু ভালো ছবি তৈরি হয়েছে। সব ধরনের দর্শককে একঠায় সিনেমা হলে ধরে রাখার মতো গুণী চলচ্চিত্র নির্মাতারও অভাব ছিল না। পুরোধা ব্যক্তি আবদুল জব্বার খানের পথ অনুসরণ করে এহতেশাম, মুস্তাফিজ, সুভাষ দত্ত, রহীম নেওয়াজ, নারায়ণ ঘোষ মিতা, এস এম শফি, মোস্তফা মেহমুদ, খান আতাউর রহমান, আজিজুর রহমান, মহসিন, কামাল আহমেদ প্রমুখ বেশ কিছু ভালো ছবি তৈরি করেছেন।
‘এ দেশ তোমার আমার’, ‘হারানো দিন’, ‘চকোরী’, ‘রাজধানীর বুকে’, ‘চান্দা’, ‘কখগঘঙ’, কাঁচের স্বর্গ, ‘নাচের পুতুল’, ‘কাঁচ কাটা হীরে’, ‘সমাধান’, ‘দীপ নেভে নাই’, ‘ছদ্মবেশী’, ‘অশ্রু দিয়ে লেখা’, ‘ছন্দ হারিয়ে গেল’, ‘পীচ ঢালা পথ’, ‘নীল আকাশের নিচে’, ‘আবির্ভাব’, ‘যে আগুনে পুড়ি’, ‘কত যে মিনতি’, ‘আগন্তুক’, ‘যোগ বিয়োগ’, ‘মানুষের মন’, ‘অন্তরঙ্গ’, ‘একই অঙ্গে এত রূপ’, ‘স্মৃতিটুকু থাক’, ‘যাহা বলিব সত্য বলিব’—এমন আরও অনেক ছবির নাম করা যায়।
গুণী নির্মাতা জহির রায়হান তাঁর এক ছবি ‘জীবন থেকে নেয়া’ দিয়েই তো বাজিমাত করলেন। সাধারণভাবে তা পারিবারিক ড্রামা। প্রতীকী ব্যঞ্জনায় এসেছে তৎকালীন পাকিস্তানি স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন। এককথায় ওই সময় জহির রায়হানের এই সাহসী শৈল্পিক ভূমিকা ছিল অসাধারণ!
এ সময় দর্শক মাত করা অনেক ছবি তৈরি হয়েছে। কাহিনি, চিত্রনাট্য, সংলাপ, পরিচালনা—সবই ছিল স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে অনন্য। গানগুলোর কথা আর সুর মন ছুঁয়ে যেত। এখানে ‘দর্পচূর্ণ’ ছবির কথা বলা যায়। নিটোল একটা প্রেমের গল্প। কাহিনির বাঁকে বাঁকে ছিল ড্রামা। অভিনয়ে ছিলেন ওই সময়ের অন্যতম সেরা রোমান্টিক জুটি রাজ্জাক-কবরী। ছবিটির সেই যে প্রাণ উতলা করা গান ‘তুমি যে আমার কবিতা...’ এখনো অনেককে আপ্লুত করে। এ ধরনের ছবি ছিল আরও অনেক।
পরিচালকও ছিলেন একেকজন বাঘা বাঘা। যেমন নারায়ণ ঘোষ মিতা। ১৯৬৮ সালে মুক্তি পেল তাঁর ‘এতটুকু আশা’। সে ছবি দেখতে গিয়ে দর্শক কেঁদেকেটে আকুল। বিশেষ করে ‘তুমি কি দেখেছো কভু জীবনের পরাজয়...’এই গানের দৃশ্যে হাপুসনয়নে কেঁদে বুক ভাসিয়েছেন দর্শক। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাঁর ‘আলোর মিছিল’ ছবিটিও ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায়। এ ছবিতে বেশ কিছু শ্রুতিমধুর গান রয়েছে। পরবর্তী সময়ে আরও কিছু দর্শকনন্দিত ছবি আসে তাঁর হাত ধরে।
আর কাজী জহিরের নাম না বললেই নয়। তাঁর প্রতিটি ছবিই অসাধারণ। ছবির কাহিনির বাঁকে বাঁকে চমক, নাটকীয়তা আর গান হলো তাঁর ছবির প্রাণ। ষাটের দশকে যাত্রা শুরু করে সত্তরের দশকজুড়ে তিনি ডাকসাইটে নির্মাতা হিসেবে ছিলেন। ‘নয়নতারা’, ‘ময়নামতি’, ‘মধুমিলন’—এসব ছবি করে পর্দা কাঁপিয়ে দিলেন। ‘ময়নামতি’ ছবিতে বশীর আহমেদের গাওয়া ‘অনেক সাধের ময়না আমার...’ এবং ‘মধুমিলন’ ছবিতে ফেরদৌসী রহমানের গাওয়া ‘কথা বলো না বলো ওগো বন্ধু...’ গানগুলো পুরোনো দিনের দর্শক-শ্রোতাকে এখনো আবেগাপ্লুত করে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কাজী জহির বানালেন ‘অবুঝ মন’। এই ছবিতে হিন্দু জমিদারকন্যার সঙ্গে মুসলিম ডাক্তারের প্রেম নিয়ে এলেন তিনি। তাঁর শৈল্পিক উপস্থাপন দর্শক লুফে নিল। এ ছবিতে ‘চলার পথে অনেক দেখা...’ গানটি বেশ জনপ্রিয়তা পায়। মেলোড্রামায় অভ্যস্ত ঢাকাই ছবির দর্শকদের তিনি দিলেন ভিন্ন রকমের ট্র্যাজেডির স্বাদ। তাঁর আরেকটি সুপারহিট ট্র্যাজেডি ছবি ‘বধূবিদায়’।
খান আতা কি কম? শবনম-রহমান অভিনীত তাঁর রোমান্টিক ছবি ‘জোয়ার ভাটা’ ওই সময়ের অন্যতম সেরা ছবি। গানগুলো অসম্ভব মিষ্টি। একটি ছিল ‘কুহু কুহু কোকিলা যারে ডাকে...’। খান আতা নিজেও এ ছবিতে বিশেষ চরিত্রে অভিনয় করেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ওই সময় দিগ্ভ্রান্ত যুবকদের কাহিনি বানালেন ‘আবার তোরা মানুষ হ’। এ ছবিতেও শ্রুতিপ্রিয় একাধিক গান রয়েছে। রয়েছে একটি প্রধান চরিত্রে খান আতার অসাধারণ অভিনয়।
ওই সময় অবশ্য মুক্তিযুদ্ধে পটভূমিতে বেশ কিছু ছবি নির্মিত হয়। এগুলো মোটামুটি সবই প্রশংসিত হয়েছে। দর্শক টেনেছে। এর মথ্যে ‘ওরা ১১ জন’, ‘অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী’, ‘আমার জন্মভূমি’, ‘ধীরে বহে মেঘনা’—ছবি বেশি আলোচিত হয়। এসব ছবির মধ্যে মিতার ‘আলোর মিছিল’, হারুনর রশীদের ‘মেঘের অনেক রং’, খান আতার ‘আবার তোরা মানুষ হ’ ছিল একেবারেই অন্য রকম।
একের ভেতর অনেক গুণ ছিল খান আতার। তিনি যে কেবল সুনিপুণ পরিচালকই নন, শক্তিমান অভিনেতা, গুণী সংগীত পরিচালক, ভালো চিত্রনাট্যকার, কাহিনিকার ও সংলাপ রচয়িতা ছিলেন। রহীম নেওয়াজ পরিচালিত ‘মনের মতো বউ’ ছবিতে অভিনয় আর সুরকার হিসেবে ওই সময়ের অগণিত দর্শক-শ্রোতাকে মাত করেছেন তিনি। ১৯৭৫ সালে মুক্তি পাওয়া তাঁর ‘সুজন সখী’ ছবিটি গুণে–মানে যেমন প্রশংসা অর্জন করে, তেমনি আয়ও করে প্রচুর। এ ছবির গানগুলোর মধ্যে ‘সব সখীরে পার করিতে নেব আনা আনা...’ ওই সময়ের অন্যতম সুপারহিট খান।
এমন আরেকজন চলচ্চিত্র নির্মাতা ছিলেন জহিরুল হক। তিনিও ভালো কাহিনি লিখতেন। সংলাপ-চিত্রনাট্যে ছিলেন কুশলী। ভালো অভিনয় করতেন। বাংলাদেশে তাঁর হাতেই প্রথম নির্মিত হলো পরিপূর্ণ অ্যাকশন ছবি ‘রংবাজ’। ঢিসুম-ঢিসুম মারপিটে রাজা গুন্ডার ভিন্ন ইমেজে এসে সারা দেশের দর্শকদের অন্য রকম বিনোদন দিলেন নায়করাজ রাজ্জাক। এ ছবির জন্য মফস্বলের হলগুলোতে অগ্রিম টিকিটও বিক্রি হয়েছে। এরপর ‘অবাক পৃথিবী’, ‘টাকার খেলা’, ‘অপরাধ’. ‘আপনজন’. ‘সাধু শয়তান’, ‘রাতের পর দিন’, ‘বাদশা’, ‘অন্তরালে’, ‘জীবন নিয়ে জুয়া’, ‘সমাধি’, ‘গুণ্ডা’, ‘আসামি’—এমন আরও অনেক অ্যাকশন ছবি নির্মিত হয়েছে। প্রতিটি ছবিই ছিল ব্যাপক ব্যবসা সফল।
এসব ছবির আগমনে ঢাকাই ছবির দর্শকদেরও রুচির বদল ঘটে। একপর্যায়ে দেখা গেল, নিটোল সামাজিক ছবি সেভাবে আর মন ভরাতে পারছে না দর্শকদের। ছবিতে ঢিসুম-ঢিসুম অ্যাকশন, কোমর দোলানো নাচ, চটুল গান আর কৌতুকাভিনেতাদের দু-চারটা হাসির দৃশ্য না থাকলেই নয়।
এ সময় ভদ্রঘরের মার্জিত রুচির দর্শক সিনেমা হল থেকে মুখ ফেরাতে শুরু করেন। শিল্পের প্রতি নিবেদিত নিখাদ মৌলিক কাহিনির চলচ্চিত্র নির্মাতারাও থমকে যান। নতুন ধরনের নির্মাতাদের আবির্ভাব ঘটতে থাকে। দর্শকের মূল সারি থেকে শিক্ষিত সমাজ সরে যেতে থাকে।
কিছুদিন পর দেখা যায়, দর্শক নায়িকার হাসিকান্নার অভিব্যক্তির চেয়ে বরং তার কোমর দোলানো নাচটাকেই বেশি পছন্দ করছে। আর নায়কের বেলায়ও দর্শকের রুচি যায় বদলে। নায়ক কেন এই ধরার মাটির মানুষ হবেন? তিনি হবেন ‘সুপারম্যান’। নায়ক যদি একাই দশ-বারোজনকে মেরে তক্তা বানাতে না পারেন, তবে আর তিনি কিসের ‘হিরো’?
ষাট বা সত্তরের দশকে ছায়াছবির ভিলেনদের ভাবমূর্তি তেমন জুতের ছিল না। ওই সময় জাভেদ রহিম, রাজু আহমেদ, মিঠু, জুবের আলম, রাজ, মতিন, দারাশিকো, বাবর প্রমুখ অভিনেতা ঢাকাই ছবির শীর্ষস্থানীয় ভিলেন ছিলেন। কারও কারও তো এমন ইমেজ ছিল, পর্দায় এলে অনেক দর্শক আঁতকে উঠতেন। বিশেষ করে নারী দর্শক। তবে তাঁরা জনপ্রিয়তায় কখনোই নায়কদের সমকক্ষ ছিলেন না।
কিন্তু সত্তরের দশকের একটা সময় যখন অ্যাকশন ছবি দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে, এ সময় মারপিটের দৃশ্য পরিচালনার জন্য অনেক অভিনেতা আলাদা টিম গঠন করেন। অনেকে এককভাবেও ‘বিশেষ দৃশ্যের’ পরিচালক হিসেবে বেশ চাহিদা তৈরি করেন। এর মধ্যে সবার আগে আসে জসিমের নাম। তিনি গড়েছিলেন জ্যাম্বস গ্রুপ। এ ছাড়া মঞ্চুর রাহী, মাহবুব, গুই, মোসলেম প্রমুখ মারপিটের পরিচালক হিসেবে নাম কুড়ান। আর জসিম একসময় মন্দ চরিত্র থেকে সরাসরি নায়ক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তারপর দীর্ঘ সময় দাপটের সঙ্গে তিনি পজেটিভ চরিত্রে শীর্ষ ভূমিকায় অভিনয় করে গেছেন। তাঁর অনেক ছবি ব্যবসার দিক দিয়ে বক্স অফিস কাঁপিয়ে দিয়েছে। ‘দোস্ত দুশমন’ ছবিতে যে জসিম ভয়ংকর ভিলেন ছিলেন, তিনিই ‘সবুজ সাথী’, ‘সুন্দরী’, ‘রকি’—এসব ছবিতে পজেটিভ রোলে অভিনয় করে অগণিত দর্শকের মন জয় করেন।
অ্যাকশন ছবির ক্ষেত্রে চটপটে ও আধুনিকমনস্ক নির্মাতা মাসুদ পারভেজের নামটি অপরিহার্য। ১৯৭২ সালে চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি ‘ওরা ১১ জন’-এ তিনি প্রযোজক হিসেবে আবির্ভূত হন। পরের বছর কাজী আনোয়ার হোসেনের জনপ্রিয় থ্রিলার সিরিজ থেকে কাহিনি নিয়ে নির্মাণ করেন ‘মাসুদ রানা’। সোহেল রানা নাম ধারণ করে এ ছবিতে নায়ক হিসেবে আসেন তিনি। একই ছবিতে নায়ক ও পরিচালক হিসেবে বিরাট সাফল্য আসে তাঁর। এ ছবিতে আরেকটু ফাস্ট, আরেকটু চোস্ত মারপিট নিয়ে আসেন তিনি। দর্শকেরা সোহেল রানাকে সহজেই হৃদয়ে আসন করে দেন।
এরপর আরও কিছু ছবি নির্মাণ করেছেন মাসুদ পারভেজ। তবে দর্শক তাঁর সোহেল রানা সত্তাটাকেই অধিক সাদরে গ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে অবশ্য নিছক অ্যাকশন-হিরোর ইমেজে নিজেকে বেঁধে রাখেননি সোহেল রানা, বিভিন্ন ছবিতে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করে নিজেকে তুলে ধরেছেন ভিন্ন মাত্রায়। পেয়েছেন একাধিকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ‘এপার-ওপার’, ‘দস্যু বনহুর’, ‘মা’, ‘চ্যালঞ্জে’, ‘মিন্টু আমার নাম’, ‘গুনাহগার’, ‘নাগপূর্ণিমা’, ‘সুখ–দুখের সাথী’, ‘পেনশন’—এসব ছবিতে নানা চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকের অকুণ্ঠ প্রশংসা কুড়ান তিনি।
অ্যাকশনের ঢল
সত্তরের দশকে ঢাকাই ছবির বাণিজ্যিক রসদ হিসেবে অ্যাকশন আর ঢেউ তোলা নাচের সেই যে ঢল নামল, তা কিন্তু আর থেমে থাকেনি। এই সুযোগটাকে লুফে নিলেন ইবনে মিজান, দেওয়ান নজরুল, এ জে মিন্টু, দেলোয়ার জাহান ঝন্টু প্রমুখ পরিচালক। তাঁরা বলিউডের অ্যাকশন ছবির মালমসলা এনে ঢাকাই ছবিতে ঢালতে লাগলেন। বলিউডের কাহিনি অনুসরণে নির্মিত ছবিতে ঢাকাই ছবিপাড়া সয়লাব। ধুমধাড়াক্কা ধাঁচের এসব ছবি দর্শকও টেনেছে ভালো। ইবনে মিজানের ‘এক মুঠো ভাত’, ‘বাহাদুর’, বাবুল চৌধুরীর ‘সেতু’, দেওয়ান নজরুলের ‘দোস্ত দুশমন’—এমন আরও অনেক ছবি বেশ ভালো ব্যবসা করেছে। এ সময় সামাজিক ছবির মিষ্টি ইমেজের তারকারা একে একে অ্যাংরি ইমেজে আবির্ভূত হন। ‘দস্যু রানী’ ছবিতে মিষ্টি ইমেজের শাবানা নাম ভূমিকায় এসে অ্যাকশনের ষোলোকলা পূর্ণ করেন। ছবির একটি অ্যাকশন দৃশ্যে তাঁর ফ্লাইং কিক দেখতে দর্শকেরা বারবার হলমুখো হয়েছেন।
তাই বলে ভালো নির্মাতার হাতে মৌলিক কাহিনির ভালো ছবি যে একেবারে হয়নি, তা নয়। প্রখ্যাত নির্মাতা আমজাদ হোসেন ছিলেন একাই এক শ। তিনি নিজেই ছিলেন চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠান। একাধারে প্রযোজক, পরিচালক, অভিনেতা, কাহিনিকার, সংলাপ রচয়িতা, চিত্রনাট্যকার এবং অসম্ভব শ্রুতিমধুর অনেক গানের গীতিকার।
সত্তরের দশকে আমজাদ হোসেন গ্রামীণ পটভূমিতে ভিন্ন ধারার কাহিনি নিয়ে বানালেন ‘নয়নমণি’। এ ছবিতে শক্তিমান অভিনেতার ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা হয় নায়ক ফারুকের। প্রতিভাময়ী ববিতা ছিলেন বরাবরের মতো অনন্য। আর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে ঘটনাটি ঘটে, তা হলো খলচরিত্রে এ টি এম শামসুজ্জামানের দুর্দান্ত অভিনয়। একজন গ্রাম্য মোড়ল কুটিল হলে কতটা খারাপ হতে পারেন, তা খুব ভালো করেই ফুটিয়ে তোলেন তিনি। এ ছবির মাধ্যমে ভিলেন চরিত্রের সঙ্গে সিরিওকমেডির অসাধারণ সংযোজন ঘটে। দর্শকের কাছে বেশ উপভোগ্য হয়ে ওঠে ভিলেনের এই নতুন রূপ। এ সময় গ্রামীণ পটভূমিতে আরও কিছু ছবি দর্শকদের নাড়া দেয়। পরবর্তী সময়ে শক্তিমান অভিনেতা রাজীব, হুমায়ুন ফরীদি, মিজু আহমেদ প্রমুখ একই ধাঁচে ভিলেন রূপে এসে দর্শকদের কাছে নিজ নিজ প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন।
‘নয়নমণি’র পর আমজাদ হোসেন ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘সুন্দরী’, ‘কসাই’, ‘জন্ম থেকে জ্বলছি’, ‘ভাত দে’, ‘দুই পয়সার আলতা’—একের পর এক নতুন ছবি এনে দর্শকদের বিশেষভাবে নাড়া দিয়ে যান। ভিন্ন ধাঁচের জীবনঘনিষ্ঠ ছবি নিয়ে আরও আসেন সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকি, মসিহউদ্দিন শাকের, শেখ নিয়ামত আলী, আলমগীর কবির, কাজী হায়াৎ, মোরশেদুল ইসলাম প্রমুখ নির্মাতা।
এসব গুণী নির্মাতার হাতে তৈরি ‘সূর্যকন্যা’, ‘সীমানা পেরিয়ে’, ‘রূপালী সৈকতে’, ‘মোহনা’, ‘ঘুড্ডি’, ‘দহন’, ‘লাল–সবুজের পালা’, ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’, ‘পেনশন’, ‘দীপু নাম্বার টু’, ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’—ছবিগুলো দর্শকদের বিশেষভাবে আলোড়িত করলেও অ্যাকশন ছবির ভক্ত বিপুলসংখ্যক দর্শকের নজর ফেরাতে পারেনি।
অ্যাকশন ছবির ডামাডোলে পরিচালক আজিজুর রহমানও বেশ কয়েকটি সুনির্মিত স্বস্তিদায়ক ছবি নিয়ে আসেন। এর মধ্যে ‘অশিক্ষিত’, ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘মাটির ঘর’, ‘জনতা এক্সপ্রেস’—এসব উল্লেখযোগ্য।
সু–অভিনেতা, টিভিব্যক্তিত্ব, নাট্যকার ও পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুনও বিভিন্ন সময় ভিন্ন স্বাদের ভালো ছবি উপহার দিয়েছেন। তাঁর নির্মিত ‘সারেং বৌ’ দর্শকনন্দিত ব্যবসাসফল ছবি। এ ছাড়া আরও কয়েকটি ভালো ছবি তৈরি করেন তিনি। এর মধ্যে ‘সখী তুমি কার’, ‘এখনই সময়’, ‘দুই জীবন’ উল্লেখযোগ্য।
রঙিন টিভিতে ভিসিআর–ভিসিপির সুনামি
আশির দশকের গোড়ার দিকে দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সুনামির ঢেউ নিয়ে এল রিমোট কন্ট্রোলচালিত ভিসিআর-ভিসিপি আর রঙিন টিভি। ভিডিও ক্যাসেটের কল্যাণে এ দেশে বলিউডের হিন্দি ছবি দেখার ধুম পড়ে যায়। এ সময় ‘কুরবানি’, ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’, ‘ববি’, ‘রোটি’, ‘শোলে’, ‘নসিব’, ‘খুদ্দার’, ‘ডন’, ‘মুকাদ্দার কা সিকান্দার’, ‘পুকার’, ‘তোফা’, ‘হিরো’, ‘ডন’—এসব ছবি সিনেদর্শকদের বিনোদনের নতুন পথ খুলে দেয়।
এ সময় রেখা, রাখী, শাবানা আজমী, হেমা মালিনী, পারভিন ববি, ডিম্পল কাপাডিয়া, জিনাত আমান, পুনম ধীলন, শ্রীদেবী প্রমুখ নায়িকা স্বপ্নকন্যার মতো এ দেশের অগণিত কিশোর-যুবা দর্শকের মন কেড়ে নেন। একই সঙ্গে অমিতাভ বচ্চন, রাজেশ খান্না, বিনোদ খান্না, ধর্মেন্দ্র, মিঠুন, জিতেন্দ্র, সঞ্জয় দত্ত, জ্যাকি শ্রফ, ঋষি কাপুর. গোবিন্দ প্রমুখ নায়কেরা অনেক দর্শকের মনে আসন গেড়ে বসেন।
দেশের সিনেমা হলগুলোয় এর নেতিবাচক প্রভাব মরুঝড়ের মতো হামলে পড়ে। ঘরে ঘরে ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজতে থাকে ‘কুরবানি কুরবানি কুরবানি...’, ‘আপ য্যায়সা কোই হ্যায়...’, ‘হাম তুম এক কামরে মে বনদ হ্যায়...’।
দেশজুড়ে তখন রঙিন টিভি আর ভিসিপি কেনার ধুম পড়ে যায়। অনেকে এ সময় ধারকর্জ করে, অস্থাবর সম্পদ বিক্রি করে ভিসিপি-রঙিন টিভি কিনেছেন। যাঁরা পারেননি, তাঁদের জন্য অন্য ব্যবস্থা ছিল। এ সময় ভিসিপি ও রঙিন টিভি ভাড়া দেওয়ার একটা ব্যবসা দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। গড়ে ওঠে ভিডিও ক্লাবের জমজমাট ব্যবসা। ক্রমে সিনেমা হলবিমুখ হতে থাকেন দর্শক। ঢাকাই ছবির বাণিজ্যে বারোটা বাজার টিক টিক তখনই শুরু।
এ সময় অনেক নির্মাতার ছবি বক্স অফিসে আশানুরূপ সাড়া জাগাতে ব্যর্থ হয়। একদিকে নির্মাতারা যেমন হতাশ হতে থাকেন, তেমনি সিনেমা হল বা প্রেক্ষাগৃহের মালিকেরাও পড়ে যান বিপাকে। মুনাফার ঘরে যোগ হতে থাকে ধারদেনার বোঝা। কিছু পরিচালক যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত ‘দূরদেশ’–এর মতো বিগ বাজেটের ছবিতে হাত দেন। তবে এসব ছবিতে খুব বেশি আশা পূরণ হয়নি।
এখানে উল্লেখ্য, ওই সময় মফস্বল শহরগুলোতে সিংহভাগ সিনেমা হলে বৈদ্যুতিক জেনারেটরের সুবিধা ছিল না। কাজেই গরমের সময় বিদ্যুৎ চলে গেলে দর্শক চরম বিরক্ত হতেন। ভিসিপির মাধ্যমে ঘরে বসে দেখায় এই বিরক্তির সুযোগ থাকত না। দর্শকেরা যে যার সময়-সুযোগ বুঝে ঘরে বসে আরামে ছায়াছবি দেখতে লাগলেন। বেশির ভাগই দেখা হতো মারদাঙ্গা ধাঁচের হিন্দি ছবি। রুচিসম্মত দর্শকেরা অনেকে কলকাতার পুরোনো দিনের সামাজিক ছবিও দেখতে লাগলেন। একই সঙ্গে হলিউডের বিখ্যাত ছবিগুলোও দেখার সুযোগ এসে গেল। আরও এসে গেল ব্লু ফিল্ম বা নীল ছবি দেখার সুযোগ। কিশোর বা উঠতি বয়সী তরুণ-যুবা এমনকি পরিণত বয়সের অনেকে এর নেশায় পড়ে গেলেন। ঢাকাই ছবির ‘লাল বাত্তি’ সাইরেন বাজিয়ে জ্বলতে আর নিভতে লাগল।
দর্শকেরা জেনে গেলেন, ইবনে মিজানের ‘এক মুঠো ভাত’ ছবি হিন্দি ছবি ‘রোটি’র অনুকরণে তৈরি, ‘পাতাল ভৈরবী’ অবলম্বনে তৈরি ‘বাহাদুর’ ছবি। ‘গোরা ঔর কালা’ অবলম্বনে তৈরি ‘নিশান’। ‘শোলে’র কাট টু কাট ‘দোস্ত দুশমন’। ‘দিওয়ার’ থেকে হয়েছে ‘সেতু’। হাতের কাছে অধিক সুনির্মিত আসল ছবি দেখার সুযোগ থাকলে হলে গিয়ে নকল ছবি দেখে কে? এমন ভাবনাও অনেক দর্শককে হলবিমুখ করে। এ সময় মুক্তি পাওয়া বাংলা ছবির পাইরেট কপি বাজারে এলে একের পর এক ছবি ব্যবসার দিক থেকে মার খাওয়ায় এ সময় অনেক নির্মাতা-পরিচালক চলচ্চিত্র থেকে হাত গুটিয়ে নেন। সিনেমা হলের মালিকেরাও অনেক ছায়াছবির ব্যবসার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হন।
বলিউডি ছবির সঙ্গে ঢাকাই ছবির টক্কর দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কাঁড়ি কাঁড়ি রুপি লগ্নি করে তারা ছবি বানায় বিশ্ববাজার লক্ষ্য করে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য তাদের মূল লক্ষ্য। আর এ দেশে ছবি নির্মিত হয় সীমিত বাজেট, সীমিত কারিগরি সহায়তা আর আঁটসাঁট নিয়মকানুনের মধ্যে।
ওই সময় বলিউডি নায়িকারা যতটা খোলামেলা হতে পেরেছেন—যেমন জিনাত আমান, পারভিন ববি, পুনম—তাঁদের ধারেকাছে যাওয়ার সাধ্য ছিল না ঢাকার কোনো নায়িকার। এটা সামাজিক ও দেশীয় সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে অবশ্যই শালীনতা মেনেছে। তবে ব্যবসায়িক লক্ষ্য অর্জনে টক্কর দিতে পারেনি।
এই আক্রার মধ্যে নির্মাতাদের জন্য বাণিজ্যের একঝলক অনুকূল হাওয়া নিয়ে আসেন অঞ্জু ঘোষ। যাত্রামঞ্চে নাচগান করতেন তিনি। ১৯৮২ সালে এফ কবীর চৌধুরীর ‘সওদাগর’ ছবির মাধ্যমে ঢাকার ছবিতে যাত্রা শুরু হলো তাঁর। ‘মনের এই ছোট্ট ঘরে আগুন লেগেছে হায় রে...’ গানটির তালে তালে সাগরসৈকত কাঁপিয়ে তিনি যে উর্বশী নাচটা দিলেন, হাজারো দর্শকের চোখ উল্টে গেল। তাঁরা পেয়ে গেলেন বিনোদনের নতুন খনি। আরে, এত দিন এই নায়িকা ছিল কই!
‘সওদাগর’ সুপার-ডুপার হিট। আর অঞ্জুরও ফাটাফাটি ক্রেজ। নাচগান আর ফাইটে পারদর্শী ওয়াসিম হয়ে গেলেন অঞ্জুর যোগ্য নায়ক। এ দুজনকে জুটি করে একের পর এক ছবি মুক্তি পেতে লাগল। ‘আবেহায়াত’, ‘নরম-গরম’, ‘চন্দন দ্বীপের রাজকন্যা’—প্রতিটা ছবিই ব্যবসা সফল। এগুলো সবই ফ্যান্টাসি ছবি। এখানে উল্লেখ্য যে জহির রায়হানও কিন্তু ফ্যান্টাসি ছবি করেছেন। তাঁর নির্মিত ‘সুয়োরানী দুয়োরানী’ এক অনবদ্য ছবি। ঢাকার আরও যেসব সুনির্মিত ফ্যান্টাসি ছবি রয়েছে, এর মধ্যে ‘পাতালপুরীর রাজকন্যা’, ‘অরুণ বরুণ কিরণমালা’, ‘আপন দুলাল’-এর নাম উল্লেখ করা যায়।
কিন্তু পরবর্তী সময়ে অঞ্জু-ওয়াসিম বা অন্যরা যেসব ফ্যান্টাসি ছবিতে এসেছেন, সেগুলোতে পরিচালক-নির্মাতারা কাহিনির চেয়ে নাচ–গানের মালমসলাই বেশ করে ঠেসে দিয়েছেন।
অঞ্জু কিছু ভালো ছবিও করেছেন। এর মধ্যে ‘আশীর্বাদ’, ‘বড় ভালো লোক ছিল’, ‘প্রাণসজনী’ উল্লেখযোগ্য। অঞ্জু বলতে গেলে দীর্ঘ একটা সময় ঢাকাই ছবির বাণিজ্যিক প্রাণ হিসেবে ছিলেন। এ সময় বিভিন্ন পরিচালক এসে ছবি নিয়ে নানা পরীক্ষা চালিয়েছেন। অনেকটা এ ধরনের—দেখি না ছবিটা কেমন চলে। এর মধ্যে দাঁও মেরে দিলেন অখ্যাত পরিচালক তোজাম্মেল হক বকুল। ১৯৮৯ সালে মুক্তি পেল তাঁর ‘বেদের মেয়ে জোস্না’। নাম ভূমিকায় অঞ্জু, নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন। গ্রামবাংলার যাত্রাপালার চলচ্চিত্রায়ন সাদরে গ্রহণ করলেন সারা দেশের মানুষ। বিশেষ করে ‘বেদেও মেয়ে জোস্না আমায় কথা দিয়েছে..’ ও ‘আমি বন্দী কারাগারে...’ গান দুটির জন্য ছবিটি ২৫ কোটি টাকার ব্যবসা করে। এ ধরনের পরীক্ষায় আরেক সফল নির্মাতা অভিজ্ঞ ও বর্ষীয়ান নির্মাতা এহতেশাম। ১৯৯১ সালে মুক্তি পায় তাঁর ‘চাঁদনী’ ছবি। এ ছবিতে শাবনাজ-নাঈম জুটি বিপুলসংখ্যক দর্শককে আকৃষ্ট করেন। পরবর্তী সময়ে বাস্তব জীবনেও প্রেম-পরিণয়ে আবদ্ধ হন দুজন। তবে এ রকম দু-একটা চমক ছাড়া ঢাকাই ছবিতে স্বস্তির ঝিরি ঝিরি বাতাস কখনো থিতু হয়নি।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্রম–উন্নতি একসময় ভিসিপিকেও নির্বাসনে পাঠায়। বিলুপ্তি ঘটে ভিডিও ক্লাবগুলোর। বর্গাকার ভিডিও ক্যাসেটের জায়গা দখল করে বৃত্তাকার সিডি। ঢাকাই ছবির বাণিজ্যিক বৃত্ত এত দিনে আরও সংকুচিত হয়েছে। বিশ্বায়নের অবারিত দ্বারে যোগ হয়েছে ইন্টারনেটের সুবিশাল জাল। সে জালে সবকিছুই আটকানো যায়। যেকোনো ছবি, যেকোনো ভিডিও সার্চ দিলেই হাজির। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম আরেক মোহময় ফাঁদ। সে ফাঁদে আটকে অনেকেই তো এখন সিনেমার কথা ভুলে গেছেন।
গত শতকের নব্বইয়ের দশক নানা চড়াই-উতরাইয়ে পার হয়েছে ঢাকার চলচ্চিত্র। একটা সংকট ছিল নতুনদের আগমন নিয়ে। রাজ্জাক, বুলবুল, সোহেল রানা, আলমগীর, ফারুক. ওয়াসিম প্রমুখ যখন নায়কের চরিত্রে আর মানাচ্ছিলেন না, এ সময় তাঁদের স্থান পূরণে পর্যায়ক্রমে নতুনদের আগমন সেভাবে ঘটেনি। কবরী, শাবানা, ববিতা, সুচরিতা, অলিভিয়া প্রমুখের শূন্য আসনও সেভাবে পূরণ হয়নি।
বলিউডে অমিতাভরা নায়কের ভূমিকা থেকে বিদায় নিতে নিতে অনিল কাপুর, আমির খান, সালমান খান, শাহরুখ খান, অজয় দেবগন, অক্ষয় কুমার, সাইফ আলী খান প্রমুখ নায়ক নিজ নিজ ভাবমূর্তি গড়ে তোলেন। একই সঙ্গে হেমা-রেখারা নায়িকার আসন থেকে সরে যেতে যেতে মাধুরী দীক্ষিত, জুহি চাওলা, দিব্যা ভারতী, মনীষা কৈরালা, কাজল প্রমুখের আবির্ভাব ঘটে। এসব তারকা বিদায় নিতে নিতে আবার নতুন একঝাঁক অভিনয়শিল্পী এসে মুম্বাইয়ের ফিল্ম দুনিয়া দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন।
কিন্তু ঢাকার চলচ্চিত্রে সেভাবে পুরোনোদের বিশাল শূন্যতা পূরণ হয়নি। একটা সময় এফডিসি ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ প্রকল্পের মাধ্যমে নতুন শিল্পী অন্বেষণে নামে। এতে সফলও হয়। মান্না, সোহেল, দিতি, সুব্রত, অমিত হাসান, পুনম প্রিয়াম, রথী—এঁরা এসে পূর্বসূরিদের দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হন। আরও পরে মৌসুমী, পপি, শাবনাজ, শাবনূর প্রমুখ এসে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। কিন্তু সিনেমা হলগুলোতে মূল সারির দর্শকদের ফেরানো কিছুতেই সম্ভব হয়নি।
এর মধ্যে রুবেল অ্যাকশন ছবির মারপিটে কিছুটা বৈচিত্র্য এনে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। টিভি তারকা হুময়ুন ফরীদি বেশ কয়েকটা ছবিতে কৌতুককর কুটিল চরিত্রে অভিনয় করে দর্শক টেনেছেন। মান্না বিপুলসংখ্যক ভক্ত গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। বাপ্পারাজ, রিয়াজ, শাকিল, ওমর সানী, অমিত হাসান, ফেরদৌস, ইমন প্রমুখ বেশ কয়েকটি ছবিতে দর্শক টেনেছেন, তবে তাঁদের অভিনয়জীবন পূর্বসূরিদের মতো গতিশীল ছিল না। একটা সময় থেমে গেছে।
ধূমকেতু সালমান
এর মধ্যে ব্যতিক্রম ছিলেন সালমান শাহ। ঢাকার চলচ্চিত্রে সালমানের আগমন ধূমকেতুর মতো। তিনি এলেন, দেখলেন, জয় করলেন, তারপর আচানক সবাইকে কাঁদিয়ে বিদায়।
১৯৯৩ সালে মুক্তি পেল সোহানুর রহমান সোহান পরিচালিত ছবি ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’। এটি আমির খান ও জুহি চাওলার সাড়াজাগানো হিন্দি ছবি ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’ অবলম্বনে কপিরাইট নিয়ে তৈরি। মৌসুমী-সালমানের জুটি লুফে নিলেন দর্শক। ব্যস, শুরু হয়ে গেল সালমানপর্ব। মাত্র বছর চারেক ঢাকার চলচ্চিত্রে ছিলেন তিনি। এর মধ্যে ২৫টির বেশি ছবিতে সদর্পে অভিনয় করেছেন। প্রতিটি ছবিই সুপার হিট। ১৯৯৬ সালে এই তারকার আকস্মিক মৃত্যুতে ঢাকার চলচ্চিত্রে আক্ষরিক অর্থেই বড় ধরনের ছন্দপতন ঘটে। এরপর মান্না অনেক দিন দাপটের সঙ্গে অভিনয় করে গেলেও ২০০৮ সালে তাঁর অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। দেশজুড়ে অগণিত ভক্তকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে চলে যান না ফেরার দেশে। তারপর একচ্ছত্র নায়ক হিসেবে আর কেউ সেভাবে আবির্ভূত হতে পারেননি।
নায়কপ্রধান ঢাকার চলচ্চিত্রে এখন শাকিব খান, আরেফিন শুভ বা সিয়াম ছাড়া আঙুল তুলে দেখানোর মতো আর নায়ক কোথায়? নায়িকা সে–ও তো হাতে গোনাই। ওই পরীমনি, নুসরাত ফারিয়া, পূজা চেরি, স্পর্শিয়া ছাড়া নায়িকার খাতায় অন্যদের নাম খুঁজে পাওয়া দায়। হালে নায়ক–নায়িকার যেমন আকাল, ছবিও পর্যাপ্ত হচ্ছে না। দু–চারটা তৈরি হলেও আশানুরূপ ব্যবসা হয় না। এ জন্য ঢাকার ছবিপাড়ায় ছবি তৈরির হার বহুলাংশে কমে গেছে। এই ঘোরচক্করের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক সিনেমা হল।
প্রভাব সিনেমা হলে
প্রথম আলোর টাঙ্গাইল প্রতিনিধি কামনাশীষ শেখর জানালেন, টাঙ্গাইলে একসময় রমরমা ব্যবসা করা পাঁচটি সিনেমা হলই এখন বন্ধ। এর মধ্যে একটি গুদামঘর হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। দুটি হল ভেঙে বহুতল ভবন করা হয়েছে—সেও বেশ কয়েক বছর আগে। একটি হল বহু বছর ধরে তালাবদ্ধ। অন্যটিতে কদাচিৎ দু–একটি ছবি এনে চালানো হয়। শুধু টাঙ্গাইল নয়, ঢাকার বাইরে অনেক হলেরই একই দশা। ঢাকার গুলিস্তানের বেদনাদায়ক বিলুপ্তির পর আরও কয়েকটি হলের পরিণতি একই হয়েছে। এর মধ্যে পূর্ণিমা রয়েছে। শ্যামলী হলের রূপান্তর ঘটেছে। মফস্বলের বন্ধ হয়ে যাওয়া হলগুলোর মালিকেরা শেষরক্ষার চেষ্টা কিন্তু কম করেননি। এসব হলে দর্শক টানতে ‘কাটপিস’ বলে পরিচিত অশ্লীল ভিডিও পর্যন্ত প্রদর্শন করা হয়েছে। কিছু নির্মাতা নব্বইয়ের দশকের দিকে ছবিতে অশ্লীল সংলাপও জুড়ে দেন। এতেও কোনো কাজ হয়নি।
ঢাকাই ছবির দুরবস্থার সার্বিক চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রথমত একঘেয়ে অ্যাকশন ছবি ও একই ধরনের নাচ–গান দর্শকদের মধ্যে একঘেয়েমি সৃষ্টি করেছে। এতে দর্শকেরা হলবিমুখ হয়ে পড়ে। পরবর্তী সময়ে বলিউডি ছবির চটকদার ভুবন দর্শকদের সিনেমা হল থেকে আরও দূরে সরিয়ে নেয়। ইন্টারনেটের অবারিত দ্বার এই দূরত্বকে আরও বাড়িয়ে দেয়। দর্শকবিমুখ হওয়ার আরেকটি বড় কারণ নায়ক–নায়িকার পরবর্তী প্রজন্ম যথার্থভাবে না আসা। একসময় নায়করাজ রাজ্জাক, ড্যাসিং সোহেল রানা, সুপার স্টার ফারুক, সু–অভিনেত্রী কবরী, বিউটি কুইন শাবানা, টেলেন্টেড ববিতা বলে যে ‘ভাবমূর্তি’ ছিল, এসব নাম আর কখনো তৈরি হয়নি। সালমান–মান্নার মতো দু–একজন ছাড়া আলাদা করে আর কাউকে চেনা যায় না। ইন্টারনেটের মাধ্যমে হলিউডের ছবিসহ অন্যান্য বিশ্বমানের ছবি দেখার সুযোগ হওয়ায় দর্শকের রুচির বদল হয়েছে। নতুন প্রজন্মের দর্শক এখন আর ঢাকাই ছবির উথাল–পাতাল নাচগান আর সস্তা সেন্টিমেন্ট দেখার রুচিবোধ করেন না। একটা সময় ছিল, যখন আলমগীর কবিরের ‘সূর্যকন্যা’, ‘মোহনা’ কিংবা হারুনর রশীদের ‘মেঘের অনেক রং’ ছবির মতো মানসম্পন্ন ছবির মূল থিম অনেক দর্শক বুঝতে পারতেন না, এখন সে দৈন্য অনেকটাই ঘুচেছে। কিন্তু একজন আলমগীর কবির আর ফিরে আসেননি। একজন আমজাদ হোসেন, একজন খান আতা বা একজন জহিরুল হকও নেই। অথচ ভালো ছবির জন্য দেশের দর্শক যে বুভুক্ষু, এর প্রমাণ বারবার মিলেছে।
হুমায়ূন আহমেদের ‘আগুনের পরশমণি’, ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’, ‘চন্দ্রকথা’, ‘ঘেটুপুত্র কমলা’—এসব ছবির দর্শকপ্রিয়তা এর প্রমাণ। গিয়াস উদ্দিন সেলিমের ‘মনপুরা’ ও ‘স্বপ্নজাল’ সেভাবে দর্শকদের আলোড়িত করেছে। তৌকীর আহমেদের ‘জয়যাত্রা’, ‘অজ্ঞাতনামা’, ‘হালদা’ ও অমিতাভ রেজা চৌধুরীর ‘আয়নাবাজি’ কী বিপুল উচ্ছ্বাস নিয়েই না দেখেছেন দর্শক! ভালো চলেছে ‘ঢাকা অ্যাটাক’–এর মতো থ্রিলার অ্যাকশন ছবি। হুমায়ূন আহমেদের অতিপ্রাকৃত কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত ‘দেবী’ ছবির দর্শকও বেশ ভালো ছিল। কিন্তু অজস্র বুভুক্ষু দর্শকের কাছে এমন একটা–দুটো ছবি স্রেফ একটুখানি সুস্বাদু খাবারের মতো, যা তৃপ্তি মেটায় না—ক্ষুধা আরও বাড়ায়।
বর্তমানে দেশে শতাধিক যেসব হল টিকে আছে, এসব হলের পরিবেশ নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। অর্থের অভাবে বা ব্যবসা ভালো যায় না বলে অনেক সিনেমা হলের সেভাবে সংস্কার হয়নি। ঢাকা জজ আদালতের উল্টো দিকে, ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কাছে আজাদ হলের দিকে তাকালে বোঝা যায়—কী জরাজীর্ণ অবস্থা ওটার! দিনের বেলায়ই অনাহূত লোকজনের আনাগোনা। সেখানে ভদ্র পরিবারের কোনো দর্শক যাওয়ার আগে চৌদ্দবার করে ভাববেন।
অথচ রাজধানীর সিনেপ্লেক্সগুলোয় ভালো মানের ছবি দেখতে চড়া দামে টিকিট কেটে হুমড়ি খেয়ে পড়েন দর্শক। ‘অ্যভেঞ্জার্স: দ্য এন্ডগেম’ দেখতে দর্শকের হুড়োহুড়ি ছিল লক্ষণীয়। এতে বোঝা যায়, অনুকূল পরিবেশে সে রকম কোনো ভালো প্রেক্ষাগৃহে সবাইকে নিয়ে দেখার মতো ছবি প্রদর্শিত হলে দর্শকের অভাব হবে না। কিন্তু এ রকম সিনেপ্লেক্স কয়টিই বা করা সম্ভব?
তাহলে কি আমাদের ঢাকাই ছবির ভবিষ্যৎ আরও সংকুচিত হবে? প্রতিভাধর সৃজনশীল নির্মাতারা এসে কি আর নতুন ধরনের ছবি নির্মাণ করে চমক সৃষ্টি করবেন না? এমন অনেক অভিনয়শিল্পী কি আসবেন না, যাঁরা কেবল বাণিজ্যের রসদ না হয়ে শিল্পের জাদুও হবেন?
শেষ কথা
আমরা এখানেই আশা হারাতে চাই না। কারণ, ভস্ম থেকেই উত্থিত হয় প্রপঞ্চের পাখি। শূন্য থেকে শুরু হয় নতুন যাত্রা। প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে ২০ মে প্রকাশিত একটি খবর তো বেশ আশাব্যঞ্জক। শিরোনাম ‘৯ তারকার ভেলকিবাজি’। ঢাকার চলচ্চিত্রের একঝাঁক তরুণ অভিনেতা–অভিনেত্রী সম্মিলিতভাবে নিজেরাই ছবি নির্মাণে হাত দিচ্ছেন। শিপন মিত্র, সানজু জন, নাদিম, জয় চৌধুরী, রেসি, শিরিন শিলা, বিপাশা কবির, আঁচল, রোমানা নীড়সহ আরও বেশ কয়েকজন রয়েছেন এই উদ্যোগের সঙ্গে। ছবির নাম ‘ভেলকিবাজি’।
শিপন মিত্র, আঁচল, সানজু জন, রেসি, জয় চৌধুরী, শিরিন শিলা, বিপাশা কবির, রোমানা নীড় বিনা পারিশ্রমিকে ভেলকিবাজিতে কাজ করবেন। এমনিতে ঢাকাই সিনেমার অবস্থা মন্দা। দিন দিন ছবি নির্মাণের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এই অবস্থায় ঢাকার চলচ্চিত্রের একঝাঁক তরুণ অভিনেতা–অভিনেত্রী সম্মিলিতভাবে ভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছেন। নিজেরাই ছবি নির্মাণে হাত দিচ্ছেন। এই উদ্যোগের বিষয়ে শিপন মিত্র বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে আমাদের চলচ্চিত্রের বড়রা ছবি নির্মাণ নিয়ে অনেক কথা বলে আসছেন। কিন্তু তাঁদের কথা ও কাজে মিল দেখা যাচ্ছে না। প্রতিবছরই ছবি নির্মাণ কমছে। অবস্থা একেবারেই তলানিতে। তাই দেখলাম বসে না থেকে চলচ্চিত্রের জন্য কিছু একটা করতে পারি কিনা আমরা।’
জানি না, তাঁদের এই ছবি কেমন হবে। তবে এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। নতুনেরা তো এভাবেই আসবেন নতুন করে শুরু করতে। আগে তো শুরু, তারপর ভালোমন্দের হিসাব। তবে আমরা আশাবাদী—ঢাকার চলচ্চিত্রে সুদিন আবার আসবে। তবে হয়তো অন্যভাবে।
শরিফুল ইসলাম ভূঁইয়া: সহকারী বার্তা সম্পাদক, প্রথম আলো
ই–মেইল: [email protected]